সবজি সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক-ভোক্তা
৮ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০৫
॥ সাইদুর রহমান রুমী॥
অতি মুনাফাখোর মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যে অসহায় উৎপাদনকারী কৃষক আর সাধারণ ভোক্তারা। শাকসবজির উৎপাদন মূল্যের সাথে তাই ভোক্তা পর্যায়ের দামে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ভোক্তা-কৃষককে অন্ধকারে রেখে এভাবে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া সিন্ডিকেটগুলো বছরের পর বছর পকেট কাটছে ক্রেতাদের। কৃষকদের বাঁচিয়ে ভোক্তাদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ন্যায্যমূল্যের স্বস্তির বাজার প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন আড়তে অভিযান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিভিন্ন উদ্যোগ আশাবাদী করছে সাধারণ মানুষকে।
ফড়িয়া সিন্ডিকেটে সবজির কেজিতেই বাড়ছে ১৫-৬০ টাকা : কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সবজির চড়া দামের কারণ কয়েকবার হাতবদল এবং ফড়িয়াদের অতি মুনাফা আদায়ের কৌশল। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। কৃষক, পাইকারি বিক্রেতা, আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, চার দফা হাতবদলে দু-তিনজন মধ্যস্বত্বভোগী যুক্ত হন। প্রতি ধাপে দুই থেকে আট টাকা বা তার বেশিও দাম বাড়ে। যেমন গত ৪ নভেম্বর সোমবার যাত্রাবাড়ীর একটি আড়তে প্রতি কেজি বরবটি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। তিন ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানেই তা দুই হাত বদলের পর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এদিকে গত ২ নভেম্বর শনিবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কারওয়ান বাজার-যাত্রাবাড়ীতে সবজির ট্রাক আসে রাত ১২টার দিকে। এরপর ট্রাক থেকে সবজি ছয়-সাতবার হাতবদল হয়ে তা খুচরা বিক্রির পর্যায়ে পৌঁছায়। এ হাতবদলেই মূলত হচ্ছে কারসাজিটা। সবজি দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সম্পর্কে কথা হয় কাওরান বাজারে দীর্ঘ কয়েক যুগ ব্যবসা করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সবজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কীভাবে দর বাড়ে, তার কিছুটা ধারণা দেন তিনি। তার ভাষ্য, ক্ষেত থেকে সবজি নিয়ে স্থানীয় আড়তে যায় কৃষক। সেখান থেকে কেনে ব্যাপারীরা। এখানে সবজির মোট কেনা দরের সঙ্গে ৫ শতাংশ আড়তদারি দিতে হয়। অর্থাৎ ২০ টাকার পণ্যে ২২ টাকা দিতে হয়। সবজি ট্রাকে তোলা বাবদ শ্রমিক খরচ প্রতি ট্রাকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো। রংপুর-বগুড়া থেকে ঢাকায় আনতে ভাড়া লাগে গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি ট্রাকে ১০ থেকে ১২ টন আনা যায়। ঢাকায় আনার পর প্রতি ২০ টাকার সবজি বিক্রির বিপরীতে আবারো আড়তদারি কমিশন দিতে হয়। এসব খরচ ও লাভ যোগ করে দেখা যায়, ২০ টাকার সবজির বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এবার আসা যাক, আড়ত থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কীভাবে দর বাড়ায়। তার ভাষ্য, কারওয়ান বাজারে রাতে সবজি আসার পর ব্যাপারীরা কয়টি ট্রাক এসেছে, কী পরিমাণ এসেছেÑ এসব খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে। পরিমাণে কম এলেই পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়তে থাকে। তখনই দাম বাড়ানো শুরু হয়। এমন, দেখা যায় কোনো কোনো প্রভাবশালী আড়তদার ব্যবসায়ীরা অঘোষিতভাবে বলে দেয় কেউ যেন তাদের বেঁধে দেয়া দামের কমে বিক্রি না করে। ফলে শুরুতে যে লাউ প্রতিটি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে; শেষদিকে তা ৫০ থেকে ৭০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাস্তবে ঢাকা ও তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, পণ্য উৎপাদনের পর বিক্রি করে সামান্যই লাভ পাচ্ছেন কৃষক এবং ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে চড়া দামে কিনতে গিয়ে ঠকছেন ভোক্তারা আর লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।
যেভাবে বাড়ানো হয় দাম : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোক্তারা কীভাবে ঠকছেন তার চিত্র সম্প্রতি কুমিল্লার বিখ্যাত সবজি বাজার নিমসার বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনায় দেখা গেছে। স্থানীয় প্রান্তিক চাষিরা ঝুড়িতে করে কাঁচা শাকসবজি আনলেও ঝুড়ি পড়তেই অন্তত ৩০০ টাকা দেওয়া লাগত স্থানীয় আওয়ামী লীগ চাঁদাবাজদের। এছাড়া যেকোনো ব্যবসায়ী অল্প পরিমাণে শাকসবজি বিক্রি করলেও প্রতি মুঠা বা কেজিপ্রতি চাঁদাবাজদের টাকা দিতে হতো। যে কারণেই পাইকারি বাজার থেকে শাকসবজি কিনে নিয়ে বাজারে অন্তত ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি ধরে বিক্রি করতে হয় সাধারণ মানুষের কাছে। অন্যদিকে একই পণ্য পরিবহনের জন্য পরিবহন টোলও আদায় করা হয়। এভাবে বেপরোয়াভাবে খাজনা ও চাঁদা আদায়ের কারণে খুচরা পর্যায়ে শাকসবজির দাম বেড়ে যেতো। এ সিন্ডিকেট এখন অন্যভাবে চেষ্টা করছে দাম বাড়ানোর।
বগুড়া থেকে ঢাকা : পদে পদে সিন্ডিকেট
বগুড়ার মহাস্থান হাটে প্রতি কেজি ৬০ টাকার করলা কারওয়ান বাজার আড়তে বিক্রি হয় ৮০ টাকায়, ৩০ টাকার বেগুন ৬০ টাকায়, ৪০ টাকার শসা ৬০ টাকায় ও ৫০ টাকার কাঁকরোল ৭৫ টাকায়, ৫০ টাকার মুলা ৬৫ টাকায়, ৬৫ টাকার ঢ্যাঁড়শ ৮০ টাকা আর ৪০ টাকার বরবটি ১০০ টাকায়। এই সবজি ভোক্তা পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতারা আরও বেশি দরে বিক্রি করে।
ট্রাকচালক, সহযোগীসহ পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে দেশের বিভিন্ন হাট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পথে পথে প্রতি ট্রাকে গড়ে দূরত্বভেদে এক-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো। এর বাইরে দিতে হতো পুলিশের মাসিক টোকেন বাবদ চাঁদা। এখন দলীয় চাঁদাবাজি এবং পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেলেও অসাধু ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি। রাজধানীর দুটি পাইকারি ও তিনটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, কয়েক দফা হাতবদলে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম কেজিতে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি বরবটির দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। একই দিন তা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের মুগদা-বাসাবো বাজারে ১২০-১৩০ টাকায় খুচরা বিক্রি করা হয়।
কৃষকদের বক্তব্য
বগুড়ার কৃষক আলফু মিয়া সোনার বাংলাকে বলেন, ‘আমরা খ্যাতে ফসল ফলাই। এত পরিশ্রম করেও দাম পাই না, আর যা পাই, তাতে খুব কম লাভ হয়, কিন্তু বিক্রি করে দিতে হয়। গত কিছুদিন হতে সরকারের ব্যবস্থার কারণে কিছুটা ভালো দাম পাচ্ছি। তবে তার পরও সার-বিষের যে দাম, সবজি চাষ করে এখুন লাভ বার করা খুব কঠিন। যখন দাম পাবো না, তখুন ক্ষতি হবি। তাও ফসল তো আমাদের করতেই হয়। আমাদের লাভ হইল না ক্ষতি হইল, সেডা দেখার তো কেউ নাই। আশা করি এই সরকার সার-বীজ-বিষের দাম কমিয়ে আমাদের বাঁচাবে। যারা আমার কাছ থেকে ফসল কিনি নিয়ে য্যায়ে অন্য যাগাত বিক্রি করতিছে, তাদের লাভ কিন্তু ঠিকিই হচ্ছে।’ কুমিল্লা অঞ্চলের আরেক কৃষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘এবার শেষের দিকে এসে ভারী বৃষ্টির কারণে অনেক সবজি ডুবে গেছে। এ কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের সবজি এখন বিক্রি করছে তারা কিছুটা দাম পাচ্ছে। সরকারি লোকজন বা খুচরা ব্যবসায়ীরা যদি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কিনত, তাহলে আমরা ভালো দাম পাইতাম।’
বিশেষজ্ঞদের কথা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে এরই মধ্যে ডিম, আলু ও পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটা কার্যকরে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। স্টোরেজ সিস্টেম ডেভেলপ করে সবজির সংরক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুদিন এলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে হবে। প্রতি ইউনিট উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করতে হবে। কৃষকদের সার-বীজ-কীটনাশকের দাম কমিয়ে দিতে হবে, তাদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে লাভের মার্জিন ঠিক করে দিতে হবে।
মূল্য নিয়ন্ত্রণে কী করছে সরকার
অসাধু সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজি বিক্রি শুরু করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। রাজধানী ঢাকায় কম মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে ‘স্বস্তির হাট’ নামেও বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছে। ট্রাকে করে সবজি ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রি শুরু করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বাজারের নিয়মিত মূল্যের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী সুলভমূল্যে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ১৫টি উৎপাদক অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে দেশব্যাপী সরবরাহ নিশ্চিতের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষও। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সরকার করপোরেটদের হাতে বন্দি নয় জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছে সরকার। নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে।