রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৮ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ॥ ৮ জিলকদ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১৭ মে ২০২৪

এসএসসি ও দাখিলের ফল বিশ্লেষণ

মেয়েরা এগিয়ে, ছেলেরা পিছিয়ে

মোবাইল, গেমিং, মাদক ও গ্যাং কালচারে আসক্ত ছাত্ররা
॥ সামছুল আরেফীন ॥
মহামারি করোনা শুরুর পর অনেকটা ওলটপালট হয়ে যায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। যার সরাসরি ভুক্তভোগী হন শিক্ষার্থীরা। পাবলিক পরীক্ষায় কখনো অটোপাস, কখনো আবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসসহ নানা বিষয়ে ছাড় দিতে হয় তাদের। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে কয়েক বছর পর এবার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। বরাবরের মতো এবারও এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। এর আগের চার বছরও জিপিএ-৫ এবং পাসের দিক থেকে মেয়েরাই এগিয়ে ছিল। পরপর পাঁচ বছর বেশ চমক দেখাল মেয়েরা। এ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও বিস্মিত হন। কেন বার বার মেয়েরা এগিয়ে এবং ছেলেরা পিছিয়ে যাচ্ছেÑ এর কারণ বিশ্লেষণ দরকার মনে করেন তিনি। কারণ অনুসন্ধানের জন্য তিনি নির্দেশনাও দিয়েছেন। এবার একাধিক শিক্ষা বোর্ডে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ খারাপ করেছে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ একাধিক বিষয়ে।
গত ১২ মে রোববার সকালে গণভবনে সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এসএসসি ও দাখিলের ফলাফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পরে দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ সময় তিনি ফলাফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
চলতি বছরের এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে সবদিক দিয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ছেলেদের ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশের বিপরীতে মেয়েদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে মেয়েরা। ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত মেয়ের বিপরীতে ছেলে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন।
কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে একই রকম চিত্র। ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়াকে সবাই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে ছাত্ররা ক্রমেই কেন এত পিছিয়ে পড়ছে, তা নিয়েও বাড়ছে দুশ্চিন্তা। ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করা প্রধানত দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ছেলেরা আগেও বাইরে ঘোরাফেরা করত। তবে বাসায় ফিরে পড়তে বসত। এখন বাইরে ঘোরাঘুরির পাশাপাশি বাসায় ফিরে মোবাইল ফোনে ডুবে যাচ্ছে। স্কুলপড়ুয়ারা অতিমাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করায় পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারছে না। ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্ররা মোবাইল ফোন ব্যবহারের বেশি সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়াও ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এখন অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে আলাদাভাবে দেখেন না। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। তবে তাদের মতে, প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো মেয়েরা পিছিয়ে। আর গণিতের বড় সমস্যা হলো মানসম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কিছু কারণের মধ্যে শৃঙ্খলার দুর্বলতা অন্যতম। বিগত কয়েক বছর ধরে শহর থেকে গ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান হয়েছে। লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০২০ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হারে ছাত্রীরা ছাত্রদের চেয়ে ২.৪৭ শতাংশ এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০২২ সালে দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৩ দশমিক ০১ শতাংশ এবং এবারের ফলাফলে ছাত্রদের চেয়ে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ছাত্রীরা পাসের হারে এগিয়ে রয়েছে। পাঁচ বছরে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ গড়ে এগিয়ে আছে ছাত্রীরা। ২০২০ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে ছাত্রদের চেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে ছিল ৪ হাজার ৩৯০ জন। ২০২১ সালে ২৩ হাজার ৮১৬ জন, ২০২২ সালে ২৭ হাজার ২৯০ জন আর ২০২৩ সালে এগিয়ে ছিল ১৩ হাজার ৬৫০ জন। এবারও ১৫ হাজার ৪২৩ জন মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাঁচ বছরে গড়ে জিপিএ-৫ পেয়ে এগিয়ে রয়েছে ১৬ হাজার ৯১৪ জন ছাত্রী।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, মেয়েরা কয়েক বছর ধরেই এগিয়ে। হঠাৎ তারা ভালো করেছে, তা নয়। ছাত্রীরা একাডেমিক পড়ালেখায় সবসময় ভালো। ছাত্ররা অনেক সময় মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও হেলায় সময় নষ্ট করে দু-একটা বিষয়ে খারাপ করায় পুরো ফলাফলে প্রভাব পড়ে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনায় মেয়েরা এগিয়ে থাকার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। তা হলো- মেয়েরা পড়াশোনায় অনেক সিরিয়াস। বেশিরভাগ পরিবার মেয়েদের বাইরে ঘোরাফেরা, আড্ডা দেওয়া পছন্দ করে না। বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতে হয়। ফলে তারা সেই সময় কাজে লাগায়। লেখাপড়া করে। এছাড়া শিক্ষায় মেয়েদের উপবৃত্তিসহ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ছেলেদের পিছিয়ে থাকার বিষয় নিয়ে আরও ভাবা উচিত।
ছাত্রদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে মাদককেও দায়ী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ছেলেদের জন্য মাদক যতটা সহজলভ্য, মেয়েদের জন্য ততটা নয়। অনেক ছেলে স্কুলজীবনে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে তার লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ছাত্র কম বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিতে খণ্ডকালীন কাজ করছে। শহরে কম বয়সী ছেলেদের মধ্যে সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাইরে আড্ডা, খেলাধুলাও ছেলেরা বেশি করে। অনলাইন গেম ও অনলাইন জুয়ায় আসক্তিও ছেলেদের লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণা করলে মূল কারণ উঠে আসবে।
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম বাহাউদ্দিন বলেন,  ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি কর্মঠ। তারা বেশি অধ্যবসায়ী। ছেলেদের ক্ষেত্রে যেটা দেখি, সেটা হলো তারা বেশি বহির্মুখী। এছাড়া মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা মোবাইলে বেশি আসক্ত। এসব কারণেই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফলাফল ভালো। এজন্য ছেলেদের সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। প্রযুক্তি অবশ্যই ভালো। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। বিপরীত দিকে ভালো ফলের পেছনে মেয়েদের অধ্যবসায়ী মনোভাব বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ এবং মেয়েদের উপবৃত্তির আওতায় আনায় মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশ নেয়া বেড়েছে বলেও মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ছেলেরা পড়ছে কম, বাইরে ঘুরছে বেশি। ঘরে থাকলেও মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডুবে থাকছে। আমি কয়েকটি জরিপ দেখেছি, নিজেও পর্যবেক্ষণ করেছি, স্কুলপড়ুয়া ছেলেটার হাতে বাবা-মা মোবাইল তুলে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার হাতে দিচ্ছে না। হয়তো অন্য কোনো চিন্তা থেকে দিচ্ছে না। তাতে মেয়েটা পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে। আর ছেলেটা ফেসবুক, গেমিংয়ে সেটা ব্যবহার করছে। এভাবে ছেলেরা পড়ালেখায় ক্রমে চরম অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ১২ মার্চ। ব্যবহারিক পরীক্ষা ১৩ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৯৪০ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেয় ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ জন। সারা  দেশে ২৯ হাজার ৮৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৭৯৯টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।