হাকালুকি হাওরের সোনালি স্বপ্ন ঘরে তুলছেন কৃষকরা
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:২২
মো. সামছুল ইসলাম, জুড়ী (মৌলভীবাজার) : মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে হাকালুকি হাওর। এ হাওরের বুকজুড়ে এখন চলছে কৃষকের ব্যস্ত সময়। সোনালি ধানের ছায়ায় মুখরিত হাওরের মাঠগুলো যেন পরিণত হয়েছে এক উৎসবমুখর কর্মচাঞ্চল্যে। হাওরপারের কৃষকরা জানান, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময়মতো চাষাবাদ হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। হাওরের পরিশ্রমী কৃষকরা ভোর থেকে শুরু করে দিনভর ব্যস্ত থাকছেন ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলার কাজে।
কুলাউউা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষক আলী হোসেন বলেন, ‘এই হাওরের ওপরই আমাদের জীবন। আল্লাহর রহমতে এবার ফলন ভালো। ধানও ভালো দাম পাইলে আশা করি খরচ মিটাইতে পারব। সরকার যদি আর একটু সহায়তা করত, যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিত, তাহলে আরও সহজ হতো।’
হাকালুকি হাওর দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি। এ হাওরের ওপর নির্ভর করে হাজার হাজার কৃষক পরিবারের জীবিকা। প্রতি বছর বোরো ধান কাটা শুরু হলে এখানে তৈরি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ, যেখানে কৃষিকাজের পাশাপাশি দেখা যায় পারস্পরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য চিত্র।
এবার কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কিছু এলাকায় আধুনিক ধান কাটা মেশিনের ব্যবহারে কাজ দ্রুততর হচ্ছে। হাওরের ধান কাটা সফলভাবে শেষ হলে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরের মাঠজুড়ে চলছে হাজারো কৃষকের ব্যস্ততা। কেউ কাটছেন ধান, কেউ মাড়াই করছেন, কেউ-বা গরুর গাড়ি, নৌকা ও ট্রলিতে করে ঘরে তুলছেন সোনালি ফসল। সব মিলিয়ে হাওরের প্রতিটি কোণে যেন গেয়ে উঠছে সোনালি ধানের গান।
প্রতি বছরই হাকালুকির মতো হাওর এলাকায় বোরো মৌসুমে ঘটে এক ধরনের কৃষি উৎসব। এখানে কৃষি শুধুমাত্র পেশা নয়, এটি একটি সংস্কৃতির অংশ। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবার সহযোগিতায় দলবেঁধে ধান কাটেন কৃষকরা। এই মিলেমিশে কাজ করাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
জুড়ী কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এবং রোগবালাই কম হওয়ায় ধানের ফলন অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ধান কাটা মেশিন, কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ট্রান্সপ্লান্টারের মতো প্রযুক্তি সরবরাহ করা হচ্ছে সীমিত পরিসরে। তবে এখনো বেশিরভাগ এলাকাতেই ধান কাটা হচ্ছে হাতে বা ঐতিহ্যবাহী কৌশলে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জালাল উদ্দিন জানান, মৌলভীবাজার জেলায় চলতি মৌসুমে ৬২,১৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন কৃষকরা। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, প্রতি হেক্টরে গড়ে চার মেট্রিক টন হারে চাল উৎপাদন হলে মোট চালের উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ২,৪৮,৫৬০ মেট্রিক টন। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে বলা যায়, এ বছর বোরো ধানের ফলন অত্যন্ত ভালো হয়েছে।
তিনি বলেন, ধান কাটার মৌসুমে কৃষকদের সহায়তায় জেলায় বর্তমানে ১৭১টি আধুনিক ধান কাটার মেশিন সচল রয়েছে, যা কৃষকদের শ্রম ও সময় বাঁচাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তিনি আরোও বলেন, ‘সরকারিভাবে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারেন। এছাড়া ধান যেন দ্রুত ও নিরাপদে ঘরে তোলা যায়, সেজন্য আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে।’
সরেজমিন দেখা যায়, এ ধান কাটার উৎসব শুধু একটি কৃষি কাজের মৌসুমি দৃশ্য নয়Ñ এটি হাওরবাসীর আশা-ভরসার প্রতীক। প্রতি বছর এ সোনালি ফসলের ওপর নির্ভর করেই চলে তাদের পরিবারের জীবনযাত্রা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, সংসারের খরচ এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন। জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, এবার জুড়ী উপজেলায় ৯ হাজার ১০ হেক্টর জমি আবাদ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে।