ইসলামবিরোধীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৫০
॥ সুমাইয়্যা সিদ্দিকা ॥
গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি ও নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে এক সুপারিশমালা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পেশ করেছেন। ‘বৈষম্য বিলুপ্তি ও সমতা অর্জন’Ñ শব্দটি শুনতে চমৎকার লাগলেও এর আড়ালে আছে সেক্যুলার ইসলামবিরোধী শক্তির এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র, যা সর্বস্তরের ইসলামী স্কলার ও আলেম সমাজসহ ইসলামী আইন ও নিয়মকানুন বিষয়ে সচেতন নারীমহলের মাঝেও অত্যন্ত উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। নারী কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে কেন এগুলো বাতিল করা উচিত এবং এ বিষয়ে ইসলামী নীতিমালা তুলে ধরার পাশাপাশি আমাদের করণীয় কী হতে পারে, তা সচেতন পাঠকমহলের সামনে পেশ করা হলো।
কমিশনের উপস্থাপিত সুপারিশমালায় যে প্রস্তাবগুলো সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ও বিতর্ক সৃষ্টি করছে-
১. মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান অধিকার প্রদান। পৃষ্ঠা-২৫।
২. পরিবারে নারী-পুরুষকে অভিন্নভাবে দেখার আহ্বান। পৃষ্ঠা-৯ ও
৩. টহরভড়ৎস ঋধসরষু ঈড়ফব বা অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন। পৃষ্ঠা-৯।
উক্ত প্রস্তাবনায় বিতর্কের সৃষ্টির হওয়ার কারণ- ‘ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামী পারিবারিক আইন এবং নারী ও পুরুষের বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি’Ñ বিষয়ের সাথে প্রস্তাবনাগুলো সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। যার অধিবাসীদের শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম। সেই দেশের একটা কমিশন এমন সুপারিশমালা দিয়েছে, যা শতকরা নব্বই ভাগ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। নারীরা তাদের বিষয়াবলী নিয়ে কণ্ঠ উচ্চকিত করবে- এটা অবশ্য ভালো দিক। তবে তা যখন দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ও অধিকাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব করে না, মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত্ব করে, তখন তাকে কীভাবে সংস্কার বলা যেতে পারে(!) সচেতন মহলের জন্য তখন তা আসলেই শঙ্কার বিষয়। ইসলামে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও নারীর ভরণপোষণ, স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্যসহ প্রভৃতি বিষয়েই সুনিদিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সমাজে যার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত হলে সমাজে বিদ্যমান অসংগতিগুলো নির্মূল করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যমান সামাজিক সমস্যাকে সামনে রেখে ইসলামী নীতিমালাবিরোধী যে সুপারিশমালা করা হয়েছেÑ এ যেন মাথাব্যথা সারতে মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছে।
নারী বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী স্বতন্ত্র সত্তা। বিশ্বাস ও কাজের দিক থেকে একজন পুরুষ ও নারীর মাঝে পবিত্র কুরআনে বিন্দুমাত্র পার্থক্য করা হয়নি। কুরআনের সূরা আন-নাহলের ৯৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, “নারী বা পুরুষ যে-ই হোক না কেন, যে ভালো কাজ করলো, সে যদি ঈমানদার হয়, তাহলে আমি তাকে একটি পবিত্র জীবনযাপন করার সুযোগ দেব। আর যে উত্তম কাজ সে করছিলো, আমি তাকে তার উত্তম পারশ্রিমিক দেব।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) তার প্রতিষ্ঠিত্ব সমাজে নারীকে এত বেশি মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করেছিলেন, যা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর একটি উক্তিতে স্পষ্ট বোঝা যায়। তার ভাষায়- ‘নবী সা.-এর যুগে আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে কথা বলতে এবং প্রাণ খুলে চলাফেরা করতেও ভয় পেতাম এই ভেবে যে, আমাদের সম্পর্কে কোনো আয়াত নাজিল না হয়। নবী সা. ইন্তেকাল হওয়ার পর আমরা প্রাণ খুলে তাদের সাথে মিশতে শুরু করলাম।’
আদতে ইসলাম নারী-পুুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্যই করে না- তবে সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব অনুযায়ী নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করেছে, যা ইসলামের স্বকীয়তাকেই নির্দেশিত করে। বিবেক ও যুক্তির দাবিও এটাই।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান অধিকার প্রদান। পৃষ্ঠা-২৫
কমিশন সুপারিশ করেছে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষকে সমান অধিকার প্রদান করতে। ইসলামের উত্তরাধিকারী আইন বা মিরাসী বা উত্তরাধিকার আইন কোনো মনগড়া আইন নয়, বরং এটা সরাসরি আল্লাহর আইন। (সূরা নিসা-১১, ১২, ১৭৬)। যা কোনো ব্যক্তিই পরিবর্তনের অধিকার রাখে না। ইসলামী মীরাসী আইনকে সঠিকভাবে অনুধাবন না করতে পারলেই এ ধরনের পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখানো সম্ভব।
মিরাসী আইনের সম্পূর্ণ বিষয়টাকে সামনে না এনে সবসময়ই একটা অংশকে নিয়ে ধূ¤্রজাল তৈরি করা হয়ে থাকে। পুরো বিষয়টা থেকে শুধুমাত্র “নারীরা সম্পত্তিতে অর্ধেক পায়।’ কথাটিকে কেটে সামনে বিরোধিতা করা হয়; দাবি করা হয় নারীকে পুরুষের সমান সম্পত্তি দিতে হবে। কমিশনও সুপারিশমালায়ও এ বিষয়টিরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। অথচ উত্তরাধিকার সম্পদের ক্ষেত্রে এটিই শেষ কথা নয়। বরং নারী কখনো পুরুষের অর্ধেক পায়, আবার কখনো সমান পায়, বা ক্ষেত্রবিশেষে কখনো বেশিও পায়। ইসলামী ফারায়েজ উত্তরাধিকার আইনে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে বলা আছে।
ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকারী করেছে, পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের আর্থিক দায়িত্বভার থেকে তাকে মুক্ত করে তা পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছে। পিতা, স্বামী, ভাই, ছেলে কারোরই আর্থিক দায়ভার নারীর নয়। বরং পিতার সম্পত্তির অংশীদারি হওয়ার সাথে সাথে নারী বিবাহের সময় স্বামীর কাছ থেকে মোহরানা পাচ্ছে, যা তার মর্যাদাকে যেমন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি তার ভবিষ্যৎকেও করছে সুরক্ষিত।
বরং উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে এমন আইন প্রণয়ন প্রয়োজন যাতে কেউ নারীকে তার প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ না পায়।
পরিবারে নারী-পুরুষকে অভিন্নভাবে দেখার আহ্বান (পৃষ্ঠা- ৯)
কমিশন সুপারিশ করেছে, পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এটা সম্পূর্ণ ইসলামের নীতিমালাবিরোধী, যা মূলত অনৈসলামিক পশ্চিমা সংস্কৃতির ‘জেন্ডার সমতা’কেই প্রমোট করবে। কারণ সূরা নিসা ৩৪-এ বলা হয়েছে, “পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল, কারণ আল্লাহ একের ওপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নারীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করবেন।”
পরিবারের বিষয়ে ইসলাম নারীকেও তার সামর্থ্যের আলোকে দায়িত্ব দিয়েছে। যার জবাবদিহিতাও করতে হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। বুখারী শরীফের এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “একজন পুরুষ তার পরিবার-পরিজনদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।” উল্লেখিত কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার আলোকে বোঝা যাচ্ছে, নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই ইসলাম তাদের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যরে আলোকে যার যার কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্বকে নির্দিষ্ট করে দিয়ে সমতা রক্ষা করেছে। যেখানে অন্য কোনো মতবাদের চাকচিক্যময় গালভরা বুলি এনে আবার নতুন করে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাই নেই। বরং প্রয়োজন ইসলামের নীতিমালার আলোকে সমাজে নারী-পুরুষের ইনসাফপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করে এমন আইন প্রণয়ের সুপারিশ করা।
টহরভড়ৎস ঋধসরষু ঈড়ফব বা অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন (পৃষ্ঠা-৯)
কমিশন সুপারিশ করেছে সকলের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরি করতে, যা করতে হলে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মের পারিবারিক আইনকে বাদ দিতে হবে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার জগাখিচুড়ি আইনকে জোর করে সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা মূলত সমাজে ইসলাম ও ঈমান নষ্টকারী ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠার এক অপকৌশল মাত্র।
আমরা নারী-পুরুষের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ সম্পর্ক চাই- তবে তা ইসলামী রীতি-নীতির বাইরে গিয়ে নয়। চাই সমাজের সর্বস্তরে নারীর অধিকার ও মর্যাদা পরিপূণভাবে প্রতিষ্ঠিত্ব হোক; এগুলো বাস্তবায়নে যেসব আইন প্রণীত হবে, তাতে অবশ্য ইসলামের নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক এমন কিছু থাকুক, তা চাইতে পারি না। তাই অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সকল স্তরের ইসলামী স্কলার ও আলেমদের পক্ষ থেকে সরকার ও কমিশনের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে ইসলামী আইন ও নীতিমালাবিরোধী প্রস্তাবনাকে বাতিল করে ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যশীল এমন প্রস্তাবনা গ্রহণ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা।
শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরে ইসলামী আইন ও নীতিমালাকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্যও আলেম সমাজকে তৎপর হতে উদ্যোগী হওয়াÑ যাতে ভবিষ্যতে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত্ব করে এমন কোনো তৎপরতার সম্মুখীন যেন দেশবাসীকে না হতে হয়।
ইসলামী আইন বিষয়ে দক্ষ এমন নারীদের নারী কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করতে সচেতন সকলের পক্ষ থেকে আওয়াজ তোলা।
সকল প্রকার উত্তেজনা ও অস্থিরতা পরিহার করে প্রজ্ঞা ও যুক্তি নির্ভরপন্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে নারী কমিশনের ইসলামবিরোধী প্রস্তাবনা বাতিল করে ইসলামের সাথে সামঞ্জ্যশীল প্রস্তাবনা রাখতে সকলকেই ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।