॥ মুহাম্মদ ইসমাঈল ॥
একজন কবি জীবন, সমাজ, দেশ ও পৃথিবীকে দেখেন দার্শনিকের চোখে। তা তুলে ধরেন, ছন্দ-অলঙ্কারের বর্ণিল ভাষায়। অন্যদিকে মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহের বিচিত্র তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে যেসব প্রকাশনা রূপলাভ করে, সেগুলোকে সংবাদপত্র বলে। এই দুইয়ের সমন্বয় ছিল কবি আল মাহমুদের বর্ণাঢ্য জীবনে।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতা সমাজের আর দশটি পেশার মতো নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মতে, সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও। প্রকৃত সাংবাদিকদের দায়িত্ব বস্তুনিষ্ঠ ও সততাপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করা। সাংবাদিকতা যেমন এক বিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্গঠনে অবদান রাখতে পারে, ঠিক তেমনি সাংবাদিকতার নামে মিথ্যাচার, পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থপরতা এক সুসংহত জাতিকে হিংসাত্মক যুদ্ধের দাবানলে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। মানবজীবনের প্রয়োজন আর রুচি-বৈচিত্র্যের জন্য এক ব্যাপক সম্প্রসারণ। মানবজীবনের সাথে সংবাদপত্রের এত বেশি সম্পৃক্ততা যে সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক জীবন অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়; বিশ্বের সাথে ব্যক্তি মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সংবাদপত্র বিশ্বের যাবতীয় সংবাদ আর তথ্যের বাহন হিসেবে প্রতিদিন সকালে নিয়মিতভাবে উপস্থিত হয়ে জীবনকে করে তুলেছে যথার্থই গতিশীল। সংবাদপত্র আধুনিক মানুষের নিত্যসঙ্গী। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম।
অনেক চড়াই-উৎরাই জীবন পার করে নিজেকে একজন সফল সাংবাদিক হিসেবে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন।
আল মাহমুদের কবিতা মানেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিষ্ঠান। কবি পরিচয়ের সঙ্গে একজন প্রভাবশালী বাংলা সাহিত্যিক, সৃজনশীল প্রাবন্ধিক, সফল শিশু সাহিত্যিক, প্রভাবশালী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে আল মাহমুদ এককথায় অসাধারণ ও অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতায় একজন মৌলিক, শক্তিমান এবং ঐতিহ্যবাহী কবি প্রতিভা। সেইসঙ্গে কবি হিসেবে বিশ^সাহিত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
১৯৫৪ সালে কবি আল মাহমুদ লেখালেখি ও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকায় আসেন। ‘দৈনিক মিল্লাতে’ সম্পাদনা সহকারীর চাকরি নেন। ১৯৫৪ সালে কবি আজিজুল হাকিম ও কবি আবদুর রশিদ ওয়াসেকপুরীর সম্পাদনায় ১৯ নম্বর আজিমপুরস্থ প্রেস থেকে ‘একুশের কবিতা’ শীর্ষক ভাষা আন্দোলনভিত্তিক দ্বিতীয় ঐতিহাসিক স্মরণিকা বের হয়। এখানে তার ‘যদি পারতাম’ কবিতাটি ছাপা হয়।
১৯৫৫ সালে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে কবির বিয়ে হয়। ১৯৫৫ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যার ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু আল মাহমুদের তিনটি কবিতা ছাপেন। কবিতাগুলো- ‘প্রবোধ’, ‘অন্ধকারে একদিন’ ও ‘সিম্ফনি’। আল মাহমুদের কাছে তখন পর্যন্ত পৃথিবীর হাসি-কান্নার মধ্যে সবচেয়ে পুলকময় মুহূর্ত ছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশের সংবাদ।
১৯৫৬ সালে ‘কাফেলা’ সম্পাদনার দায়িত্ব পান এ সময় ‘সওগাত’ অফিসে হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শহীদ কাদরী, ওমর আলী প্রমুখের সাথে তার পরিচয় ঘটে।
১৯৬৩ সালে এ সময়ে ‘কাফেলা’ ছেড়ে তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ সম্পাদনা সহকারী পদে যোগদান করেন। স্বীয় প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার নৈপুণ্যে তিনি সম্পাদনা সহকারী থেকে মফস্বল সম্পাদকের পদে উন্নীত হন। এ সময় তার তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৬ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৮ সালে ‘ইত্তেফাক’ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি চট্টগ্রামে চলে যান। কবি জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের আর্ট প্রেসে কাজ পান এবং প্রকাশনী সংস্থা ‘বইঘর-এর প্রকাশনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’-এর ১ নম্বর সনেটটি চট্টগ্রামে বসেই ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে লেখেন এবং ১৪ নম্বর সনেটটি ১২ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে শেষ হয়। ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
১৯৬৯-এ ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ চালু হলে পুনরায় তিনি সেখানে সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মে যোগদান করেন। ১৯৬৯-এর পর গণঅভ্যুত্থান ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ঐকান্তিকভাবে এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের মার্চে ইত্তেফাক ছেড়ে আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বীরত্বের সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতায় লেখক-কবি-শিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯৭২-এ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসীদের মুখপাত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র রেডিক্যাল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’ বের হলে তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘গণকণ্ঠ’ সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ফলে সরকারের রোষানলে পড়ে। কলকাতা থেকে এ সময় ‘জয় বাংলা সাহিত্য পুরস্কার’ পান।
১৯৭৪-এর মার্চ মাসে আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে প্রায় দশ মাস বিনাবিচারে কারাগারে থাকতে হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক অধ্যয়নে আল কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে মতাদর্শের পরিবর্তন ঘটে। ছোটগল্পে ‘জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার’ অর্জন করেন।
১৯৭৫-এ জেল থেকে মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এ সময় তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়।
আল মাহমুদ একই সাথে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক কর্ণফুলীর সম্পাদক এবং দৈনিক সংগ্রামের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছে। দৈনিক সংগ্রামে বখতিয়ার নামে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তবে কবির জীবনে রাজ কবি হিসেবে একমাত্র আল মাহমুদই ছিলেন ব্যতিক্রম। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের আশীর্বাদ পেয়েছেন। সবাই তাকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। বাংলাদেশের কোনো কবির জীবনে এ ধরনের সম্মানের মুকুট পরা সম্ভব হয়নি আর হবে কিনা, সেটাও বলা মুশকিল। ভালো থাকুন কবি আল মাহমুদ, ভালো থাকবেন সাংবাদিক আল মাহমুদ।
লেখক : কবি।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’ ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে
- ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’র বহুল প্রচার উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করছি
- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
- সাংবাদিকতার সর্বজনীনতা ও সংবাদমাধ্যমের প্রভাব
- আত্মার বোধ ও বিশ্বাস
- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর সাংবাদিক জীবন
- অনুভূতি
- কেউ ভালো নেই
- ফজলুল হক তুহিন-এর দুটি কবিতা
- সাপ্তাহিক সোনার বাংলার ৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : আগামী দিনের করণীয়
- সাংবাদিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম
- অপরাধ দমনে সংবাদমাধ্যম
- ইসলামী ধারার রাজনীতির বিকাশ ও সোনার বাংলার ভূমিকা
- আর নয় আত্মহত্যা : আল কুরআনে আছে শান্তির বারতা
- প্রচার, অপপ্রচার ও সংবাদমাধ্যম