রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৯ মাচ ২০২৪

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
কালের পরিক্রমায় বিশ্বে রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক বিকশিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আধুনিক বিশ্বে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র অস্বীকার করে বা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রও সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে চলতে পারে না। যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, অর্থাৎ তাদের মতামতকে গ্রহণ করা হচ্ছে না। যেসব রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের মতামতকে গ্রহণ করছে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেসব রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারছে না বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারছে না। তাকে বাধ্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রের সব আইন; এমনকি কালাকানুনও মানতে হচ্ছে। বিশ্বের অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোই সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে তাদের রাষ্ট্রের কঠিন নিগড়ে বন্দি করছে। বিশ্বে এমন অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা এখনো নেহায়েত কম নয়।
বিশ্বে রাষ্ট্র ও সমাজের যেমন বিকাশ ঘটেছে, তেমনিভাবে সাধারণ মানুষেরও পেশা, বৃত্তি ও শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। একটা সময় সারা বিশ্বেই এক-দুটি পেশানির্ভর ছিল; যেমন কৃষি ও পশুপাখি শিকার। এ করেই তারা তাদের জীবনধারণ করতো। তারপর বিশ্বচরাচরে ক্রমান্বয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারিগরি পেশার বিকাশ ঘটতে থাকে। এভাবে আধুনিক বিশ্বে কারিগরি ও প্রকৌশল পেশার পাশাপাশি বেশকিছু বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার উদ্ভাবন হয়েছে। যেমন সাংবাদিকতা, সাহিত্য রচনা, দর্শনশাস্ত্র, আইন, হিসাববিদ্যা, আইটি ইত্যাদি পেশা। তবে কালক্রমে বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় সর্বজনস্বীকৃত যে, আধুনিক বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী পাঁচটি পেশা হচ্ছে সরকার ও প্রশাসন পরিচালনা তথা আমলাতন্ত্র, আইন, চিকিৎসা, শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা।
সৃষ্টির শুরু থেকে প্রাগৈতিহাসিককাল পেরিয়ে আধুনিক যুগ ও উত্তর আধুনিক যুগে এসে ক্রমান্বয়ে উল্লেখিত শ্রেণি ও পেশার উদ্ভাবন ও বিকাশ হয়েছে। একসময়ের কৃষি ও কৃষকের পেশাকে ভিত্তি করে শুরু হয়েছে কৃষি গবেষণা ও কৃষিবিদ, কাপড় বোনার তাঁত ও তাঁতিদের কাজের আধুনিক উদ্ভাবন হচ্ছে বস্ত্র প্রকৌশল ও বস্ত্র প্রকৌশলী, তেমনিভাবে একসময়ের জেলে ও জেলেদের মাছ ধরা নিয়ে মৎস্য গবেষণা ও মৎস্যবিদ একটি পেশা হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে। সমাজ ও সাধারণ জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশার প্রয়োজনে এভাবে অনেক পেশা, কাজ ও শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে।
বর্তমান বিশ্বে অসংখ্য পেশা, বৃত্তি ও কাজ যেমন রয়েছে, তেমনি এসব শ্রেণির মানুষ ও পেশাজীবীদের কাজের ধরন ও ভিন্নতা রয়েছে। প্রতিটি পেশাই মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কোনো পেশাকেই বাদ দেয়া বা ইগনোর করার সুযোগ নেই। কিছু পেশা রয়েছে, যাদের পেশা ও কাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানে ও তাদের সাথে সম্পৃক্ত আর কিছু বিশেষায়িত পেশা আছে, যেগুলোর সাথে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত নয়, তবে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সাথে জড়িত। আবার কিছু পেশা রয়েছে, যেসব পেশার সাথে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষসহ রাষ্ট্র ও সরকারও সম্পৃক্ত। আর এ বিভিন্ন পেশা ও কাজের বিভিন্ন ধরন যেমন রয়েছে, তেমনি এসব পেশা ও বৃত্তির কর্মপরিধি নির্ধারিত রয়েছে। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ তার শ্রেণিকক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তেমনিভাবে আইনজীবীর পেশার কর্মপরিধি আদালত, আদালতের অভ্যন্তরে ও তার মক্কেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আইটি বিশেজ্ঞদের কাজও তাদের পরিমণ্ডলেই। একজন চিকিৎসক মানুষের দৈহিক রোগ সারাতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন, তবে তার কাজের মূল ফোকাস ও কাজের পরিধি হচ্ছে একজন রোগী, তার চেম্বার বা অপারেশন থিয়েটর। এমনিভাবে প্রতিটি পেশা ও বৃত্তির কর্মকাণ্ডের পরিমণ্ডল রয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের প্রাত্যহিক কাজ তাদের ক্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তেমনিভাবে একজন আমলার অধিকাংশ কাজই তার অফিসের মধ্যেই, একজন ব্যাংকারের কাজ তার ব্যাংকের মধ্যে এবং শুধুমাত্র অর্থ ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। একবাক্যে বলা যায়, কোনো কোনো পেশা হচ্ছে মাইক্রো লেভেলে তথা ব্যাষ্টিক পর্যায়ে আর কোনো পেশা হচ্ছে ম্যাক্রো লেভেলে অর্থাৎ সামষ্টিক পর্যায়ে। বর্তমান বিশ্বের অনেক পেশাই মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেগুলো হচ্ছে মাইক্রো লেভেলের পেশা; অপরদিকে সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি ম্যাক্রো লেভেলের তথা সর্বজনীন পেশা।
আরো বিস্তৃতভাবে বললে সাংবাদিকতা পেশার কাজ শুধু তার কর্মস্থলের মধ্যেই আবর্তিত থাকে না। তার কাজ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায় এবং প্রতিদিনই সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ তা প্রত্যক্ষ করে এবং প্রভাবিত হয়। আর সেটা হচ্ছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা পেশা। সাংবাদিকতা পেশায় সাংবাদিকরা প্রতিদিন কী কাজ করে- আমরা যদি তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করি, তাহলে কী পাই। সাংবাদিকতা পেশার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা সংবাদ আকারে তৈরি করা, ঘটনা ও বিষয়ের বিশ্লেষণ করা, মতামত প্রদান করে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা। সংবাদ তৈরি ও প্রকাশের পাশাপাশি সাংবাদিকরা রাষ্ট্র, সরকার, দেশ ও জাতির সার্বিক বিষয়ে বিভিন্ন রকমের রিপোর্ট, অনুসন্ধানী রিপোর্ট, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, মতামত কলাম লিখে সাধারণ জনগণকে অবহিত করে। একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যখন ঘটে, তার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ শুধু পত্রিকার রিপোর্টার তথা সাংবাদিকরাই সংগ্রহ করে না, তার তথ্য ও উপাত্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাও সংগ্রহ করে। সাংবাদিকের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ এবং অন্যদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তা হচ্ছে অন্যরা ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তার রিপোর্ট আকারে তার সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়ে থাকে এবং এ ধরনের রিপোর্টটা গোপনীয় থাকে। অপরদিকে সাংবাদিকরা ঘটনার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে তার অফিসে জমা দিয়ে থাকে বাক্সবন্দি করে রাখার জন্য নয়, বরং সেই তথ্য-উপাত্ত সংবাদপত্র অফিসে বাক্সবন্দি করে রাখা হয় না, বরং তা তাৎক্ষণিক প্রকাশ করে প্রচার করা হয়ে থাকে। এমনিভাবে প্রতিদিন প্রতিটি সংবাদপত্রে সাংবাদিকের তৈরি করা খবর, মন্তব্য প্রতিবেদন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, নিবন্ধ, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ, সম্পাদকীয় নিবন্ধ ও কলাম প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এভাবে সাংবাদিকদের কর্মতৎপরতা যেমন দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে দেখা ও জানার সুযোগ হয়, তেমনিভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের কর্ণধাররাও জানেন, দেখেন ও অবহিত হন।
একটি সংবাদপত্র শুধু সংবাদপত্র পেশার সাংবাদিকরাই পড়েন না। একটি সংবাদপত্র যেমন সাধারণ মানুষ পড়েন, তেমনিভাবে ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, দোকানদার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারের সাধারণ কর্মচারী থেকে সিনিয়র আমলা, পুলিশ কনস্টেবল থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শক, সিপাহি থেকে সেনা অফিসার, সেনাপ্রধান, আইনজীবী থেকে বিচারপতি, রাজনৈতিক কর্মী থেকে রাজনীতিক, মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট সবাই সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকদের প্রতিদিনের কাজ তথা খবর দেখেন, শুনেন, পড়েন, তার প্রতিদিনের মতামত কলাম পড়েন এবং অনুধাবন করেন। আর এ পড়া ও অনুধাবনের মাধ্যমে তারা যেমন দেশ ও জাতির সার্বিক অবস্থা জানাতে পারেন, তেমনিভাবে প্রভাবিতও হয়ে থাকেন। সংবাদমাধ্যম ওপর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণকে তথ্য প্রদান, শিক্ষাদান, বিনোদন ও প্রভাবিতকরণ এ মৌলিক দায়িত্ব পালন করে। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম শুধু তথ্য প্রদানই করে না, এটি জাতিকে শিক্ষাদানের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে প্রভাবিতও করে থাকে।
এ পর্যায়ে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির তথা গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোট ও বিরোধীদলের রাজনীতি করা নিয়ে যৎকিঞ্চিত পর্যালোচনা করতে চাই। বর্তমানে আমরা কী দেখতে পাই। বিশেষ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র তথা গণতন্ত্রের চর্চা কোন অবস্থায়, নির্বাচন ও ভোট এবং নির্বাচনে বিরোধীদলের অংশগ্রহণ, সাধারণ জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ, জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠন। এসবের কোনোটার উত্তর ইতিবাচক নয়। ভোটারবিহীন নির্বাচনে জাতীয় সংসদে প্রকৃত বিরোধীদলের অনুপস্থিতির কারণে দেশে একটি একদলীয় সরকারই ক্ষমতাসীন।
এমনি একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বর্তমানে চলছে গণতন্ত্রের লেবাসে এক অগণতান্ত্রিক শাসন। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সুশাসন নেই, বাকস্বাধীনতা নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই, তাই চলছে অবাধ দুর্নীতি, সুষম উন্নয়ন নেই বিধায় দেশের চার-পাঁচ কোটি মানুষ চরম অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে। একটি দেশের সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করে জনগণের প্রকৃত উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্র, বিরোধীদল, নির্বাচন ও ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পরস্পরের সাথে জড়িত। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক বিশ্বের একটি দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সুশাসন, উন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আর এ চরম অবস্থা তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনের অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। বিরোধীদলগুলো এ একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাচ্ছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল তা পাত্তাই দিচ্ছে না। সরকারের একগুঁয়েমির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক গভীর সংকট চলছে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারাসহ সাধারণ জনগণ এ রাজনৈতিক সংকট থেকে দেশ মুক্তি পাক, তা মনেপ্রাণে চায়। তবে রাজনৈতিক সংকট থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষপর্যায়ের ওপর। তবে ক্ষমতাসীন দল হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবে বিরোধীদলগুলো থেকে শুরু করে বন্ধুপ্রতিম গণতান্ত্রিক দেশ এবং দেশি-বিদেশি সুশীল সমাজ থেকে সরকারের ওপর প্রবল চাপ আছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে।
একটি দেশে যখন একদলীয় শাসন চলে, এটার একটি মেসেজ যায় এবং থাকে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রশাসন ও বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার কাছে। তারা তখন তাদের প্রাত্যহিক কাজ ও কর্মসূচির জন্য সেভাবেই চিন্তা করে এবং পলিসি করে চলে। বলা যায় সরকারের শক্ত অবস্থানের সাথে তাল মিলিয়েই রাষ্ট্র ও সরকারের প্রশাসনের আমলা থেকে শুরু করে সব বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তারা কাজ করে। বাংলাদেশেও এমন একটা পরিস্থিতি চলছে। তবে কোনো দেশেই সরকারের শক্ত ও দুর্বল অবস্থানটা সবসময় তারা বুঝতে পারেন না এবং খালি চোখে দেখাও যায় না এবং বোঝাও যায় না। কোনো কারণে যদি সরকারে দুর্বল অবস্থানটা প্রচার হয়ে যায়, তখনই একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন শুরু হয়ে যায়। যেটা ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের আগে যখন জানা গেল, সেনাবাহিনী আর স্বৈরাচারের সাথে নেই, তখনই প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই নিরপেক্ষ অবস্থায় চলে যায় এবং সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। আর এ দুর্বল অবস্থানটা প্রচার ও প্রকাশের কাজটা করে থাকে সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যমগুলো। এমনিভাবে এরশাদের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী এক প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশ্যে জেরে। বিশে^র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে তার মেয়াদ পূর্তির আগেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। এটা ছিল ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাসে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বহুল আলোচিত ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের একটি হোটেলের নাম ওয়াটারগেট। সেখানে ডেমোক্র্যাট পার্টির কার্যালয় ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ জুন রাত থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ওয়াটারগেট হোটেল এবং অফিস কমপ্লেক্সে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির সদর দপ্তরে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে আড়ি পাতার যন্ত্র উদ্ধার করা হয়।
পরের দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট তার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় এক কেলেঙ্কারির খবর ছাপা হয়। এ খবর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পুনর্র্নির্বাচনের প্রচারণায় বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করেন দুই তরুণ স্টাফ রিপোর্টার বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইন। তারা তুলে ধরেন আড়ি পাতার পেছনে নিক্সনের পুনর্র্নির্বাচন কমিটির সদস্য এবং সিআইএর সাবেক সদস্য জেমস ম্যাককর্ডের নাম।
তরুণ সাংবাদিকরা দাবি করেন, এ ঘটনায় হোয়াইট হাউসের হাত রয়েছে। তবে ২২ জুন নিক্সন তা অস্বীকার করেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। দুই সাংবাদিকের প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক নজরদারি এবং নোংরা প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হয়। পরিণামে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭৪ সালে অভিশংসনের মুখোমুখি হন।
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তখন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার নির্বাচন কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিক পার্টির খবর পেতে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত দলটির সদর দপ্তরে গোপনে টেপ রেকর্ডার স্থাপন করেছিলেন। ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার পর হোয়াইট হাউসের কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন এবং একজনকে বরখাস্ত করা হয়। পরে ওই বছরের ৬ নভেম্বর নিক্সন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে চাপের মুখে কিছু টেপ প্রকাশ করেন নিক্সন। জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে টেপগুলো হস্তান্তর করেন নিক্সন। স্বীকার করেন, আড়িপাতা সম্পর্কে জানতেন তিনি। এফবিআইয়ের তদন্তে বাধা দিয়েছিলেন। আগস্ট নাগাদ জনমত চলে যায় বিপক্ষে। শুরু হয় সাংবিধানিক সংকট। কংগ্রেসের একটা বড় অংশ চলে যায় নিক্সনের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় কংগ্রেসে অভিসংশন শুনানি এড়াতে ১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি এবং পদত্যাগ করেন। এ কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশের কারণেই মার্কিন জনমত নিক্সনের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হয়।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনাটি যদি ওয়াশিংটন পোস্ট নামক একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় প্রকাশিত না হতো তাহলে প্রবল জনমত তৈরিও হতো না আর নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হতো না। এটাই সংবাদপত্রের খবরের প্রভাবের মাধ্যমে জনমত তৈরির জলন্ত উদাহরণ।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার ১৫ বছর পর এবারও একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করেছে। নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার দেখালেও প্রকৃতপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগও ভোট পড়েনি। তাই বিভিন্ন কায়দায় সরকার গঠন করলেও এবং আইনগত বৈধতা দেখালেও এ ধরনের সরকারের লেজিটিমেট হয় না। এককথায় বলা যায় এ ধরনের সরকার আইনগত দিক থেকে বৈধ হলেও নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাই এ ধরনের সরকার সবসময়ই দুর্বল থাকে। সরকার সবসময়ই একটা ভয়ে থাকে কোন সময় ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। তাই সরকারের শীর্ষমহল থেকে প্রায় বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের বক্তব্য তখনই দেয়া হয়, যখন কোনো সরকার দুর্বল থাকে।
তবে সরকারের পদত্যাগ বা ক্ষমতাচ্যুত না হলেও রাজনৈতিক ময়দানে একটি বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে, সেটা হচ্ছে একটি মধ্যমেয়াদি নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার স্টেকহোল্ডারদের পক্ষ থেকে মধ্যমেয়াদি একটি নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়াজ হয়েছে। বিশেষ করে আটলান্টিকের ওপারের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র একটি মধ্যমেয়াদি নির্বাচনের ব্যাপারে, সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে একটি সংলাপ করার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। যদি কোনো কারণে সরকারের বোধোদয় হয় এবং শীর্ষমহল মধ্যমেয়াদি নির্বাচন করার ব্যাপারে ন্যূনতম একমত পোষণ করেন। আর এটা যদি কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্টারের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে সরকার একটি মধ্যমেয়াদি নির্বাচন করার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে, তাহলে এ খবরের একটি ব্যাপক প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক ময়দান থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের মধ্যে। তার প্রভাব রাষ্ট্র ও সরকারের সব বিভাগ ও সংস্থাগুলোর ওপরও পড়বে, যারা সরকারের সাথে তাল মিলিয়েই প্রশাসন চালায়। এ ধরনের ছোট একটি বাক্যের এক লাইনের খবর কিন্তু পুরো দেশ ও জাতির মধ্যে একটি যুগান্তকারী প্রভাব ফেলবে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পারেন সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যম।
সাংবাদিকের খবর প্রকাশ যেমন রাষ্ট্র, সরকার দেশ ও জাতিকে প্রভাবিত করে, তেমনিভাবে সাংবাদিকের মতামত কলামও রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে মন্ত্রীবর্গ, রাজনীতিবিদ, আমলা, সামরিক আমলা, বিচারক, আইনজীবী, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণকে প্রভাবিত করে। এভাবে সাংবাদিকের কলাম জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এককথায় সাংবাদিকতার সর্বজনীনতা মানেই হলো দলমত-নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল ও কল্যাণকর কাজ ও দায়িত্ব পালন করা।
তাই বিশ্বের তাবৎ শাসকরাই ক্ষমতা অর্জন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বের আলোাচিত ও সমালোচিত স্বৈরশাসক হিটলার তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন।
হিটলারের শাসনক্ষমতার এ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি ছিল পঞ্চতন্ত্র, তা হচ্ছে- এক. শোষণ, দুই. সামরিক বাহিনী, তিন. সংবাদমাধ্যম, চার. বিচার বিভাগ, পাঁচ. ধর্মকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। তবে তিনি পাঁচটি কাজের মধ্যে দুটির ওপর জোর দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সংবাদমাধ্যম ও ধর্মকে সম্পূর্ণভবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
 বিশ্বের অনেক স্বৈরাচারই হিটলারের এ তত্ত্ব প্রয়োগ করেই ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে তারা বিশেষ জোর দিচ্ছে। আরেক গবেষক জিম মরিসন বলেছেন, ‘যে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে, সে জাতির মানসকে নিয়ন্ত্রণ করে।’ আর জাতির মানসকে ভিত্তি করেই জাতীয় সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়ে থাকে।
নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন সংবাদপত্রের প্রভাব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র রয়েছে, সেখানে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় কম। যেখানে গণতন্ত্র নেই এবং স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, সেখানে অনাহারে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন ভারত ও চীনের। স্বাধীন ভারতের কোথাও যখনই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় সরকার অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। তাতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং প্রাণহানি ঘটেছে কম। চীনের বহু অঞ্চলে একসময় দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে, স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকায় সেই মৃত্যুর কথা বাইরের মানুষ জানতে পারেনি। সরকার ব্যবস্থা নেয়নি।
বিশ্বনন্দিত মিডিয়া বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান গণমাধ্যমকে মানুষের চোখ এবং কানের সম্প্রসারণ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর ফলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও মানুষ ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। মানুষের জানা-বোঝার পরিধি বিস্তৃত হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তথ্যশাসিত দুনিয়ার গণমাধ্যম এক বিপুল সম্ভাবনা, যাকে মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য ব্যবহার করার অপরিসীম সুযোগ মানবপ্রজাতির হাতে সর্বদাই থেকে যায়।
সংবাদপত্রের গ্রাহক ও পাঠকরা কিন্তু সমাজের অগ্রসর অংশ, যারা রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। তারাই রাষ্ট্র ও সরকারে পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। একটি দেশের অগ্রসর অংশ যখন সংবাদপত্রে দেশ ও জাতির বিভিন্ন খবর পড়েন, তখন তারা এ খবর দ্বারা প্রভাবিত হন এবং জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটান। সংবাদপত্র শুধু খবরই প্রকাশ করে না, তারা খবর প্রকাশের পাশাপাশি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত দিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও কলাম লিখে থাকেন। এসব নিবন্ধ ও কলাম জাতির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন পড়ে থাকেন, তেমনিভাবে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল কর্তারাও পড়েন। বিশে^র বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক জাতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি বিষয় বলা হয়ে থাকে যে, দৈনিক আজাদ সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান আর দৈনিক ইত্তেফাক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। এ দুটি উদাহরণ থেকে বলা যায়, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রভাবে শুধু জাতীয় সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় না, দেশ ভাগ ও নুতন স্বাধীন দেশেরও জন্ম হয়। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম একটি দেশে রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব সৃষ্টি করে কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।



এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।