ঈশা খাঁর রাজধানী জঙ্গলবাড়িতে একদিন
১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪৯
ঈশা খাঁর ৪০ কক্ষবিশিষ্ট গোলাকার বাসভবন অন্দরমহলের সম্মুখে বাম থেকে কবি শাহরিয়ার সুমন, খায়রুজ্জামান ভূঁইয়া, দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ ও আবদুল হালীম খাঁ
॥ আবদুল হালীম খাঁ ॥
বাংলার স্বাধীন ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলার সংগ্রামী জীবন ও কর্মের ওপর একটি নতুন ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে বিগত ৬ এপ্রিল ২০২৫ সালে আমরা চার সদস্যের একটি টিম ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন খায়রুজ্জামান ভূঁইয়া, হারুন অর রশীদ এবং তরুণ কবি ও আলোকচিত্র শিল্পী শাহরিয়ার সুমন। একটি মাইক্রো গাড়িতে আমরা ভূঞাপুর থেকে সকাল ৭টায় রওনা হয়ে বেলা সাড়ে এগারোটায় আমরা জঙ্গলবাড়ি গিয়ে পৌঁছি। ঈশা খাঁর রাজধানীর এখন আর পূর্বের সেই সৌন্দর্য ও শান-শওকত নেই। চারদিকে প্রাচীর নেই, গেট নেই। দারোয়ান নেই। আকাশের নিচে চারদিক খোলামেলা। বাহির বাড়ি সবুজ ঘাসে ছাওয়া। চারপাশে অনেক নতুন পুরনো বৃক্ষের সারি। পূর্ব পাশে একটা বড় পুকুর। আগে এটা পরিখা ছিল। পশ্চিম পাশে ঈশা খাঁর নির্মিত একটি মসজিদ মেরামতের মাধ্যমে আজো সুসজ্জিত রয়েছে।
গাড়ি থেকে রাজবাড়ির সবুজ ঘাসের ওপর পা রাখতেই আমার শরীর ও মন দারুণভাবে রোমাঞ্চিত হলো। মনের পটে ভেসে উঠলো সাড়ে চারশত বছরের ইতিহাস। এই সেই জঙ্গলবাড়ি। যেখান থেকে ঈশ খাঁ যুদ্ধ করে বিশাল মুঘল বাহিনীর সেনাপতি মানসিংহের তরবারি ভেঙে পরাজিত করেছিলেন। মানসিংহ যখন খালি হাতে মৃত্যুর ভয়ে কাঁপতে ছিলেন, ঈশা খাঁ তখন নিজের কোষ থেকে আরেকটি তরবারি দিয়ে বলেছিলেন, এসো বীর আবার যুদ্ধ করে প্রমাণ করি এ দেশ এ মাটি কার! মানসিংহ ঈশা খাঁর বীরত্ব ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে পরাজয় স্বীকার করেছিলেন। এ সেই জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁর, যার সাহসী, বীরত্ব ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে মুঘল সম্রাট আকবর তাকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে মনসদ-ই- আলা উপাধি দিয়ে বাংলার ২৪টি পরগনার শাসনভার অর্পণ করে সম্মানিত করেছিলেন। এই স্থান সেই মহান গৌরবদীপ্ত বীর ও পরোপকারী যোদ্ধার, যাকে নিয়ে কবি ইসমাইল হোসেন শিরাজী ‘রায়নন্দিনী’ উপন্যাস লিখে তৎকালের ভারতের হিন্দু কবি সাহিত্যিক ও ইতিহাস লেখকদের স্তম্ভিত ও হতবাক করে দিয়েছিলেন। এই স্থান সেই মহান মানবতাবাদী জনদরদী সুশাসকের, যিনি মগহার্মাদ ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের অত্যাচার থেকে এ দেশবাসীকে রক্ষা করেছিলেন নৌবাহিনী গঠন করে। যার শাসন আমলে এক টাকায় চার মণ চাল পাওয়া যেত। এই সেই জঙ্গলবাড়ি, যেখান থেকে যুদ্ধ করে এই মাটি দেশ ও মানুষকে স্বাধীন রেখেছিলেন আজীবন।
ঈশ খাঁ মসনদই-আলা, যার শৌর্যবীর্য ও তেজদীপ্ত কাহিনী শুনলে আজো এ দেশের তরুণদের শরীরের শিরায় শিরায় রক্ত নেচে ওঠে। সাহসে বুক ফুলে ওঠে। গর্বে শির উঁচু হয়ে ওঠে।
এ সেই ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়ি। আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। দেশি মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক উঠোনের শুকনো পাতা ঝাড়ু দিচ্ছেন। দক্ষিণ পাশে গোলাপ ফুলের চেয়েও সুন্দর দুটি মেয়ে। একজনের হাতে ঝাটা। ওদের ম্লান মুখ। ভদ্রলোকটিকে সালাম দিয়ে বললাম, আমরা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থেকে এসেছি। এ রাজবাড়ির কিছু তথ্য ও বর্তমান অবস্থা জানতে। এ বাড়ির বর্তমান তত্ত্বাবধানে কে আছেন? তিনি বললেন, আমি আছি। তাহলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ভদ্রলোক তখন কয়েকটি চেয়ার টেনে এনে আমাদের বসতে দিলেন। আমরা চারজন বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী?
দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ।
আপনি ঈশা খাঁর বংশের কততম পুরুষ?
১৫তম।
আপনার পিতার নাম কী?
দেওয়ান আমিন দাদ খাঁ।
আপনার স্ত্রীর নাম কী?
মোছা. ফাতেমা।
আপনার সন্তান কয়জন?
আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
তাদের নাম কী?
ছেলের নাম ইকরাম দাদ খাঁ। বড় মেয়ের নাম শানজিদা খানম (তানা), চোট মেয়ের নাম তাশরিফা খানম (তিন্নি)।
এখানে বর্তমানে কয়টি পরিবার আছেন?
চার পরিবার।
কীভাবে চলছেন?
কোনোরকমে।
ঈদ কেমনে উদযাপন করলেন?
কোনোরকমে।
আপনাদের আয়-রোজদার কীভাবে হয়?
এবার জামাল দাদ খাঁ বলতে লাগলেন, আমাদের যে জায়গা-জমি ছিল, তা বেদখল হতে হতে শেষ পর্যন্ত ২৭ একর টিকেছিল। সেই ২৭ একর থেকে বেদখল হতে হতে বর্তমানে ৫ একর টিকে আছে। কিন্তু আমাকে খাজনা দিতে হচ্ছে ২৭ একরের।
আপনি মামলা করেননি?
করেছি। কাজ হয়নি।
বর্তমান নতুন সরকারের কাছে নালিশ করেছেন?
করেছি।
কী বলেছেন?
আশা দিয়েছেন।
তাদের আশা বিশ্বাস হয় কি?
বিশ্বাস না করে উপায় কী।
আপনাদের জায়গা-জমি কারা বেদখল করেছে?
ভূমিদস্যুরা।
ভূমিদস্যু কারা?
যাদের গায়ে জোর আছে।
জোর করে ২২ একর জমি দখল করে খাচ্ছে?
জী।
এ জোর দখল কত বছর থেকে শুরু হয়েছে?
পতিত সরকারের আমল থেকে।
বর্তমানে তারা কেমন করছে?
ভয় দেখাচ্ছে।
আপনাদের ঐতিহাসিক মান-মর্যাদা রয়েছে, সে সম্পর্কে এলাকার লোকের ধারণা কী?
কিছু লোকের ভালো ধারণা আছে। আর অন্যরা লুটে নেয়ার চিন্তায় আছে।
আপনারা কি ভয় পাচ্ছেন?
না, না, ভয় পাই না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করছেন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আমরা এ বাড়িতে যা কিছু আছে, সবই ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই এবং এখানে ধ্বংস হয়ে যা কিছু রয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। তার আগে আপনার ছেলেমেয়েদের কথা শুনতে চাই। যদি ওদের একটু ডেকে আনে। দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ বললেন, ইকরাম তো বাইরে গেছে। মেয়ে দুটি ডেকে আনলেন। মেয়ে দুটি সালাম দিয়ে আমার পেছনে দাঁড়ালো। ওদেরকে আমি কী বলবো, প্রথম ভেবে স্থির করতে পারছিলাম না। ওদের বাবাকে একটু আগে উঠোন ঝাড়ু দিতে দেখলাম। ওদের একজনের হাতে ঝাঁটা দেখলাম। জামাল দাদ খাঁর কাছে যা শুনলাম, তাতে সত্যি আমি অবাক হয়ে পড়েছিলাম। ভাবতে ছিলাম এই কী সেই মহান ঈশা খাঁর বংশধর! তাদের করুণ অবস্থা দেখে আমার মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। শুনলাম দেওয়ান শানজিদা খানম (তানা) ইন্টার পরীক্ষার্থী। দেওয়ান তাশরিফা খানম (তিন্নি) নবম শ্রেণিতে পড়ে। ওদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল-কলেজ। অথচ কর্তৃপক্ষ ওদের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেন না। ওদের পুরো বেতন ফিস দিতে হয়। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের যে বংশের অতীত গৌরব ও মর্যাদা রয়েছে, সেই হিসেবে তোমাদের সহপাঠীরা কি মর্যাদা দেয়? ওরা হেসে বলল, জী, সহপাঠীরা আমাদের মর্যাদা দেয়।
বললাম, তোমাদের হাতে যে ঝাঁটা দেখলাম, তা তোমাদের মোটেই মানায় না। তোমরা সে ঝাঁটা দিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলে না কি যারা তোমাদের জায়গা-জমি বেদখল করে খাচ্ছে তাদের মুখে ঝাঁটা মারছিলে? তোমরা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন নাকি তোমাদের প্রতি যারা অন্যায় অবিচার করছে, সেসব জালিম-অবিচারকদের মাথায় ঝাঁটা মারছিলে? মেয়ে দুটি চুপ করেছিল। আমি বললাম, আমার কথার জবাব দাও। তানা বলল, কী বলবো স্যার? বললাম, আমি তোমাদের স্যার নই। আমি তোমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে দুঃখিত। তোমরা মজলুম। আমি তোমাদের ব্যথায় ব্যথিত ও মর্মাহত। আমি তোমাদের স্যার নই, ভাই। তোমরা আমার বোন।
আমার মনের আবেগভরা কথা শুনে মেয়ে দুটি নির্বাক। চেয়ে দেখি ওদের চোখ অশ্রুতে ছলছল করছে। ওরা ওড়নায় চোখ মুছল। বললাম, কেঁদো না বোন। এ দেশ তোমাদের। তোমাদের জায়গা-জমি আবার ফিরে পাবে। যারা তোমাদের জায়গা-জমি কেড়ে নিয়েছে এ দেশ তাদের নয়। তারা পালিয়ে বিদেশে চলে গেছে। তারা এ দেশের দুশমন। তোমরা আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো। তানা আর তিন্নি দুই বোন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, দোয়া করো ভাই…
এরপর দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে দেখালেন গোলাকৃতির বিধ্বস্ত অন্দর মহল। অন্দরমহলে ছিল ৪০টি কক্ষ। দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়লেও তাতে আঁকা ফুল, লতাপাতার আলপনা লক্ষ করা যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না কী নিপুণ সৌন্দর্যে নির্মিত হয়েছিল। এই অন্দরমহল বা ভগ্ন কেল্লার একাংশ সংস্কার করে সেখানে বসবাস করছেন ঈশা খাঁর বর্তমান বংশধর দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ ও তার পরিবার। বিদেশি আক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে এ জঙ্গলবাড়িতে ঈশা খাঁ দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। গোটা এলাকায় তৈরি করেন বিশাল পরিখা। নির্মাণ করেন নতুন দুর্গ। এখনো ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গে এবং বাসভবনের শুধু স্মৃতিচিহ্নটুকু বিদ্যমান। এখনো যা কিছু আছে, তা সামান্য হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। দরবার কক্ষটি এখনো অখণ্ড অবস্থায় রয়েছে। এখনো রয়ে গেছে ইট-চুন-সুরকির দেয়াল ঘেরা কাঠামো। যদিও স্থানে স্থানে খসে পড়েছে এর পলেস্তারা। দরবার কক্ষের কয়েকটি থাম আজো অক্ষত রয়েছে। দরবার কক্ষের ২০ ফুট পুরু দেয়ালে রয়েছে ছোট ছোট কোপ, এগুলোয় মোমবাতি ও আগরদানি রাখা হতো। এখানে দেখার মতো রয়েছে অনেক কিছু অনেক ইতহিাস, যা আমাদের গৌরব ও গর্বের। জামাল দাদ খাঁ তার বংশ পরিচয়, ঈশা খাঁর ছবি, সম্রাট আকবরের সভায় নবরত্নে সঙ্গে ঈশা খাঁর ছবি আমাদের দেখালেন।
আমরা রাজবাড়ির ভেতরে-বাইরে সবকিছু দেখে ও ছবি তুলে শেষে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের রুহের মাগফিরাত এবং পরিবারের জীবিতদের কল্যাণ কামনা করে বিদায়ের জন্য গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালাম। দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ এবং তার দুই মেয়ে তানা এবং তিন্নি আমাদের বিদায় জানাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন। এক মুহূর্তের ক্ষণিক দেখায় এ পরিবারের কয়জন লোকের প্রতি কেন যে এত আন্তরিকতা জন্ম দিল! আমার মনে হচ্ছিল এরা আমার হাজার বছরের পরম আত্মীয়। এদের সাথে আমি মিলেমিশে সারা জীবনই থাকি। এদের মুখ দুঃখ-বেদনার কথা শুনি। এদের হাসি-কান্না বিরহ-বেদনা, স্নেহ, প্রেম ও ভালোবাসার কথা হৃদয়-মন দিয়ে শুনি। এদের নিয়ে আমি নতুন গল্প, উপন্যাস, রচনা করি! কিন্তু থাকা তো গেল না। দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ আর তার গোলাপফুলের মতো দুটি মেয়ে তানা ও তিন্নি হেসে বললেন, আবার আসবেন। আমি আবৃত্তি করে শোনালাম।
জাতির গৌরব নির্মাতাদের প্রতি
রয়ে গেল আমার শ্রদ্ধা-সালাম,
দেশবাসী কভু ভুলবে না তাদের
চির অমর থাকবে তাদের নাম।
আর-
তাদের প্রতি যারা জুলুম করছে
করছে শত অবিচার-ছলাকলা,
তাদের মুখে নিক্ষেপ করে গেলাম
আমার ঘৃণার থুথু এক দলা।