শহীদ মতিউর রহমান নিজামী : ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
৮ মে ২০২৫ ১৩:১৪
॥ আব্দুল ওয়াদুদ সরদার॥
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কিছু মানুষ এমনভাবে আবির্ভূত হন- যাঁদের জীবন একটি আদর্শ, তাঁদের সংগ্রাম একটি দর্শন এবং তাদের শাহাদাত একটি বিপ্লবের আলোর মশাল। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.) তেমনি একজন ইতিহাস-নির্মাতা, যাঁর জীবন ও মৃত্যু আমাদের শিক্ষা দেয়, কীভাবে একটি আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়। ইসলামী রাজনীতি, দাওয়াহ, জাতীয় নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন- এ সবকিছুর সমন্বয়ে গঠিত তাঁর পূর্ণাঙ্গ চরিত্র আমাদের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ।
জন্ম ও শিক্ষা
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মন্মথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম লুৎফর রহমান খান একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও খোদাভীরু লোক ছিলেন। নিজগ্রাম মন্মথপুর প্রাইমারি স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর সাঁথিয়ার বোয়াইলমারী মাদরাসা হয়ে পাবনার শিবপুর ত্বহা সিনিয়র মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সমগ্র বোর্ডে ১৬তম ও ১৯৬১ সালে একই মাদরাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে মতিউর রহমান নিজামী অন্যতম শ্রেষ্ঠ দীনি শিক্ষাকেন্দ্র মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কামিল পরীক্ষায় ফিকহশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।
ইসলামী আদর্শেই তার নেতৃত্ব
মাওলানা নিজামী বিশ্বাস করতেন, পার্থিব জীবনে মানুষের শান্তি ও পরকালীন মুক্তি একমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত পথেই সম্ভব। তাই তিনি রাজনীতি ও সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার এ নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিমূলক। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ কর্তৃক প্রণীত আইনের পরিবর্তে আল্লাহর বিধানই হতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজের মূল ভিত্তি। তিনি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সংগঠন ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ গড়ে তুলতে, যেখানে ইনসাফ থাকবে, দুর্নীতির ঠাঁই থাকবে না, মানুষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী ঐক্য প্রসঙ্গে ভূমিকা
মাওলানা নিজামী শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একটি বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে। তিনি ওআইসি, রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনগুলোয় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্য, ফিলিস্তিন-কাশ্মীর ইস্যুতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।
ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ড
তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাবি্যুনালের ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ডের নামে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মাওলানা নিজামী। ২০১৬ সালের ১১ মে গভীর রাতে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। অথচ সেই সময় তিনি ছিলেন একজন ছাত্রনেতা এবং তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা এ বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরাও তার বিচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে মন্তব্য করেন। এটি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দেন এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন।
ঐজড ও অসহবংঃু: উভয় মানবাধিকার সংগঠন বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ: রায়ের পর অনেক আইনজীবী বলেছেন, ‘এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিচারে পরিণত হয়েছে।’
শহীদ ও শাহাদাতের মর্যাদা
কুরআন ও হাদীসে শহীদের মর্যাদা বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তাদের মৃত মনে করো না, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে; বরং তারা জীবিত, তাদের পালনকর্তার কাছে তারা রিজিকপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার দীনের জন্য নিহত হয়, সে শহীদ।’ (তিরমিযী)।
মাওলানা নিজামী তার আদর্শ, দীন ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর এ শাহাদাত তাকে শহীদের মর্যাদায় ভূষিত করে।
নৈতিকতা ও ব্যক্তিজীবনে আদর্শ
তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল অত্যন্ত অনাড়ম্বর, সুশৃঙ্খল ও তাকওয়ানির্ভর। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতেন, রমজানে দীর্ঘসময় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন, এতেকাফ করতেন এবং আল-কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়নে সময় কাটাতেন। কারাগারে থেকেও তিনি দাওয়াহ চালিয়ে গেছেন, কুরআনের আলো ছড়িয়েছেন এবং প্রহরীদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।
শাহাদাতের আগে পিতা-পুত্রের শেষ কথা
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পূর্বে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎকালীন কিছু আবেগঘন, মর্মস্পর্শী বাস্তবতামূলক কিছু উল্লেখযোগ্য দিকনির্দেশনা প্রত্যেক মানুষের মনের মণিকোঠায় গেঁথে রয়েছে। ২০১৬ সালের ১০ মে রাতে কাশিমপুর কারাগারে শহীদ মাওলানা নিজামীর সঙ্গে পরিবারের শেষ সাক্ষাতের সময় তাঁর সন্তান ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন জিজ্ঞেস করেন, ‘আব্বা, আপনি কি আমাদের জন্য কোনো পরামর্শ রাখতে চান?’ মাওলানা নিজামী উত্তরে বলেন, ‘আমি তো সবসময় তোমাদের জন্য দোয়া করি। তোমরা দীনের ওপর থাকো, ইসলামের পথে অটল থেকো। ইনশাআল্লাহ, দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার জন্য মন খারাপ কোরো না। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান কায়েম করার চেষ্টাই করেছি। এখন আল্লাহর দরবারে যাচ্ছি। ওখানে বিচার হবে, ইনশাআল্লাহ ন্যায়বিচার পাব।’ শেষে বলেছিলেন-‘তোমরা কাঁদবে না, মজলুমের রক্ত বৃথা যায় না। আমি মাথা উঁচু করে যাচ্ছি। এই মৃত্যু আমার জন্য অপমান নয়, সম্মানের।’
মাওলানা নিজামীর ভাষণ, বক্তৃতা ও লেখনী
মাওলানা নিজামী বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তাঁর বক্তব্যে সবসময় যুক্তি, দালিলিক প্রমাণ এবং হৃদয় ছোঁয়া আন্তরিকতা বিদ্যমান ছিল। তিনি বলতেন, ‘ইসলামী আন্দোলন কোনো গুজব নির্ভর আন্দোলন নয়। এটি আল্লাহর বিধান কায়েমের আন্দোলন। যারা এ পথের সাথী, তারা সফল হবেইÑ এই ওয়াদা কুরআনে আছে।’
তার বক্তৃতা ও লেখনী তরুণ সমাজে চিন্তার বিপ্লব ঘটায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘জ্ঞান ও তাকওয়ার সমন্বয়ই একজন আদর্শ কর্মী সৃষ্টি করে।’
ইতিহাসে তাঁর অবস্থান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা
ইতিহাসে শহীদ মাওলানা নিজামী (রহ.) আজীবন আলো ছড়াবেন। তাঁর দৃঢ়তা, নৈতিকতা ও দাওয়াহ কর্মকাণ্ড ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বিশাল পাঠশালা। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় আলেমরা তাঁর শাহাদাতকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি প্রমাণ করে, তাঁর জীবন কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি আলোকবর্তিকা।
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.) ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ইসলামী নেতা হিসেবে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে দীনের পথে জীবন বিলিয়ে দিতে হয় এবং কীভাবে আল্লাহর রাস্তায় আত্মত্যাগের মাধ্যমে চিরকাল বেঁচে থাকা যায়। তার জীবন আমাদের জন্য একটি আদর্শ এবং তাঁর শাহাদাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- ‘তোমরা হতোদ্যম হয়ো না, দুঃখ করো না; যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে তোমরাই বিজয়ী হবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৯)।
পরিশেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করি, হে মালিক! মেহেরবানি করে তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর আদর্শে জীবন পরিচালনা ও শাহাদাতের মর্যাদা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।
লেখক: সাংবাদিক ও শ্রমিক নেতা।