গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে একমত নয় বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৪৪

স্টাফ রিপোর্টার : পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর মতামত দিতে তৃতীয় দিনের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপি। দলটি মনে করছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় তাড়াহুড়া না করাই ভালো। বিএনপি বিভিন্ন কমিশনের রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। কোনো কোনো বিষয় একতম হচ্ছে আবার কোনো কোনো বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করছে। কোনো কোনো সুপারিশের বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে থাকছে বিরতও। ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠক করে। ওই বৈঠকেও বেশকিছু মতামত তুলে ধরেছে দলটি। তবে দলটি সংস্কারের বিষয়ে নিজেদের সব মতামত গণমাধ্যমে এখনই তুলে ধরছে না। ২২ এপ্রিল তৃতীয়বারের বৈঠকের দুপুরের খাবারের বিরতির ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির প্রতিনিধিদলের প্রধান ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সেখানে তিনি ভিন্নমত নিতে সাংবাদিকদের কিছুটা ধারণা দেন। জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যাহ্নভোজ বিরতিতে (২২ এপ্রিল) সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি প্রধানমন্ত্রী পদে টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ থাকতে না পারলেও একবার বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, বিএনপির এ প্রস্তাবের পর ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে এক ব্যক্তির একাধিকবার থাকা নিয়ে বিএনপিকে নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা তারা এখনই প্রকাশ্যে আনতে চান না। আগে কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করবেন।
রাষ্ট্রপতির বিদ্যমান ক্ষমতার বাইরে আরও কী কী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়, সেটা উল্লেখ করে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের পর আরেকটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করার পক্ষে বিএনপি মত দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, যা পরবর্তী সময়ে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে হবে। আর রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন, কমিশনের এ প্রস্তাবে বিএনপি একমত।
একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না, ঐকমত্য কমিশনের এ প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় বলেও জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি উন্মুক্ত রাখতে প্রস্তাব দিয়েছি। কারণ একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না, এমন চর্চা আমরা দেখি না।
বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা বহুত্ববাদ কোনোটাই নেই। তবে কমিশন তাদের প্রস্তাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা যুক্ত করতে বলেছে। আমরা সেখানে একমত পোষণ করেছি। জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে ইন্টারনেট প্রাপ্তির প্রস্তাবে বিএনপি একমত বলে উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন বলেন, এটা তো এখনো আছে। এখন শুধু রাষ্ট্র ইন্টারনেট যেন বন্ধ করে না দেয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ তিন বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রাখার বিষয়ে মত দিয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ তিন বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা করা যেতে পারে বলে তারা মতামত দিয়েছে।
সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি একমত এ কথা জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের অষ্টম, নবম, দশম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থার কথা বলেছে তারা। ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার সঙ্গে বিএনপি একমত। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আনার ক্ষেত্রেও তারা একমত। এগুলো মৌলিক অধিকারে আনার কথা বলেছে বিএনপি।
বিএনপির এ নেতা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ নেতার পদ থাকা উচিত। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত যে দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কি না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না, এ বিষয়ে তারা একমত। স্থানীয় প্রশাসনে যে চারটি বিভাগের কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে তারা একমত।
সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, পার্লামেন্ট হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, নি¤œকক্ষে ৪০০ আসন থাকবে, এর মধ্যে নারীদের জন্য ১০০ আসন রাখা এবং উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি একমত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধিকাংশ প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিএনপি একমত হলেও এখন কিছু কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আরও বিচার-বিশ্লেষণ করবে দলটি বলে জানান সালাউদ্দিন আহমেদ।
২২ এপ্রিলের আলোচনায় সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। আলোচনায় সভাপতিত্ব করছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বৈঠকে ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হয়।
এর আগে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপি আরও দুই দফায় আলোচনায় বসে। সেই বৈঠকগুলোয় প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগ, সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়। এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। ৩৪টি দল তাদের মতামত তুলে ধরে, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন। ইতোমধ্যে ১৪টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা শেষ করেছে কমিশন। আর বিএনপির সঙ্গে তৃতীয় দিনের আলোচনা হয়ে গেল।