ঈদ সংখ্যায় ঈদ নেই


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৫০

॥ আবদুল হালীম খাঁ ॥
গত ঈদে দৈনিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলো পাঠকদের ভীষণভাবে হতাশ করেছে। চার রঙের প্রচ্ছদের ওপর সুন্দর করে লেখা ‘ঈদ সংখ্যা’। চেহারা নাদুস-নুদুস। দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। মনে আশা জেগে ওঠে ঈদ আর ঈদের আনন্দ সম্পর্কে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। অনেক মজার গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও উপন্যাসের সাথে বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি এ ঈদ উৎসবের খবর পাওয়া যাবে। এ আশায় পাঠকগণ হকারকে ঈদ সংখ্যার অর্ডার দিয়ে থাকেন। কিন্তু এবার পত্রিকার সম্পাদকগণ দারুণভাবে পাঠকদের হতাশ করেছেন।
পত্রিকা হাতে নিয়ে পাঠক সূচিপত্র দেখে অবাক হয়েছেন। ঈদ সংখ্যা অথচ ঈদ বিষয়ে কোনো লেখা নেই। তাহলে কিসের ঈদ সংখ্যা! সেই বার্মিসাইড ফিস্টের গল্পের মতো দাওয়াত করেছেন পাঠকদের পত্রিকার সম্পাদকগণ।
সম্পাদকীয়তে ঈদের তেমন কোনো কথা নেই। শীতের সকালে ঠাণ্ডা পানি হাতে লাগলে সর্দি-জ¦রের ভয়ে শুকনো মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে অজুর কাজ সেরেছেন সম্পাদকগণ।
সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলোর মধ্যে পাঠকদের ঈদ সংখ্যার প্রতি আকর্ষণ থাকে বেশি। অনেক ভদ্রলোক সাহিত্যের পাঠক না হলেও মোটাসোটা সুন্দর ঈদ ম্যাগাজিন কিনে শোকেসে তুলে রাখেন সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য।
সেই ঈদ সংখ্যায় যদি ঈদ আর ঈদের আনন্দের পরশ না থাকে, তাতে যদি ঈদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস না থাকে, তাহলে ম্যাগাজিনের ওপর রঙিন কালিতে ঈদ লেখার মানে কী? অনেক পাঠকই ঈদের আনন্দের ঈদ সাহিত্য পাঠে অধিক আনন্দ পেতে চান। মুসলমানদের ঈদ উৎসব যেমন আনন্দের, তেমনি পুণ্যেরও। ঈদ মুসলিম সমাজে এক অনন্য আনন্দ বৈভব বিলাতে আসে। ঈদুল ফিতরের দিনটি মহাসম্মেলনের, আনন্দের, অভিনন্দনের, শান্তির, ক্ষমার এবং মহাপুরস্কারের দিন। নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘লিকুল্লি কাওমিন ঈদ, হাযা ঈদুনা’। অর্থ- প্রত্যেক জাতির নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এ ঈদ। (বুখারী, মুসলিম)। ঈদ ধনী-গরিব সব মুসলমানের জীবনে মহামিলনে আনন্দ বার্তা বহন করে। ঈদ মুসলিম সমাজের ধনী-গরিব পারিবারিক ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়। এককাতারে দাঁড়িয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়ার সুযোগ পায়। সকল ধনাঢ্য ও সামর্থ্যবান মুসলিম পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যদের ঈদুল ফিতরের দিনে সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায়ের বিধান রয়েছে। ফিতরার টাকার হকদার হলো পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখী-অসহায়গণ। যাতে তারাও ঈদের আনন্দ পেতে পারেন। সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই আল্লাহ তায়ালা এ বিধান করেছেন। তাই দরিদ্র মুসলিম পরিবারে ঈদ নিয়ে আগ্রহ-আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।
মুসলিম জাতীয় জীবনের এসব বিষয় আমাদের কাজ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও পত্রপত্রিকায় থাকা আবশ্যক। তা না থাকলে কীসের ঈদ সংখ্যা? কীসের সাহিত্য? যেসব পত্রপত্রিকায় মুসলমানদের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান নেই। সেগুলো মুসলমানদের পাঠ করার কী প্রয়োজন?
জাতিকে ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত করার জন্য সংবাদ পরিবেশনের সাথে সাথে কাব্য সাহিত্য তৈরি করার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করার দায়িত্ব পত্রপত্রিকার রয়েছে।
২৪-২৫ বছর আগে কবি আবদুস সাত্তার অনূদিত আরবি ভাষার ‘আহ্বান’ নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। লেখক তার কী অসম্ভব জাদুকরী ক্ষমতায় ইসলামের ছোট-খাটো রীতি-নীতি পাঠকদের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন যে, তা অমুসলিমদের দারুণভাবে আকর্ষণ করেছে ও অনুপ্রাণিত করেছে। দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য ইসলামী জীবনবিধানের মতো আর কোনো বিধান নেই। তা সুন্দরভাবে বোঝানোর দায়িত্ব কবি-সাহিত্যিকদের। আর তেমন কবি-সাহিত্যিক সৃষ্টি করার দায়িত্ব অনেকটা পত্রপত্রিকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের দেশের অনেক দৈনিক পত্রিকা ব্যক্তিগত ও দলীয় আদর্শ প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো পত্রিকা সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ব্যস্ত রয়েছে। মুসলিম জাতির আদর্শ প্রচার করা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার কাজে খুব কম পত্রিকাই দেখা যায়। পত্রিকা সম্পাদকদের দেশের মানুষের মন-মানসিকতা ও বিশ্বাস পাঠ করা উচিত।
বলছিলাম গত ঈদ সংখ্যার পত্রিকার অবস্থার কথা। পত্রিকাগুলোয় দেশের খরা-আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে ভীষণভাবে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই। খাল-বিল, নদনদীতে পানি নেই। মাটিতে রসকষ নেই। গাছগাছালিতে ফুলফল নেই। গাছগাছালির পাতা ধূলিধূসর। দেশের মাটি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। শুধু দেশের মাটি নয়, মানুষের মনোভূমি ধূসর মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে। গত ঈদে ‘ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক’ সম্ভাষণ কারো মুখে শুনিনি। তেমন হাস্যোজ্জ্বল মুখও কারো দেখিনি। পূর্বের মতো গত ঈদ সংখ্যার জন্য আমার কাছে কোনো পত্রিকার সম্পাদক লেখা চাননি। আগে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার মোটা মোটা ঈদ সংখ্যা পেতাম। ঘরে বসে অনেক দিন মজা করে পড়তাম। প্রতিবেশী পাঠকরা নিয়ে পড়ে খুশি হতেন। কিন্তু এবার! খরা আর খরা। চারদিক আনন্দহীন। নিরস। শুষ্কতা। নির্জীবতা। কোথাও প্রাণের সাড়া নেই।
পাঠকদের জন্য পত্রিকায় প্রাণের খাদ্য থাকা চাই। এই যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলো। অতি অল্প সময়ে আন্দোলন সফল হলো। আন্দোলনের মূল বিষয় কী ছিল? মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্যায়-অবিচার-অনাচার এবং সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে- সত্য ও সুন্দরের পক্ষে, ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে। এটা তো ইসলামেরই শিক্ষা। এ দেশের সাধারণ মানুষের মন-প্রাণ সত্য ও সুন্দরের দিকে। দেশের পত্রপত্রিকা ও রাজনৈতিক দলগুলোর এসব মানুষের মন-প্রাণ পাঠ করে জানা প্রয়োজন।
আজো দেশের কিছুসংখ্যক অতিরিক্ত নেতাগণ ইসলামকে না বুঝেই ভয় করছেন এবং পত্রিকার সম্পাদকগণ ইসলামকে না জেনে, না বুঝেই ভয় করছেন। ইসলামকে খুব সতর্কতার সঙ্গে দূরে ফেলে রেখে ভালো মানুষটি সেজে থাকতে চাচ্ছেন। তাদের দৃষ্টি বিজাতির দিকে, বিজাতির সংস্কৃতির দিকে। এদেশের মানুষের মন-মানসিকতা ও বিশ্বাসের দিকে নয়, এদেশের মাটি ও ঐতিহ্য-ইতিহাস-সংস্কৃতির দিকে নয়। অপকৌশলে এ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।
আমরা প্রতি বছর ঈদ সংখ্যা চাই। ঈদ সংখ্যায় ঈদ আনন্দের কথা এবং আমাদের হৃদয়ে লালিত বিশ্বাসের অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে চাই।
লেখক : কবি।