বাবা


৪ জুন ২০২৫ ১২:৪৪

॥ মাহমুদা সিদ্দিকা ॥
বহুদিন ধরে ভাবছি, তোমাকে একটা চিঠি লিখবো। কিন্তু কোথায় লিখবো? ঠিকানা কোথায় পাব?
বাবা তুমি কোন শহরে কোন বাগানে থাকো?
তুমিও কি বসে বসে আমার ছবি আঁকো?
ঠিকানাটা দাও না বাবা, পাখির পায়ে বেঁধে। অনেক কথা জমে আছে বলবো তোমাকে। তুমি ছাড়া আমার এত কথা কে শুনবে বাবা? তোমার মতো করে কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আগলে রাখে না। আমার অন্তরজুড়ে শুধু শূন্যতা বিরাজ করে। বাবা, তোমার অভাব আমি তীব্রভাবে অনুভব করি। মাঝে মাঝে মানুষের কথা শুনে মনটা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। তোমার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। তোমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তোমার আদর পেতে ইচ্ছে করে। অনেক অনেক আদর। সেই ছোট্ট বেলার মতো।
বাবা আমি এখন রাগ করলে কেউ আমার রাগ ভাঙাতে আসে না। তোমার মতো আদর করে কেউ আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয় না।
বাবা তুমি কেমন আছো? অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, তোমার সাথে আমার দেখা হয় না। কথা হয় না।
তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছো ঠিকই। কিন্তু মন থেকে হারাতে দিইনি। দেবও না।
জান বাবা, আজও আমার চোখের সামনে তোমার হাসিমুখ দেখতে পাই। তোমার মনে আছে, তুমি আর আমি আকাশ দেখতে যেতাম বিকেলবেলা। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম দূরের মাঠে। যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে মাটি। সেখানে আকাশ ছুঁতে কতবার গিয়েছি তুমি আর আমি। কিন্তু যেখানেই আকাশ ধরতে গেছি, সেখান থেকেই আকাশ ওপরে উঠে গেছে। আমি আজও আকাশ দেখি বাবা। একা একা। খুব ভোরে ফজরের পরে আকাশের দিকে তাকালেই আমি তোমাকে দেখতে পাই। ধবধবে নীল আকাশে আমি শুধু তোমার ছবি দেখি। তুমি হাসছ! হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছো। বাবা তোমার ওই হাতছানিতে আমি আকুল হয়ে যাই! ইচ্ছে করে ডানা মেলে উড়ে চলে যাই ওই আকাশে, যেখানে তুমি আমি একসঙ্গে উড়ে বেড়াতে পারবো।
কিন্তু বাবা, যখনই মনে হয় আমার তো ডানা নেই, তখনই তীব্র হাহাকারে বুকটা ভেঙে যায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে তপ্ত অশ্রু। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে টপাটপ।
বাবা, তুমি কি জান, সেদিন কী হয়েছিলো?
যেদিন তুমি চিরতরে আমাকে একলা করে চলে গিয়েছিলে না ফেরার দেশে। তোমার কি মনে আছে, আমি নিজ হাতে তোমাকে খিচুড়ি খাইয়ে দিলাম। তারপর তোমার সাথে টুকটাক গল্প করলাম বাইরে পাটিতে বসে। তুমি বললে টয়লেটে যাবে, আমি তোমার হাত ধরে ধরে নিয়ে গেলাম। তারপর মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসায় তুমি তোমার ঘরে চলে যেতে চাইছ বলে আমি ঘরে নিয়ে গেলাম। বিছানায় বসেই তুমি উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লে আর মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তোমার রুহুটা নিয়ে গেল দেহটা রেখে। চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে।
জান বাবা, জ্ঞান ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তোমার নিথর দেহটার কাছে। হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দিলাম। আব্বা আব্বা বলে ডাকলাম, কিন্তু তুমি কোনো সাড়াশব্দ দিলে না। আমার বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। জান বাবা, সারাটা রাত একটু পরপর তোমার কাছে ছুটে গেছি। চলে এলেই মনে হতো, এ বুঝি তুমি জেগে উঠবে আর আমাকে ডাক দিয়ে বলবে কই গো মাহমুদা মামণি এদিকে আসো। কিন্তু না। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তুমি আমাকে ডাকলে না। এত কান্না করেছি, তব্ওু আদর করলে না। চোখের পানি মুছে দিলে না। পরের দিন যখন কাফন পরিয়ে মসজিদের খাটিয়ায় করে নিয়ে গেল স্কুলের মাঠে, তখন আমি পেছনে পেছনে গেলাম। তবু উঠলে না। আমাকে চেয়ে দেখলে না! জান বাবা, তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল! খুব ইচ্ছে করছিল একবার তুমি আমাকে দেখো! হাত ইশারায় কাছে ডাক!
বাবা গো! যখন তোমাকে মসজিদের দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলো কবরে নামানোর আগে, শেষবার গিয়ে তোমার চাঁদ মুখটা দেখে এলাম।
সেই ব্যথা বুকে নিয়ে আজো বেঁচে আছি।
অপেক্ষায় আছি হয়তো পরকালে তোমার সাথে আবার দেখা হবে।