॥ মোহাম্মদ হাসান শরীফ ॥
প্রচারেই প্রসার। একসময় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার এ স্লোগান বেশ আকর্ষণীয় ছিল। কিংবা গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি- ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বার বার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে’ সবসময় উচ্চারিত হয়। প্রচারের ঠিক বিপরীত শব্দটিই হলো অপপ্রচার। আর এ দুইয়ের মিলনে হলো সংবাদপত্র। দুটি কাজই একসাথে করে যায়। বর্তমান সময়ে অবশ্য কেবল সংবাদপত্রের মধ্যে সীমিত না থেকে ডিজিটাল মাধ্যমগুলোকেও এর মধ্যে শামিল করা দরকার। প্রসারের জন্য প্রচার কিংবা অপপ্রচার সামাল দেয়ার প্রচারের প্রয়োজনীয়তা সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল। মাধ্যমটা কেবল যুগের তালে তালে পরিবর্তন হয়েছে। হাল আমলের টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি মাধ্যম এখন সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বলা যায়, সংবাদপত্রের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সংবাদপত্র যখন দোর্দণ্ড প্রতাপে ছিল না, তখনো কিন্তু প্রচার, অপপ্রচারের কমতি ছিল না। সংবাদপত্র অস্তিত্বহীন হয়ে গেলেও তা থামবে না। তিলকে তাল বানানোর প্রবাদবাক্যটির সৃষ্টি এখনো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উপমহাদেশের চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অন্যতম ভাওয়ালের মেজকুমার তথা সন্ন্যাসী বনাম রানি বিভাবতী মামলা। গত শতকের প্রথমভাগের এ মামলা এখনো নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়। গাজীপুরের ভাওয়াল এস্টেটের জমিদার মেজো কুমারের মৃত্যু এবং নাগা সন্ন্যাসী হিসেবে ফিরে আসা এবং রাজকর্মচারী ডাক্তার আশুতোষের সাথে রানি বিভাবতীর পরকীয়া ও সেই সূত্রে স্বামীকে হত্যার অভিযোগ ছিল মামলার উপজীব্য। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মামলাটি চলে। ঢাকা আদালতেই চলে দু’বছর আট মাস। মোট ১,৫৪৮ জন সাক্ষ্য দেয়। বাদিপক্ষে ১০৬৯ জন ও বাকিরা বিবাদী পক্ষের। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সাক্ষী দিয়েছিল- আইনজীবী, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, আলোকচিত্র বিশারদ, হস্তাক্ষর বিশারদ, জমিদার, প্রজা, কৃষক, চিত্রকর, বারবণিতা, প্রহরী। জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশকারীর পূর্বের ছবি ও বর্তমান আবয়ব, বংশগত চিহ্ন, জুতার মাপ প্রভৃতি বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছিল। সেকালের নামকরা অনেক আইনজীবী এ মামলায় সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এ মামলার নাটকীয়তা আইনের জগৎকে পুরোপুরি স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এ কাহিনী নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অসংখ্য নাটক, গান, সিনেমা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রচার কিংবা অপপ্রচার- যাই বলি না কেন, ওই দায়িত্বটি দারুণ দক্ষতার সাথে করেছিলেন সন্ন্যাসীরা। প্রচারণার তখনকার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি ছিল তাদের হাতেই। তখন টেলিভিশন ছিল না। রেডিও বা পত্রিকা ছিল খুবই সীমিত পর্যায়ে। ফলে বাউল-সন্ন্যাসীরা যখন প্রতিনিয়ত মেজোকুমারের বঞ্চনা এবং রানির কথিত অবৈধ লীলাকাহিনী নিয়ে গান, ছড়া প্রভৃতি দিয়ে সব দিক মাতিয়ে তুলছিল, তা মোকাবিলা করার তেমন কিছুই ছিল না প্রতিপক্ষের। সাধারণ মানুষ সহজেই এ কাহিনী বিশ্বাস করতে থাকে। যদি বলা হয়, এ উন্মাদনা বিচারকাজকে প্রভাবিত করেছিল, তবে তা বাড়িয়ে বলা হবে না।
তবে এখন সংবাদপত্র সত্যিই সংকটে পড়ে গেছে। এটা কেবল বাংলাদেশে নয়। সারা দুনিয়ায়। অনেক প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কেউ কেবল অনলাইন সংস্করণ বের করে নামটি টিকিয়ে রেখেছে। সংবাদপত্র এ দুরবস্থায় পড়ল কেন? এককথায় উত্তর, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। নতুন যুগের চাহিদা সে যেমন একদিকে মেটাতে পারেনি; অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। এটাই ব্যবধান গড়ে দিয়েছে।
তবে ছাপা সংবাদপত্র এত দ্রুত এমন সংকটে পড়বে, তা ছিল কল্পনাতীত। করোনা ভাইরাস আত্মপ্রকাশের আগেই ভাটার টান লেগেছিল। কিন্তু তারপর আর দাঁড়াতে পারেনি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেভাবে নিজেকে পরিবেশন করা দরকার ছিল, তা তারা পারেনি। এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, সারা দুনিয়ায় প্রযোজ্য হয়েছে। যদি বলা হয়, বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীদের মেধার অভাব রয়েছে, দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, তাহলে প্রশ্ন জাগবে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা কেন ঘটল? অন্যান্য দেশের ছাপা পত্রিকা কেন আগের অবস্থান ধরে রাখতে পারল না? মূলধারার সংবাদপত্র যেভাবে সত্যকে চেপে যাচ্ছিল, অপপ্রচার ছড়াচ্ছিল, দলান্ধ প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল, তাতে তার পতন সময়ের ব্যাপারই ছিল। অপপ্রচারের প্রচার বেশিদিন টিকবে না, এটাই স্বাভাবিক। গোয়েবলস যতই বলুন না কেন, সাময়িক সময়ের জন্য হয়তো অপপ্রচারকে গেলানো সম্ভব, দীর্ঘমেয়াদে তাকে পরিণাম ভোগ করতেই হবে।
সত্য গোপন করাটা আমাদের দেশের মূলধারার সংবাদপত্রই কেবল করেনি, আন্তর্জাতিক মিডিয়াও করেছে। খ্যাতনামা সংবাদপত্রগুলো এখনো ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একপেশে খবর পরিবেশন করে তাদের নিজেদের অস্তিত্বকেই অস্তিত্বহীন করে তুলেছে। এর প্রতিবাদ করার মতো কিংবা বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রচারের মূলধারার কোনো মিডিয়ার আত্মপ্রকাশ সম্ভব ছিল না। গুটিকতেক লোকের ভাষ্য সবার ভাষ্য হিসেবে চালানোর চেষ্টা অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। একটু সময় লেগেছে এই আরকি। আর এ কারণেই বিকল্প পথ বের হয়েছে। সংবাদপত্রও একসময় কারো বা অন্য কারো বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। একটি কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, প্রস্তর যুগের সমাপ্তি কিন্তু পাথরের অভাবের কারণে ঘটেনি। পাথরের চেয়ে ভালো বিকল্প বের হয়েছিল বলেই যুগের পরিবর্তন ঘটেছিল। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে।
তবে মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্র প্রচারের একটি বাহন। বাহনটির অস্তিত্ব অনিবার্য। রূপ ভিন্ন হতে পারে। বাহনটি না থাকলে সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রচার কিংবা অপপ্রচারের মাধ্যম সবসময়ই থাকবে। সেটার নাম সংবাদপত্র হতে পারে, আবার অন্য কিছুও হতে পারে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’ ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে
- ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’র বহুল প্রচার উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করছি
- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
- সাংবাদিকতার সর্বজনীনতা ও সংবাদমাধ্যমের প্রভাব
- আত্মার বোধ ও বিশ্বাস
- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর সাংবাদিক জীবন
- অনুভূতি
- কেউ ভালো নেই
- ফজলুল হক তুহিন-এর দুটি কবিতা
- কবি আল মাহমুদের সাংবাদিক জীবন
- সাপ্তাহিক সোনার বাংলার ৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : আগামী দিনের করণীয়
- সাংবাদিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম
- অপরাধ দমনে সংবাদমাধ্যম
- ইসলামী ধারার রাজনীতির বিকাশ ও সোনার বাংলার ভূমিকা
- আর নয় আত্মহত্যা : আল কুরআনে আছে শান্তির বারতা