হজে খরচ কমায় স্বস্তি


৮ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৫০

এবার জুনের প্রথম সপ্তাহে হজ, নিবন্ধনের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর, যাত্রীদের শুল্ক ও ভ্যাট মওকুফ
স্টাফ রিপোর্টার : হজ প্যাকেজে খরচ কমানোয় স্বস্তি ফিরেছে সম্ভাব্য হজযাত্রীদের। সরকারি ও বেসরকারি ব্যস্থাপনায় এবার যারা হজ করতে যাচ্ছেন, তাদের খরচ কমবে অন্তত এক লাখ টাকা। তবে সরকারি এ সিদ্ধান্তে নাখোশ হজ এজেন্সি মালিকরা। তারা মনে করছেন, এতে তাদের ব্যবসা কম হবে, পাশাপাশি হাজীদের থাকতে হবে কাবা শরীফ থেকে কিছুটা দূরে। ফলে তাদের সেবার মান কমবে।
সম্প্রতি সচিবালয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তার দেওয়া তথ্য মতে, এবার সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার খরচ (সাধারণ প্যাকেজ) এক লাখ টাকার বেশি কমেছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ হজ প্যাকেজ-১-এর খরচ ধরা হয়েছে চার লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে এক লাখ ৯ হাজার ১৪৫ টাকা কম। আর প্যাকেজ-২-এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা, যা গতবারের চেয়ে ১১ হাজার ৭০৭ টাকা কম। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে এবার খরচ ধরা হয়েছে চার লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা, যা গতবারের চেয়ে এক লাখ ছয় হাজার ৬৪৪ টাকা কম। তবে এ টাকার বাইরেও প্রতি হজযাত্রীকে খাবার ও কুরবানি বাবদ আরও ৬৪ হাজার টাকা নিতে হবে। আগে খাবারের টাকা প্যাকেজভুক্ত ছিল।
ধর্ম উপদেষ্টা জানান, প্যাকেজ-১ হচ্ছে তাদের জন্য, যারা পবিত্র কাবা শরিফের তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকবেন। আর প্যাকেজ-২-এ থাকার ব্যবস্থা হবে কাবা শরিফের এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। দুটি প্যাকেজেই গত বছরের চেয়ে খরচ কমেছে। গত বছর সরকারিভাবে হজে যেতে সাধারণ প্যাকেজে পাঁচ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৭ টাকা খরচ হয়েছিল। বিশেষ হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা। এবার বিশেষ প্যাকেজ থাকছে না। সৌদি রিয়ালের মূল্য গতবারের চেয়ে ২.৭৬ টাকা অর্থাৎ ৯.২৮ শতাংশ বেড়েছে। আগামী বছরের হজযাত্রীদের বিমানভাড়া ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা, যা এবার ছিল এক লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা। অর্থাৎ বিমান ভাড়া ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমেছে।
প্যাকেজ-১ : এ প্যাকেজে মক্কায় হারাম শরিফের বহির্চত্বর থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা হবে। হারাম শরিফ যাতায়াতে বাসের ব্যবস্থা থাকবে। একইভাবে মদীনায় মসজিদে নববী থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। মিনায় গ্রিন জোনে (জোন-৫) তাঁবুর অবস্থান এবং মিনা-আরাফাত ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস সুবিধা দেওয়া হবে। মক্কার হোটেল বা বাড়ি থেকে বাসযোগে মিনার তাঁবুতে এবং মিনা, আরাফাত-মুজদালিফা-মিনা ট্রেনযোগে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হবে।
প্যাকেজ-২ : এ প্যাকেজে হারাম শরিফের বহির্চত্বর থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। হারাম শরিফে যাতায়াতে থাকবে বাসের ব্যবস্থা। একইভাবে মদীনায় মার্কাজিয়া (সেন্ট্রাল এরিয়া) এলাকায় আবাসন, মিনায় ইয়েলো জোনে (জোন-২) তাঁবুর অবস্থান এবং মিনা-আরাফাত আপগ্রেডেড ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস সুবিধা থাকবে। বেসরকারি প্যাকেজ : বেসরকারি এজেন্সিগুলো সরকারের প্যাকেজ-১-এর অনুরূপ সুবিধা রাখবে। মক্কা-মিনা-আরাফাত-মুজদালিফা যাতায়াতের জন্য ট্রেন বা বাসের (প্রতি ১০০ জনে একটি বাস অথবা ৫০ জনের ডাবল ট্রিপ) ব্যবস্থা থাকবে। মক্কা, মদীনা ও জেদ্দায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা এবং প্রতি ৪৬ জন হজযাত্রীর জন্য একজন গাইড থাকবে।
এদিকে সরকারের বেঁধে দেওয়া প্যাকেজ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এজেন্সি মালিকদের মধ্যে। তারা ৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে একত্রিত হয়ে মতবিনিময় সভা করেছেন। সেখানে সরকারি প্যাকেজ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি নিজেরা বিকল্প হজ প্যাকেজ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেকোনো সময় এ তারা বিকল্প হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবেন।
এদিকে খবর নিয়ে জানা গেছে, প্যাকেজ ঘোষণার পরও হজ নিবন্ধনে তেমন সাড়া নেই। মন্ত্রণালয় হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য তাড়া দিলেও বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো অনেকটা গুটিয়ে রয়েছে। হাবের নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের প্রভাব পড়ছে হজ নিবন্ধনেও। এ সময়ে এজেন্সিদের হজ নিবন্ধনে সময় পার করার কথা থাকলেও তাদের সময় ব্যয় করতে হচ্ছে নেতৃত্ব ধরে রাখার পেছনে। গত ৪ নভেম্বের সন্ধ্যা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন মাত্র ১০ হাজার ১৫৩ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধিত ২ হাজার ৮৭০ জন ও বেসরকারি মাধ্যমে ৭ হাজার ২৮৩ জন।
অপরদিকে ২০২৫ সালের হজ প্যাকেজের আলোকে চূড়ান্ত নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগ। বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হজের জন্য চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে হজের সব ধরনের লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে হজ পালনের সুযোগ পাবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করবেন ১০ হাজার ১৯৮ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গাইডসহ ১ লাখ ১৭ হাজার জন।
হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশের (হাব) কর্তৃত্ব দখলে হজ এজেন্সির সাধারণ সদস্যদের দুটি গ্রুপ মাঠে নেমেছে। বিগত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর হাবের সাবেক সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ও আরও একজন সদস্য হাব থেকে পদত্যাগ করেন। পরে বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সির মালিকবৃন্দের আহ্বায়ক মো. আখতার উজ্জামান ও সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলীসহ অন্য হাব সদস্যরা হাবের কমিটির বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করেন।
ফলে গত ১৫ অক্টোবর চলমান অস্থিরতা ও অসন্তোষ দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকার হাবের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি বাতিলপূর্বক হাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলামকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। সরকার আগামী ১২০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে হাবের নির্বাচিত কমিটির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাবে প্রশাসক নিয়োগ করায় বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সির মালিকবৃন্দ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। অন্যদিকে ‘সাধারণ হজ এজেন্সির মালিকবৃন্দ’-এর ব্যানারে আরেক গ্রুপ মানববন্ধন করে হাবে প্রশাসক নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এর বিপরীতে হাবের সাবেক কমিটির নেতৃবৃন্দ হাবে প্রশাসক নিয়োগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট এবং দীর্ঘ শুনানিও হয়েছে। হজ এজেন্সিগুলোর সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হওয়ায় সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অধিকাংশ হজ এজেন্সিগুলোর মাঝে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এর প্রভাব দেখা দিয়েছে হজ নিবন্ধনে।
এদিকে হজ যাত্রার খরচ আরও কমাতে যাত্রীদের টিকিটের ওপর থেকে আবগারী শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মুসক) মওকুফ করা হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিশেষ আদেশে এ কথা জানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর জানিয়েছে, ২০২৫ সালের হজ যাত্রীদের বিমানবন্দরের এম্বারকেশন ফি, যাত্রী নিরাপত্তা ফি এবং এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা ফির ওপর থেকেও মূল্য সংযোজন করও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হজ পালন আরও ব্যয়সাশ্রয়ী ও সহজ হবে বলে মনে করছে এনবিআর। আগামী বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এবারের হজ অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই হজ পালনের খরচ কমানোর কথা বলছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। এর অংশ হিসেবে আলোচনার জন্য সৌদি আরব সফরেও যান ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হাসান। খরচ কমাতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পর ৩০ অক্টোবর ঘোষণা করা হয় ২০২৫ সালের হজ প্যাকেজ। ২০২৫ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজ-১ নিলে ব্যয় হবে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় থাকা যাবে মসজিদুল হারামের আশপাশের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িতে। এছাড়া মক্কা ও মদীনায় রুম প্রতি সর্বোচ্চ ছয়জন করে থাকতে পারবেন এবং প্রতিটি রুমে অ্যাটাচ বাথ ও রেফ্রিজারেটরের ব্যবস্থা থাকবে। সরকারি প্যাকেজের সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে হজযাত্রীরা মক্কা ও মদীনায় ২, ৩, এবং ৪ শয্যার রুম বা শর্ট প্যাকেজের সুবিধা নিতে পারবেন। দুই সিটের রুমের মোট প্যাকেজ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০০ টাকা। তিন সিটের রুমের প্যাকেজ খরচ ৫ লাখ ৭০ হাজার ৮৮০ টাকা এবং চার সিটের রুমের প্যাকেজ ব্যয় ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৭২০ টাকা। সরকারি ব্যবস্থাপনা হজ প্যাকেজ-২-এর (মসজিদুল হারামের আশপাশের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বাড়ি) ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। দুই সিটের রুমের প্যাকেজ ব্যয় ৭ লাখ ৭০ হাজার ৪৫৬ টাকা। তিন সিটের রুমের প্যাকেজ ব্যয় ৭ লাখ ৫ হাজার ৫৩০ টাকা এবং চার সিটের রুমের প্যাকেজ ব্যয় ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৭০ টাকা। বেসরকারিভাবে সাধারণ প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। হজের প্রাথমিক নিবন্ধন চলবে আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।