সংবাদ শিরোনামঃ

ভারতের নদী হত্যা অব্যাহত ** সরকার দ্রুত নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে ** সারাদেশে জামায়াতের বিক্ষোভ ** মোদি জিতলে ‘হারবে’ ভারত ** ১৮ দল আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ** বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ; বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য কোনো বিশেষ ধর্ম দায়ী হতে পারে না : সউদী রাষ্ট্রদূত ** বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ ** পহেলা বৈশাখে ‘ফিলদি রিচ’দের তাণ্ডব! ** বাংলা নববর্ষ ** সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ কুষ্টিয়াবাসী ** আত্রাইয়ে ইটভাটায় নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে উৎপাদন, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত ** ক্ষুধার জ্বালায় হনুমানগুলো কাতর **

ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪২১, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৩৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৪

প্রশ্নপত্র ফাঁস : এক নিয়মিত সরকারিব্যবস্থা

সর্বত্র এখন পছন্দের লোক!

॥ আবুল কালাম আজাদ॥
প্রশ্ন ফাঁস! শুনলেই আঁৎকে উঠতে হয়। না জানি কাদের আবার পরীক্ষা পেছাবে। জাতির ভাগ্যে আবার গ্লানির ছাপ লাগানো হবে। সচেতন যে কোনো মানুষের কাছে শব্দ দু’টি গর্হিত ও উৎকণ্ঠারও কারণ। প্রশ্ন ফাঁসের ইতিহাস এ দেশে নতুন নয়, তবে মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যাপারটা যেন বিশেষ কোনো কালচার ও একটি নিয়মিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে, সম্ভবত এই কারণে যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো দূরের কথা কখনো কখনো সরকারিভাবে স্বীকারও করা হয় না যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সর্বশেষ ঘটনাটির খবর পাওয়া যায় গত বৃহস্পতিবার। চলমান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল এদিন। কিন্তু ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এ পরীক্ষাটি স্থগিত করা হয়। বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে অনিবার্য কারণে। এ অনিবার্য কারণটা যে প্রশ্ন ফাঁস, তা পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে একদিন পর এ ব্যাপারে ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তবে এটা যদি লোক দেখানো ব্যাপার হয়, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো সমাধান আদৌ হবে কিনা সন্দেহ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ ঘটনাটি প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রশ্ন ফাঁস না বলে অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। যা সাধারণ মানুষের কাছেও ব্যাপারটি লজ্জাস্কর। হয়তো ধামাচাপা না দিতে পেরেই পরবর্তীতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটি বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বীকার করেছে এবং স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। আমরা জানি, গত বছরের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এরপর ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মেলেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, যেটা পাওয়া গেছে সেটা সাজেশন।

সম্প্রতিকালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গত বছরের নভেম্বরে প্রথামিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়। এই পরীক্ষায় প্রায় সব বিষয়েই প্রশ্নই ফাঁস হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তে দেখা যায়, ইংরেজিতে ৮০ শতাংশ এবং বাংলায় ৫০ শতাংশ প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে। কিন্তু তার পরও পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন প্রণয়ন  প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গোপনীয় ছাপাখানা আধুনিকায়ন করা, চিহ্নিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সন্দেহের তালিকা থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে আইনানুগ শাস্তি প্রদানসহ সাতটি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুপারিশগুলো কার্যত কাগজেই থেকে গেছে। এর আগে ২০১২ সালেও সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তখনো বিষয়টিকে সাজেশান বলে চালিয়ে দেয়া হয়। সেই কমিটি পরীক্ষার জন্য একাধিক সেটে প্রশ্নপত্র ছাপার সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।  ফলে গত বছর প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। ১৭টি জেলায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করা হলেও কারণ উদঘাটন করা হয়নি। প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

এর আগে ২০১০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঐ সময় ফাঁস হওয়া প্রশ্নে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ভিন্ন জগৎ বিনোদন কেন্দ্রে, মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার সময় পুলিশ ১৬৭ জনকে গ্রেফতার করে। পরে তদন্তে এ ঘটনার জন্য বিজি প্রেসের কয়েকজন কর্মচারীকে চিহ্নিত করে। এরপর তদন্ত কমিটি বিজি প্রেসের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য অনেকগুলো সুপারিশ করে। কিন্তু তার সবই ফাইলবন্দী।

২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ চক্রের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা তখন জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৪ ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয় গাজী হাসিব (ম্যানেজমেন্ট) তৎকালীন হল শাখার ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ইলাহী মঞ্জুর (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক), সে ছাত্রলীগ হল শাখার প্রভাবশালী কর্মী। এছাড়া অনুসন্ধানে দেখা গেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মহসীন হলকেন্দ্রিক ২টি, বঙ্গবন্ধু হলকেন্দ্রিক ২টি, শহীদ জিয়া হলকেন্দ্রিক ২টি, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলকেন্দ্রিক ৩টি, শহীদুল্লাহ হলকেন্দ্রিক ২টি, একুশে হলকেন্দ্রিক ২টি, মাস্টার দা সূর্যসেন হলকেন্দ্রিক ২টি সক্রিয় জালিয়াত সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি হওয়া কেন্দ্র হলো ডিজিটাল জালিয়াত চক্রটি ক্যাম্পাসের বাইরের কেন্দ্রগুলোতে বেশি সক্রিয় বাইরের কেন্দ্রগুলোর কিছু শিক্ষক কর্মচারী, ছাত্রলীগ ও কোচিং সেন্টারগুলোও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বোরহান উদ্দীন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ ও তীতুমির কলেজকেন্দ্রিক পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো এই চক্রের মূল টার্গেট।

এদিকে গত মাসে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ঘটনার সঙ্গে  জড়িত থাকার সন্দেহে ৪ জনকে আটক করলেও তাদের ব্যাপারে যথাযথ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাইরের কোচিং সেন্টারের কিছু সক্রিয় কর্মী এর সাথে সক্রিয় রয়েছে।

পিএসসি থেকে বিসিএস পরীক্ষার সকল ক্ষেত্রে জালিয়াতি চক্র সক্রিয় থাকলেও দেশের প্রশাসন অযোগ্য অদক্ষতার কারণেই কোনো প্রতিকার করছে না। তদন্ত হয় সিদ্ধান্ত হয়, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না, ফলে দিনের পর দিন সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে তাদের অপকর্মের জাল বিস্তার করে চলছে।

ব্যর্থতার কয়েকটি দিক

ডিজিটাল আমলে এনালগ কর্মকর্তা : আমরা প্রযুক্তি নির্ভর যুগে বসবাস করছি। বাংলাদেশও শিক্ষা প্রযুক্তিতে যথেষ্ট এগিয়ে। উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। আর সেই সাথে প্রশাসনিক পদে ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি এবং সে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মকর্তাও সেট করেছেন সরকার। কিন্তু ফলাফল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রত্যেকটি কাজে-কর্মে সেই এনালগ পদ্ধতি ও ব্যর্থতার গ্লানিমাখা উচ্চারণ। গত বুধবার ৯ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দফতরে একটি ফ্যাক্স বার্তা আসে।  সেটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, “মূল প্রশ্নের সঙ্গে সবই মিলে গেছে। এরপর পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তবে বোর্ডের চেয়ারম্যান তসলিমা  বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, ফ্যাক্সটি কোত্থেকে এসেছে, তা জানা যায়নি। এটাই হলো আমাদের ডিজিটাল কর্মকর্তার অভিব্যক্তি।

তদন্ত আর দুঃখ প্রকাশেই শেষ : গত পাঁচ/ছয় বছরে প্রত্যেকটি পরীক্ষাই প্রশ্নপত্র কমবেশি ফাঁস হয়েছে। কিন্তু তদন্তও হয়েছে কম নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধী চক্রের সদস্যদের পুলিশে দেয়া হয়েছে, শাস্তি হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অপরাধী হওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অবস্থা। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও একই অবস্থা। শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বোর্ডের চেয়ারম্যানের একই কথা তদন্তে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেই মত প্রকাশ করেই শেষ করেছেন। বড় জোর তদন্ত কমিটি হয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটি শুধুই তদন্ত আর আশ্বাসের বাণীতে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে যাচ্ছে।

বিজি প্রেসের ভূত : বিজি প্রেস একটি নাম! একটি বিস্ময়! গত এক দশকে বারবার এ প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছাপার কাজ এখান থেকে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ছাপার সময় সাথে থাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, সংশ্লিষ্ট বোর্ড অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। তার ছাপার কার্যক্রম চলে এখানে। কিন্তু প্রশ্ন সবার, কিভাবে এতো নিরাপত্তা ভেদ করে কর্মকর্তাদের বেষ্টনী ডিঙ্গিয়ে জালিয়াতি চক্রের হাতে প্রশ্ন যায় কিভাবে? গত ২৪তম বিসিএসের প্রশ্ন একবার ফাঁস হয়, তারপর পরীক্ষা স্থগিত করে। পরবর্তীতে নতুন প্রশ্ন তৈরির পর আবার পরীক্ষা নেয়া হয়, কিন্তু সে প্রশ্নও ফাঁস হয়ে যায়। এরপর একই অবস্থার শিকার হয় ৩৩তম বিসিএস-এ। ৩৩তম বিসিএস-এ মনে হয় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়। মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, যে ৯টি (১ সেট) প্রশ্ন ৪/৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে জালিয়াতি চক্র। এখানেও বিজি প্রেস থেকে দুই দুইবারই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন শুধু ফাঁস হতেই থাকবে আর কর্তাবাবুরা বলবে এবার বিচার করেই ছাড়বো। এ ধারাবাহিকতা আর অব্যাহত  থাকতে দেয়া যাবে না। বিজি প্রেসের ভূতের আবিষ্কার হওয়া দরকার।

রাজনৈতিক আনুকূল্যতা ও অব্যবস্থাপনা : প্রশ্ন ফাঁসের পিছনে রাজনৈতিক আনুকূল্যতা বিশেষভাবে দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যতবারই প্রশ্নফাঁস হয়েছে, ততবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে দেখা গেছে, যারা সক্রিয়ভাবে জালিয়াত চক্রের সাথে জড়িত, তাদের কেউ না কেউ দেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা, প্রেসের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও কোচিং সেন্টারের মালিক বা অন্য কিছু। বিশেষ করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চাইলেও তদন্ত কর্মকর্তাদের রিপোর্ট উপস্থাপন পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়। অপর পক্ষে যাদেরকে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়, তাদেরও অনেক সময় সম্পৃক্ততা থাকায় ব্যবস্থা তো দূরের কথা বাসায় বসে টেবিলওয়ার্কেই সমাপ্তি করা হয় তদন্ত। এমন নোংরা রাজনীতির আনুকূল্যতা ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। এ পদ্ধতির উত্তরণ ঘটাতে পারলে হয়তো ভালো কোনো পথের উন্মোচন হতো।

আইনের চোখ : প্রশ্নফাঁস এক জাতীয় সামাজিক ক্যান্সার ব্যাধি। যার সংক্রমণে একটি জাতির ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। যারা মেধা-মননের বিকাশে আগামী দিনের নেতৃত্বের চাবি হাতে নিবে, তাদেরকে যদি পারিপার্শ্বিক চাপে এমনই এক ব্যাধিতে আক্রান্ত করে পঙ্গুত্ববরণ অথবা নিঃশেষ করার অপকৌশল রাজনৈতিকভাবে করা হয়, তাহলে সে জাতির ভাগ্যে যা হবার তাই হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২ আইনে শাস্তির এই বিধান রয়েছে। আইনটি প্রণয়নের বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় অন্তত ৭০ এর কাছাকাছি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই।

বাংলাদেশে তাহলে আইনের চোখে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনো বিচার হবে না। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে যদি এমন অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতার গ্লানি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম কিভাবে দেশের জন্য জাতির জন্য কিছু করবে! এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে।

পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি : একবার প্রশ্ন ফাঁস হলে শিক্ষার্থীদের কি পরিমাণ ক্ষতির স্বীকার হতে হয়, তা বর্ণনা করা কঠিন। পরীক্ষার আগের সন্ধ্যায় যখন হঠাৎ করে পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয় তখন পরীক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা কী হয়, তা কেবল পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরাই টের পান। পরীক্ষার্থীদের মনে যে হতাশা ও ক্ষোভের অনুভূতি জাগে, তার ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থগিত পরীক্ষাটি কতদিন পরে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা থাকে বলে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের ওপর এমন মানসিক পীড়ন ও হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। পরীক্ষার্থীদের মানসিক হয়রানির চেয়েও বড় কথা হলো প্রশ্ন ফাঁস গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। যার কোনো বিচার বিবেচনা করা ছাড়াই প্রশাসন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যে ব্যাপারে অভিভাবক মহল ভীষণ প্রশ্নবিদ্ধ। হচ্ছেটা কি? তাদের কি কোনো জবাবদিহি নেই? সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হচ্ছে না কেন। এ ক্ষতি কে পূরণ করবে!

সর্বোপরি আরবী সাহিত্যের একটা কথা উল্লেখ করে সমাপ্তি টানতে চাই। কুল্লু সাইয়ূন ইয়ারজিহি ইলা আছলিহী। অর্থাৎ প্রত্যেকটি জিনিস তার গোড়ার দিকে ধাবিত হয়। আকাশের মেঘ গলে বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে আবার সাগর বা নদীতে যেতে চায়। যে জাতের চারা রোপণ করা হয়, সে হিসেবেই একদিন ফলবান গাছে রূাপন্তর হয়, অর্থাৎ জাত হিসেবেই ফল দিয়ে থাকে। বস্তুতঃপক্ষে বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলে যে পদ্ধতিতে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেই পদ্ধতিতে পছন্দের ব্যক্তিদের নির্বাহী চেয়ারে মনোনয়ন দিয়েছে। বিশেষ করে তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি চাওয়া বা পাওয়া আশা করাটাই বোধহয় বোকামী। তাই বলতে হবে প্রশ্ন পত্র ফাঁস । ব্যর্থ সরকার।

এ লেখাটি যখন শেষদিকে, তখন রাজশাহী থেকে খবর এলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের  ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। যা ফটোকপির দোকানে ২০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। রাজশাহী কলেজের দায়িত্বশীল একজন শিক্ষক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে ফোনকরে জানালে তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, না হতে পারে না। পরের দিন সকালে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা গেছে সব প্রশ্ন মিলে গেছে। এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অপকৌশল আর শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে চলতে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। সমাজের বিবেকবান সচেতনরা এগিয়ে এলে হয়তো সমাজ বিধ্বংসী এমন অনৈতিক গর্হিত অপকর্ম হতে সুদিন সুব্যবস্থাপনা বিরাজ করবে। সে কামনা সবার।

লেখক : গবেষক, কলাম লেখক ও কলেজ অধ্যক্ষ

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।