ঘটনাবহুল নভেম্বর ও প্রতিবিপ্লবের প্রতিধ্বনি
৮ নভেম্বর ২০২৪ ০০:৫৪
॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। ঐতিহাসিকরা এ মাসকে বলেন ‘ঘটনাবহুল নভেম্বর।’ অবশ্য বিশেষ একটি বছরের সেই নভেম্বর। ইতিহাস সচেতন সবাই জানেন, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল মাস। কারণ নব্য-স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে ঐ বছরের ১৫ আগস্ট জনগণ ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন ঘটায়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে- কী সেই বিশ্বাসঘাতকতা? এ প্রশ্নের উত্তর প্রবীণদের কারো অজানা নয়, কিশোর-তরুণরাও অনেকে জানেন। তারপরও একটু স্মরণ করিয়ে দেয়া, কারণ মানুষ সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই ভুলে যায়। যেমন- ১২শ’ টাকা কেজি কাঁচামরিচ, সাড়ে তিনশত টাকা কেজি পেঁয়াজ এবং পেঁয়াজের বদলে আপেল খাওয়ার পরামর্শ ও শেখ হাসিনার দেয়া পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি অনেকেরই মনে নেই। এ কথা মনে করিয়ে দেয়ার পরও বলছি, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। দ্রব্যমূল্য আরও কমাতে হবে। এবার সেই প্রশ্নের উত্তরপর্বে আসা যাক। এ প্রসঙ্গেও বিস্তারিত নয়, মাত্র তিনটি প্রসঙ্গ তুলে ধরব, শুধু সূত্রটি মনে করিয়ে দিতে। ১. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিলে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের অনুমোদন দিতেন কি? ২. মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে জাতিকে দেয়া অঙ্গীকারÑ ক. সাম্য (সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বণ্টন), খ. মানবিক মর্যাদা ও গ. সামাজিক ন্যায়বিচার। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ নামে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত এ অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শুরু হয় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ‘হেলিকপ্টারে ব্যালট ছিনতাইয়ের কুখ্যাত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই। এরপর সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বণ্টনের বদলে চলে ক্ষমতাসীনদের লুটপাট, কালোবাজারি ও অর্থ পাচার, যার ফলে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে, রোগে-শোকে মৃত্যুবরণ করেছিল। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’র কফিনে শেষ পেরেক লাগিয়েছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলের কারণে মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতা দখলের আগে গণতন্ত্র গণতন্ত্র জিকির করে জ্ঞান হারানো নেতা ক্ষমতা দখলের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বাকস্বাধীনতা হরণের কারণে ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাতি লাভ করেছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সবগুলোর প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে বিরোধীদলের ৩০ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা ও গুম করে দেশকে পরিণত করেছিলেন বধ্যভূমিতে। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তুলে দিয়েছিলেন আগ্রাসী ভারতের হাতে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে সীমান্ত ছিল অরক্ষিত। নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) আবদুল জলিলের ভাষায়, ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা।’ সেই পরাধীনতার জিঞ্জির ভাঙতেই সেনাবাহিনীর একদল অকুতোভয় সদস্য (যারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গুলি ছাড়া ট্যাঙ্ক দিয়ে উৎখাত করেছিলেন নব্য-দেশের প্রথম ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ মুজিবকে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর দোসররা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়, ঘটনাবহুল নভেম্বরে প্রকাশিত হতে শুরু হয় তাদের ভয়াবহ নগ্নরূপ।
কী সেই ভয়াবহ রূপ
সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত সেই ঘটনাপ্রবাহের জন্যই নভেম্বরকে ঐতিহাসিকরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ভয়াবহ এবং দুঃসাহসিক সংগ্রামমুখর বলে উল্লেখ করেছেন।
সত্যি! হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি দল ফ্যাসিবাদের পক্ষে ভারতীয় আগ্রাসী শক্তির উসকানিতে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিল। এ ঘটনায় দেশের সাধারণ জনগণ ও সিপাহিদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে; বিশেষত সিপাহিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত হন জিয়াউর রহমান।
৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার স্বকীয় বিপ্লবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে চক্রান্তকারীরা পরাজিত হয়। ইতিহাসে দেশের সাধারণ জনতা আর সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের এদিনটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনে এদিনকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তারা তাদের পরাজয়ের এদিনটির সাথেও মুক্তিযুদ্ধের ট্যাগ লাগিয়ে প্রচার করেছে ‘৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ বলে। অথচ এ বিপ্লবের নায়েকরা প্রায় সবাই ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, “সিপাহি ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহি-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহিরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহি-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভণ্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। এ আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামেও পৌঁছে যায়।”
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর উঠে এসেছে এভাবে, ‘১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহÑ স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দেশটিতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয়, তারই একটি পরিণতি ছিল এই সাতটি দিনের রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর এর সাথে যুক্ত মেজরদের সাথে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ আ’লীগ নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন। তবে খন্দকার মোশতাক সামনে থাকলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী। সেসময় বাংলাদেশের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন মেজর বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এর তিন মাস পরই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানটি হতে যাচ্ছিল, তার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার এ রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে বেশকিছু ব্যাখ্যা থাকলে সেনাবাহিনীর তৎকালীন অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ফলে হচ্ছে নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনজন অফিসার ব্যাপক পরিচিতি পান। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যুদ্ধের পর থেকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এ তিনজন অফিসারের তিনটি প্রভাব-বলয় তৈরি হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার হোসেন তখন ছিলেন ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের মেজর পদমর্যাদার স্টাফ অফিসার। যে তিনজন সেনা কর্মকর্তার কথা তিনি বলছেন, তারা ছিলেন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ এবং কে এম শফিউল্লাহ।
‘এ দ্বন্দ্বটা আগেও ছিল, কিন্তু সেটা প্রকট হলো ১৫ আগস্টের পর। জেনারেল শফিউল্লাহ মোটামুটি বের হয়ে গেলেন, জেনারেল জিয়া ইন হলেন। আবার জেনারেল জিয়া ইন হওয়ায় তার এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্য দ্বন্দ্বটা আরো বাড়লো।’
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দিন দশেক পর সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, এরপর থেকে তিনি ‘সিনে ছিলেন না’ এবং অনেকটা গৃহবন্দি হিসেবেই সেনাপ্রধানের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহকে খালেদ মোশাররফ এবং জিয়াউর রহমানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের একটি ফলাফল হিসেবে দেখছেন কে এম শফিউল্লাহ- ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে করে খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাকে সরিয়ে দিয়ে হাউস এরেস্টও করে ফেলেছিল এবং নিজেই চিফ অব স্টাফের র্যাঙ্ক পরলো।’ ‘ঐটা শেষ পর্যন্ত সে আর থাকতে পারে নাই এবং সেই ঘটনাটাই লিংগার করে ৭ তারিখে জিয়াউর রহমান তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশাররফের ঐ গ্রুপটাকে সরিয়ে দেয়।’
তিনি বলছিলেন, সিনে না থাকলেও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে একটি উত্তেজনা রয়েছে, সেটি তিনি টের পাচ্ছিলেন এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানটির পটভূমিও ছিল সেখান থেকেই।
৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড : নভেম্বরের ৩ তারিখের প্রথম কয়েকটি প্রহরে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়ার মতো দুটি ঘটনা ঘটে- একটি অভ্যুত্থান এবং ঢাকা কারাগারে একটি হত্যাকাণ্ড। মধ্যরাত পার হওয়ার পরই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবন ঘেরাও করার জন্য যায় একটি ইনফ্রেন্টি ইউনিট, রেডিও স্টেশন দখল করে নেয় আরেকটি সেনাদল।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, বঙ্গভবন ঘিরে তখন এত বেশি সেনা সমাবেশ হয়েছিল যে, ভেতরে থাকা মেজর ডালিম এবং মেজর নুরসহ সেনা কর্মকর্তারা আর পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আর এরই মধ্যে আকাশে যুদ্ধবিমানও উড়তে দেখা যায়। ‘বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে যখন দুটা কি তিনটা ফাইটার জেট উড়ে গেল, তখন তারা বুঝলো যে, তাদের হাতে আর সময় নেই, তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
সেদিন সকাল থেকেই একটি সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। মেজর ডালিম এবং মেজর নূর বেশ কয়েকবার ক্যান্টনমেন্টে এসে খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করেন। দিনভর নানা দেনদরবারের পর সন্ধ্যায় ঠিক হলো তাদের দেশ থেকে চলে যেতে দেয়া হবে। সেদিনই রাতে একটি এয়ারক্রাফটে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে একটি বিমানে থাইল্যান্ডে চলে যেতে দেয়া হয়। এদিকে সেই রাতেই কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে একটি হত্যাকাণ্ড। কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে খুন হন ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান।… সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, ‘ঐ জেলহত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষণিক জানাজানি হয়নি। ঘটনাটি সেনা অফিসারদের কাছে পৌঁছে ৪ নভেম্বর সকালের দিকে।’ বিবিসির প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘৩ নভেম্বরের পরের কয়েকটি দিন কার্যকর দেখা যায়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনীকে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন এ গণবাহিনী পরবর্তী অভ্যুত্থানে একটি মূল ভূমিকা পালন করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও উন্নয়ন গবেষক লেখক ড. মাহবুব উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে পাল্টে দিতে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। কয়েকদিনের জন্য বাংলাদেশ সরকার শূন্য অবস্থায় পড়ে যায়। জনগণ নিমজ্জিত হয় চরম হতাশা ও আতঙ্কে। তারা ভাবতে শুরু করে, দুর্ভিক্ষের দিনগুলো আবার বুঝি ফিরে আসছে। ফিরে আসছে একদলীয় শাসনের দুঃসময়। ফিরে আসছে রুশ-ভারত অক্ষশক্তির তাঁবেদারির যুগ। ফিরে আসছে সংবাদপত্রের শৃঙ্খলিত হওয়ার দিনগুলো। জনগণ ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের পরম আস্থার উৎস সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানকারীদের দ্বারা বন্দি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে এ মানুষটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে হতবিহ্বল জাতির প্রাণে প্রতিরোধের শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। সেই মানুষটিকে যারা বন্দি কিংবা হত্যা করতে পারে, তারা আর যাই হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বন্ধু হতে পারে না। এমনই এক শঙ্কা ও নৈরাশ্যের দুর্যোগে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর বিপ্লবী সৈনিকদের কামানের গোলার গর্জন কুচক্রীদের সব চক্রান্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কুচক্রীরা পালানোর পথ পায়নি। সুবেহ সাদেকের সূর্যালোক উদ্ভাসিত হলে ঢাকার রাজপথে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। ট্রাকে ট্রাকে সৈনিকরা আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ করে তাদের বিজয়ের কথা জানান দিল। সৈনিক ও জনগণ অভূতপূর্ব আনন্দ মিছিলে যোগ দিল। সেনা ট্যাঙ্কে ফুলের মালা পরিয়ে জনগণ সিপাহি বিপ্লবকে অভিনন্দিত করল। রেডিওতে আবার জিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমি জিয়া বলছি।’ জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বুকের ওপর থেকে জগদ্দল পাথর সরে গেল।’
এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেও যেন লেগেছে ৭ নভেম্বরের চেতনার রং। এবার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, ঘৃণাভরে ফ্যাসিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার শপথে এগিয়ে চলছে সংস্কার আন্দোলন। ফ্যাসিবাদের দোসররা ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল এক সাথে কাজ করছে।
তাই বলে শঙ্কা কেটে গেছে, ভাবার অবকাশ নেই। আগ্রাসী ভারতের বুকে বসে ফ্যাসিবাদের রানি হাসিনা একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। নভেম্বর নয়তো ডিসেম্বরে দেশে আসার স্বপ্ন দেখছে। এ যেন ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। তাই ৭ নভেম্বরের চেতনা জাগ্রত রাখতে হবে। প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ থাকবে হবে। এমন নির্দেশনা দিচ্ছেন মূলধারার সকল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
কী সেই নির্দেশনা
প্রতিবিপ্লবের প্রতিধ্বনির জবাব ৭ নভেম্বরের চেতনার মাঝেই লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অটুট থাকলে আজও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর প্রমাণ করেছে সামরিক বাহিনী ও জনগণের ঐক্য অটুট থাকলে কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করা সম্ভব নয়। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের পর্যায়ে ঠেলে দিতে বিশেষ বিশেষ মহল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের অন্যতম একটি কৌশল হলো, সামরিক বাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তাদের ঘৃণ্য লক্ষ্য হাসিল করা। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ তাদের এ অভিসন্ধি কখনোই সফল হতে দেবে না। ৭ নভেম্বরের চেতনা সব ধরনের জাতিঘাতী এবং রাষ্ট্রঘাতী অপকৌশলের বিরুদ্ধে এক শানিত হাতিয়ার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় গ্রহণের তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৭৫ সালের এদিনে সিপাহি-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে রাজপথ মুখরিত করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল।
৭ নভেম্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ না থাকলে আমাদের জাতিসত্তাই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।
সেলিম উদ্দিন বলেন, গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য ও আইনের শাসনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার দেশে একদলীয় শাসন, বাকস্বাধীনতা হরণ এবং দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। ফলে অধিকারবঞ্চিত মানুষ সরকারের অপশাসন-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এমনই এক সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে একটি সফল ও সার্থক বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তাই দেশকে ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র রক্ষায় ৭ নভেম্বরের চেতনায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।