তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব থামেনি
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:০০
# আরও সংঘর্ষের আশংকা
# সাদপন্থিদের নিষিদ্ধের দাবি
স্টাফ রিপোর্টার : তাবলিগ জামাতের জুবায়ের ও সাদপন্থিদের চলমান দ্বন্দ্ব এখনো থামেনি। বিরোধ থেকে দ্বন্দ্ব এবং পরবর্তীতে সংঘাতে রূপ নিয়ে ঘটে প্রাণহানিও। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গেল। এতে ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। এর আগে ২০১৮ সালে উভয়পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত ও পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। তখন তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মার্কাজ ঢাকার কাকরাইল মসজিদের দখল ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মূলত ২০১৭ সাল থেকে প্রতি মাসেই দুবার পালাক্রমে দুই পক্ষের মধ্যে দখল বেদখল চলছিল। সর্বশেষ টঙ্গীতে তাদের ইজতেমাকে কেন্দ্র করে গত কিছুদিন ধরেই সড়ক অবরোধ, পরবর্তীতে ঘুমন্ত মুসল্লিদের ওপর নির্মম হামলা চালিয়ে চারজনের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। এজন্য সাদপন্থিরা দায়ী বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা। এছাড়া কাকরাইল মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পক্ষ-বিপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি চলছে। এসব কর্মসূচি থেকে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। টঙ্গীতে সংঘাতের পর উভয়পক্ষ সংবাদ সম্মেলন ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাবলিগের সাদপন্থিদের ভেতরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ঢুকে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে দাবি জুবায়েরপন্থিদের। উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে নতুন করে আরও সংঘাতের আশঙ্কা করছেনঅভিজ্ঞমহল।
‘সাদপন্থিরা সন্ত্রাসী-চরমপন্থি’, দাবি জুবায়েরপন্থিদের
তাবলিগ জামাতের সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি বাহিনী বলে মন্তব্য করেছেন তাবলিগ জামাতের নেতা মুফতি কেফায়তুল্লাহ আজহারী। গত ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে কাকরাইল মসজিদে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি। সম্প্রতি টঙ্গীতে সাদপন্থিদের নৃশংস হামলা ও তাবলিগ জামাতের চলমান সমস্যা নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্ব বিগত বছরগুলোয় শূরাই নিজামের ওপর পরিপূর্ণরূপে ন্যস্ত ছিল। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয়, গত ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমার জন্য মাঠ প্রস্তুতি ও মাঠের পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত তাবলিগ জামাতের সাথী ও মাঠে অবস্থিত মাদরাসার কোমলমতি শিশু এবং তাদের শিক্ষকদের ওপর বিনাকারণে সাদপন্থিরা বর্বরোচিত ও পৈশাচিক হামলা চালায়। রামদা, কিরিচ, ছুরি, লোহার রডের মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘুমন্ত ও নামাজরত নিরীহ-নিরস্ত্র তাবলিগ জামাতের সাথীদের ওপর অতর্কিতে হামলা করা হয়। ইতিহাসের এ বর্বরোচিত হামলায় নেজামের চারজন সাথী নিহত এবং শত শত সাথী মারাত্মকভাবে আহত হন। সাদপন্থিরা এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসারত আহতদের ওপরও হামলা চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি। তিনি আরো বলেন, সাদপন্থিরা একই কায়দায় গত ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরেও একতরফা আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৫ হাজারের মতো তাবলিগ জামাতের সাথী ও ছাত্র শিক্ষকদের রক্তাক্ত করে। এতেই প্রমাণিত হয়, সাদপন্থিরা তাবলিগ নয়, বরং তারা সন্ত্রাসী, চরমপন্থি বাহিনী। যারা গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তাদের মূল হোতাসহ অনেকের নামে মামলা হয়েছে। কিন্তু আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। কেফায়তুল্লাহ বলেন, ১৭ তারিখের রাতে টঙ্গির মাঠের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। অবস্থার দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ও তাদের দোসররা যোগসাজশ করে সাদপন্থিদের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি নীলনকশা তৈরি করেছিল। তাদের এ নীলনকশা বাস্তবায়নে পার্শ্ববর্তী একটি দেশ ও ইসরাইলের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে কিছু জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনটি দাবি জানানো হয়। ১. সাদপন্থিদের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ২. ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতের হত্যাযজ্ঞ এবং ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর হামলার সঙ্গে জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ৩. কাকরাইল মারকাজ ও টঙ্গী ইজতেমার মাঠসহ তাবলিগের সব কার্যক্রম শূরাই নিজামের অধীনে পরিচালিত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
মুয়াজ বিন নূরের মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি সাদপন্থিদের
তাবলিগের সাদপন্থি নেতা মুয়াজ বিন নূরের নিঃশর্ত মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠে সংঘর্ষের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও করা হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করেন সাদপন্থি পক্ষের মাওলানা শফিক বিন নাঈম। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৮ ডিসেম্বর টঙ্গীর ময়দানে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য আমরা মর্মাহত। সংবাদ সম্মেলন থেকে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন তিনি। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের নামে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, মুফতি মুয়াজ বিন নূরকে দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে, সারা দেশে মসজিদভিত্তিক তাবলিগের কাজকে সমান অধিকারের ভিত্তিতে পরিচালনার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, তাবলিগের যেকোনো বিষয়ে হেফাজত বা জুবায়েরপন্থি- এমন এক পক্ষের ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিহার করতে হবে, সঠিক সময়ে কাকরাইল মসজিদ এবং টঙ্গী ইজতেমা ময়দান বুঝিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করার সব কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে, নিজামুদ্দীনের অনুসারীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তাবলিগের উভয়পক্ষকে নিয়ে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সাদপন্থিদের নিষিদ্ধে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি
সম্প্রতি টঙ্গি ইজতেমা ময়দানে গভীর রাতে উগ্র সন্ত্রাসী সাদপন্থিদের হামলায় ৪ জন শহীদ, অসংখ্য আহত ও নিখোঁজের প্রতিবাদ এবং হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তিসহ নিষিদ্ধের দাবিতে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর সকালে দোয়ারাবাজারে সর্বস্থরের ওলামায়ে কেরাম ও তাওহীদি জনতার মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, বর্তমান সরকারকে বিতর্কিত করার পতিত স্বৈরাচারের যে ষড়যন্ত্র তারই অংশ হিসেবে তাবলিগ জামাতের ওপর নগ্ন হামলা এবং তাবলিগের দাওয়াত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভারত ও ইসরাইলপন্থি মাওলানা সাদ দীর্ঘদিন যাবত তাবলিগের দাওয়াতের কাজকে বিতর্কিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ধৈর্যের মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছে। এ সময় বক্তারা সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
এদিকে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গভীর রাতে ঘুমন্ত তাবলিগ জামাতের ওপর হামলাকারী খুনি সাদপন্থিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবিতে মানববন্ধন করেছে পেকুয়া উপজেলা তাবলিগ জামাত। ২৪ ডিসেম্বর সকালে পেকুয়া চৌমুহনী কলেজ গেট চত্বরে তাবলিগ জামাত ও তাওহিদী জনতার উদ্যোগে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
দুই পর্বের ইজতেমা বহালে লিগ্যাল নোটিশ
তাবলিগ জামাতের দুই পর্বের ইজতেমা বহালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর অরাজনৈতিক সংগঠন আল-কুরআন স্টাডি সেন্টার সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষে আইনজীবী আশরাফ উজ-জামান ও অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। নোটিশে বিবদমান সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ও উভয় পক্ষের (জুবায়ের ও সাদ) পাঁচজন করে ব্যক্তিকে রাখার জন্য বলা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে তাবলিগ জামাতের চলমান এ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনায় সবাই আতঙ্কিত। ঘটনা যেভাবে চলমান তাতে মনে হয় ভবিষ্যতে আরও সংঘাত ও রক্তাক্ত ঘটনা ঘটতে পারে। মসজিদের পরিবেশ আরও কলুষিত হতে পারে। তাই সুপ্রিম কোর্টের আল-কুরআন স্টাডি সেন্টার তাওহিদী জনতাকে এমন ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর এবং এ মুহূর্তে তাদের সাহায্যে সরকারের এগিয়ে আসা ও সমস্যা নিরসনে বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছে তারা।