জুলাই চার্টার ছাড়া ঐকমত্য সোনার হরিণ

জামশেদ মেহ্দী
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৫৭

॥ জামশেদ মেহদী॥
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকেই বলে আসছেন যে, তিনি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দের অনুরোধে রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কোনোদিনই আগ্রহী ছিলেন না। ১/১১-এর সময়ও তাকে জেনারেল মঈন এবং জেনারেল মাসুদ উদ্দিন দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য শুধুমাত্র আহ্বানই জানাননি, রীতিমতো পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তখনো তিনি তাদের বলেছিলেন যে, This is not my cup of tea. এবারও যখন ছাত্ররা প্রথম দিন তাকে অনুরোধ করে, তখন তিনি সম্মতি দেননি। সেই সময় তিনি ফ্রান্সে ছিলেন। এরপর ছাত্ররা যখন তাকে আবার অনুরোধ করলো, তখন তিনি ভাবলেন, শত শত ছাত্র শেখ হাসিনাকে উৎখাতের জন্য জীবন দিয়েছে, শত শত মানুষ জীবন দিয়েছেন। তিনি ভাবলেন, এই দেশের জন্য আমারও তো কিছু করার আছে। এই ভেবে তিনি সম্মতি দেন।
দেশে ফিরে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি বলে আসছেন যে, জুলাই বিপ্লব হয়েছিল শুধুমাত্র একটি সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য নয়। লাখকোটি মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন অনেক বড় আশা নিয়ে। মানুষ চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা যে দেশে হিটলার ও মুসোলিনির মতো ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন সেটি যেন আর কোনোদিন ফিরে না আসে। ড. ইউনূস আশা করেছিলেন যে, হাসিনার জমানায় তার অত্যন্ত নিকটজনদের নিয়ে জনগণের টাকা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুণ্ঠন করে যে অলিগার্কি (Oligarchy) কায়েম হয়েছিল, সেটি যেন আর ফিরে না আসে। লাখকোটি টাকা পুকুরচুরি করে দেশে যে চোরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, সেই চোরতন্ত্র (Kleptocracy) যেন আর ফিরে না আসে। দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি এমনভাবে ঢেলে সাজানো হবেÑ যাতে করে সাচ্ছা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জাতীয় সম্পদ সাধারণ মানুষও ভোগ করতে পারেন। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি Egalitarian সোসাইটি। এ ধরনের রাজনীতি এবং অর্থনীতি কায়েম করতে হলে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। দেশের প্রয়োজনীয় এসব সংস্কার সম্পন্ন করে তিনি তাঁর কাজে ফিরে যাবেন। অনুরূপভাবে উপদেষ্টা পরিষদে যেসব সদস্য রয়েছেন, তারাও এ সংস্কার সম্পন্ন করে নিজ নিজ পেশায় ফিরে যাবেন। এরা কেউই রাজনীতি করবেন না বা ইলেকশনে দাঁড়াবেন না। তবে এদের মধ্যে কেউ যদি রাজনীতি করতে চান বা ইলেকশনে দাঁড়াতে চান, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তার এ কথা অনুযায়ী অন্যতম উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে এনসিপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিগত সাড়ে ৮ মাস ধরে অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন যে, এ জাতির উন্নতির জন্য প্রধান যে, জিনিসটি প্রয়োজন সেটি হলো জাতীয় ঐক্য। পরবর্তীতে বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি হলে তিনি বলেন যে, স্বৈরাচার বিদায় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশও বাংলাদেশকে ডিস্ট্যাবিলাইজড করার জন্য ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং মদদ দিচ্ছে। ওদের অসৎ উদ্দেশ্য বানচাল করার জন্যও প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তিনি যে সংস্কার করতে চান সেই সংস্কার কার্যকর করার জন্যও প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। এ কারণে তিনি দেশে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। এই ১১টির মধ্যে ৮টি সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের রিপোর্ট দাখিল করেছে। এছাড়া অর্থনীতিতে যে লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং টাকা পাচার হয়েছে, তার সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটি একটি বিশদ শে^তপত্র প্রকাশ করেছে। ৮টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ৬টি কমিশন ইতোমধ্যেই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং সেসব রিপোর্টে বিধৃত সুপারিশমালা সম্পর্কে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণের কাজও শুরু হয়েছে। ড. ইউনূসের সাথে সাথে দেশবাসীও আশা করেছিলেন যে এসব সংস্কার রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু বাস্তবে এসে দেখা যাচ্ছে যে, এসব কমিশনের রিপোর্টে বিধৃত সুপারিশমালার ওপর কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। এসব রিপোর্টের মধ্যে দুটি কমিশনের রিপোর্টের ব্যাপারে নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের গভীর আগ্রহ রয়েছে। এ দুটি কমিশন হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন কমিশন। দুঃখের বিষয়, এ দুটি কমিশনের সুপারিশমালার অধিকাংশই দেশের এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দল বলে বিবেচিত বিএনপির দ্বিমতের সন্মুখীন হয়েছে।
দেশের ৩৮টি রাজনৈতিক দলের সাথে ৬টি কমিশনের মোট ১৬৬টি সুপারিশমালার ওপর রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত সংগ্রহ এবং তাদের সাথে মতবিনিময় করার জন্য ড. ইউনূস একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছেন। ড. ইউনূস নিজে এ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজ ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান। ড. আলী রীয়াজই এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে এসব বিষয় নিয়ে প্রতিদিন ম্যারাথন বৈঠক করছেন। বৈঠকের যা ফলাফল, তা জাতির জন্য অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এবং নির্বাচন কমিশনের রিপোর্টের প্রধান সুপারিশগুলোর প্রায় সবই বিএনপি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রধান আলোচ্য বিষয় দেশে ৪টি প্রদেশ গঠন করার সুপারিশ মোটামুটি সকলেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ইউনিটারি বা এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ৪টি প্রদেশ গঠন করলে সরকার ব্যবস্থা হয়ে যেত ফেডারেল। সেটি ধামাচাপা পড়েছে।
ইতোমধ্যেই সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে যে পলিটিক্যাল ডিসকোর্স হয়েছে, সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে এ সংস্কার কমিশন গঠন এবং তাদের সুচিন্তিতিত, তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্ট এবং সেসব রিপোর্টের সুপারিশ যেন প-শ্রমে পরিণত হতে যাচ্ছে।
কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না- কমিশনের এ রিপোর্ট বিএনপি গ্রহণ করেনি। তারা বলেছে যে, দুই মেয়াদের পর এক মেয়াদে গ্যাপ দিয়ে সেই একই প্রার্থী পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। কমিশন সুপারিশ করেছে যে, যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি আর সেই রাজনৈতিক দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এ সুপারিশও বিএনপির কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। কমিশন একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন করার সুপারিশ করেছে। এটিও বিএনপি অগ্রাহ্য করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং বিচারপতি নিয়োগের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রস্তাবও বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় সংসদের বর্তমান মেয়াদ ৫ বছরের জায়গায় ৪ বছর করার সুপারিশ করেছিল কমিশন। সেটিতেও বিএনপি রাজি হয়নি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অত্যন্ত বিতর্কিত একটি বিষয়। এ অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাবে বিএনপি রাজি হয়নি। তবে তারা বলেছে যে, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং অনাস্থা ভোটÑ এই ৪টি বিষয়ে দলীয় প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবেন না সংসদ সদস্যরা।
বিএনপির দাবি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং উচ্চকক্ষ গঠন- এসব বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে নির্বাচিত সংসদ। এখানে আরও একটি কথা বলা দরকার। সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো বর্তমান সংবিধানের সংস্কার করা হবে? নাকি নতুন সংবিধান রচনা করা হবে? ইস্যু ছিল নতুন সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠন করা হবে, নাকি গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে? বিএনপি গণপরিষদ গঠন বা গণভোটÑ উভয় প্রস্তাবেরই বিরোধিতা করেছে।
জাতীয় সংসদে মহিলাদের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০-তে বৃদ্ধি করার প্রস্তাবে বিএনপি সহমত পোষণ করেছে। কিন্তু সেখানে একটি শর্ত দিয়ে তারা বলেছে যে, বর্তমানে সংবিধানে যে ৫০ জন মহিলা সদস্যের নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটিই বহাল থাকুক। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোন কোন বিষয় প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে, সেটি নির্ধারণ করবে নির্বাচিত সংসদ। এছাড়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, সেটিও নির্ধারণ করবে নির্বাচিত সংসদ। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন একটি ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে।
মোটকথা যেসব প্রস্তাবের সাথে বর্তমান সংবিধান সংশোধনের সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটির বিরোধিতা করেছে বিএনপি। এমতাবস্থায় জাতির সামনে এ মুহূর্তে আশু সমাধানের ইস্যু হলো জুলাই চার্টার বা সনদ প্রণয়ন। এ জুলাই চার্টারের জন্য ছাত্র-জনতা বিগত ৩১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফয়সালা করতে চেয়েছিল। তখন সেটিরও বিরোধিতা করেছে বিএনপি। ফলে উদ্ভূত সংকট উত্তরণের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সচিবালয় থেকে বলা হয় যে, সরকারই জুলাই সনদ প্রণয়ন করবে। অতি শিগগিরই জুলাই সনদ প্রণীত হওয়ার কথা ছিল। তারপর প্রায় ৪ মাস অতিক্রান্ত হতে চললো। জুলাই চার্টারের দেখা নাই।
কিছুদিন আগে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন যে, সবগুলো রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সাথে আলাপ-আলোচনা করে যে ঐকমত্য হবে সেটার ভিত্তিতেই জুলাই চার্টার প্রণীত হবে। তারপর আর সেই ৯ মণ তেলও জোটেনি, আর রাধাও নাচেনি। সেই ঐকমত্য এখন সোনার হরিণ।
একটি বিষয় ওভারলুক করা বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে না। ঘটনা পরম্পরা থেকে মনে হচ্ছে যে, বিএনপির রাজি হওয়া বা না হওয়ার ওপরেই নির্ভর করছে জুলাই চার্টার বা সংস্কারের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এটি অনেকে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, আরও কিছু স্টেকহোল্ডার রয়েছেন এসব রাজনৈতিক কর্মকা-ে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে কিছুটা সাইডলাইনে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি বা এনসিপিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে এনসিপি যেমন অতীতে বার বার বলেছে তেমনি এবারও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামনে বলে এসেছেন যেÑ সংবিধান ও নির্বাচনী সংস্কারের পরই কেবলমাত্র নির্বাচন হতে পারে। এনসিপি এ প্রশ্নেও কঠোর অবস্থান নিয়েছে যে, আওয়ামী লীগের এবং অর্থনৈতিক লুটেরাদের বিচার দৃশ্যমান হওয়ার আগে নির্বাচন হতে পারে না।
অনুরূপভাবে জামায়াতে ইসলামীও বলেছে যে, যৌক্তিক সংস্কার এবং স্বৈরাচার ও তার দোসরদের বিচার দৃশ্যমান হওয়ার পরই নির্বাচন হতে পারে। এদিকে দেখা যাচ্ছে যে, চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন এবং হেফাজতে ইসলামের একটি অংশও সংস্কার ও বিচার প্রশ্নে বিএনপির সাথে একমত হতে পারছে না।
সংস্কার, বিচার, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ করণ ইত্যাদি প্রশ্নে বিএনপির সাথে একদিকে যেমন সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে; অন্যদিকে এনসিপিসহ অন্যান্য রাজিৈনতক দলের সাথেও বিএনপির দূরত্ব ক্রমান্বয়েই বেড়ে চলেছে।
এ পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের স্বপ্ন দিন শেষে সোনার হরিণ হয় কিনা, সেটা এখন দেখার বিষয়।