রাষ্ট্র সংস্কার : বিপরীত মেরুতে বিএনপি ও এনসিপি
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৫৬
॥ জামশেদ মেহ্দী॥
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবসময় জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে রাজনৈতিক দলসমূহও। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্যের সন্ধানে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করেছেন। এ কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে। এ কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান, আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। আর সদস্য হচ্ছেন সবগুলো সংস্কার কমিশনের প্রধানরা। ইতোমধ্যেই ঐকমত্যের সন্ধানে কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু এখনো সেই ঐক্যের দেখা পাওয়া যায়নি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- ৩৬ জুলাইয়ের পর প্রধান উপদেষ্টা, তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ, জামায়াতে ইসলামীসহ জুলাই বিপ্লবের স্টেকহোল্ডাররা মনে করেন, ঐ বিপ্লব শুধুমাত্র শেখ হাসিনার পতন বা আওয়ামী লীগ সরকারের অপসারণের জন্যই ছিল না। আশু লক্ষ্য হাসিনা সরকারের পতন অবশ্যই। সেটা তো ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। এখন বিপ্লবের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য হলো, যেসব কারণে শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার হতে পেরেছিলেন, সেই সব কারণ চিরদিনের জন্য দূর করা। এটা দূর করতে গিয়ে ড. ইউনূসের সামনে দেখা দিল কতগুলো বড় সমস্যা। সেগুলো হলো প্রধানত সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি। সকলেই অনুধাবন করতে পারলেন, ঐসব খাতে যদি সংস্কার করা না হয়, তাহলে স্বৈরাচার আবার ফিরে আসবে।
এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক ঐক্য জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই বলে আসছিল, বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার প্রোক্লামেশন বা ফরমান অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাই তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় প্রোক্লামেশন বা ফরমান জারি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা যখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র জনসমক্ষে ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন, তার পূর্ব মুহূর্তে সরকারের তরফ থেকে বলা হলো যে, সরকার নিজেরাই একটি প্রোক্লামেশন জারি করবে। পরবর্তীতে সরকারের তরফ থেকে প্রোক্লামেশন শব্দটি আর ব্যবহার না করে বলা হলো যে, সরকার জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ ঘোষণা করবে। সরকারের তরফ থেকে বলা হলো- সংস্কারের ব্যাপারে সবগুলো রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনা করে মতৈক্য সৃষ্টি করা হবে। অনুরূপভাবে সবগুলো রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনা করেই মতৈক্যের ভিত্তিতে জুলাই চার্টার প্রণয়ন করা হবে।
এরপর সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে ৬টি কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের রিপোর্ট দাখিল করেছে। এসব রিপোর্টে একদিকে যেমন বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সেসব সমস্যা সমাধানে অনেকগুলো সুপারিশও করা হয়েছে। ৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে রয়েছে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার ব্যবস্থা সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার এবং পুলিশ সংস্কার কমিশন। অবশিষ্ট ৫টি কমিশন এখনো রিপোর্ট দেয়নি। সম্ভবত জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য ঐসব কমিশনের রিপোর্ট অপরিহার্য নয়।
পরবর্তী পর্যায়ে যে ৬টি কমিশনের রিপোর্ট দাখিল হয়েছে সেসব, রিপোর্ট দেশের ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করা হয়। অতঃপর প্রতিটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত চাওয়া হয়। এ মতামত চাওয়া হয় একটি স্প্রেডশিট বা ছক আকারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো ঐ স্প্রেডশিট বা ছক পূরণ করে তাদের মতামত দিয়েছে।
অতঃপর সরকারের সিদ্ধান্ত হলো, রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত নিয়ে আলোচনা বা ঐকমত্য কমিশনের সাথে মতবিনিময় করা। স্প্রেডশিটে বেশ কয়েকটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আপনি কি সুপারিশের সাথে একমত? আপনি কি আংশিকভাবে একমত? আপনি কি সুপারিশের সাথে মোটেই একমত নন? যদি একমত না হন, তাহলে কারণটি উল্লেখ করবেন। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘর ছিল।
রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের লিখিত মতামত দেওয়ার পর যেসব সুপারিশের সাথে রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়, সেই দ্বিমতের কারণ ঐ স্প্রেডশিট বা ছকে লিখিতভাবে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। আমার এ ৬টি রিপোর্ট এবং রাজনৈতিক দলসমূহের উত্তর বা মতামতের ওপর চোখ বুলানোর সুযোগ হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান যেসব ইস্যু নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেসব ইস্যুতে একদিকে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সাথে অনেক রাজনৈতিক দলের দ্বিমত রয়েছে। আবার অনেকগুলো ইস্যুতে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেই বিভিন্ন মত রয়েছে। আমরা নিচে এ ধরনের কয়েকটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবো।
গভীরভাবে স্টাডি করলে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী এবং ১৪টি অন্যান্য রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতিসমূহ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া ১৫টি দল এবং প্ল্যাটফর্ম সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে এবং ১১টি দল ও প্ল্যাটফর্ম সংবিধানের মূলনীতি এবং প্রস্তাবনা উভয়েই পরিবর্তন চেয়েছে। মূলনীতিতে পরিবর্তন চেয়েছে যারা, তাদের মধ্যে রয়েছে- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট, ১২ দলীয় জোট, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, বাসদ, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সিপিবি।
যে ১৫টি দল প্রস্তাবনা পরিবর্তন করতে চেয়েছে সেগুলো হলো- বিএনপি, জামায়াত, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ জাসদ (আ স ম আব্দুর রবের জাসদ নয়), লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, এনডিএম এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।
সংবিধানে বাংলায় যেভাবে লেখা আছে, বিএনপি সেভাবেই “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” রাখতে চায়। বিএনপি বলেছে, ৫ম সংশোধনীতে যেভাবে মূলনীতি রয়েছে, সেভাবেই বর্তমান সংশোধন করতে হবে। বর্তমান সংবিধানে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বিএনপি বলেছে, সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে হবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, প্রস্তাবনায় জুলাই বিপ্লবের স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। “গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবসহ যেসব গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে”, এসব কথা সংশোধনীতে উল্লেখ থাকতে হবে। জামায়াত বলেছে, সংবিধানের মূলনীতিসমূহ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতি (Multiculturalism).
জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রস্তাব করেছে যে, জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তাদের প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র হবে প্রথম রিপাবলিকের ঘোষণাপত্র। নতুন সংবিধানে প্রস্তাবনা হিসেবে দ্বিতীয় রিপাবলিকের ঘোষণাপত্র থাকবে।
এবি পার্টি সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ঘোষণাপত্রের ৩ মূলনীতি যথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যর্থ ও অকার্যকর হয়েছে। যেহেতু প্রথম রিপাবলিক ব্যর্থ হয়েছে- তাই নতুন বাংলাদেশ করার জন্য দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা আবশ্যকীয় হয়েছে।
বিএনপি প্রস্তাব করেছে যে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যেসব মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটি সংবিধানে ৫টি মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে। এগুলো হলো- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, নাগরিক অধিকার এবং গণতন্ত্র।
বিএনপি এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন সংবিধানে পবিত্র ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখার কথা বলেছে। পক্ষান্তরে সিপিবি, বাংলাদেশ জাসদ এবং বাসদ রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশে একমত জামায়াতে ইসলামী। প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে এনসিসির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগের সুপারিশের পক্ষেও মত দিয়েছে দলটি। তবে তারা প্রস্তাবিত এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে চান না। দলটি চায় কেউ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; তবে সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকুক। বিএনপি গণভোটের প্রস্তাব নাকচ করেছে। জামায়াতে ইসলামী গণভোট সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। জামায়াত বলেছে, কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। পক্ষান্তরে বিএনপি বলেছে, দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থেকে তারপর একটি গ্যাপ দিয়ে আবার একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। এ ধরনের আরো অনেক প্রস্তাব রয়েছে, যা পরস্পরবিরোধী।
দেখা যাচ্ছে যে, কোনো দলের সাথে কোনো দলের সুপারিশের অধিকাংশেরই মিল নেই। তেমনি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেরও মেজর অংশগুলোর সাথে বিএনপির মিল নেই। এমন পরিস্থিতিতে কি তাহলে সংস্কারের সব পরিশ্রম পণ্ড হবে?
রাজনৈতি পর্যবেক্ষকগণ বলেন, যে পদ্ধতিতে ঐকমত্য কমিশন এগোচ্ছে, সেই পদ্ধতিতে কোনো ঐকমত্য হবে না। ঐকমত্য চাইতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আগে বসতে হবে। তাদের নিজেদের মধ্যে ঠিক করতে হবে যে, কোন কোন প্রস্তাবে তারা একমত, আর কোন কোন প্রস্তাবে তারা একমত নন। যেসব প্রস্তাবে তারা একমত, সেসব প্রস্তাব সংকলিত করে তৈরি হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ। যেসব ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না, সেসব ইস্যু ভবিষ্যৎ পার্লামেন্ট অথবা গণপরিষদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
আর ঠিক এখানেই এসেছে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট। ছাত্রদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচন, জুলাই প্রোক্লামেশন এবং সেকেন্ড রিপাবলিক সম্পর্কে আপসহীন। পক্ষান্তরে বিএনপি এ তিনটি বিষয়ের ঘোরতর বিরোধী। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে বিরোধে জড়ালে পিছাতে পারে জাতীয় নির্বাচন।
এমন পটভূমিতে আগামী দিনের রাজনীতির কোনো কমন মিলন কেন্দ্র দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন রকেটের গতিতে বেড়ে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে আরো ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকার আবেদন জানানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের আবেদনে ড. ইউনূস সাড়া দেননি।
সব মিলিয়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলেও সবগুলো দল সাংঘর্ষিক পথ পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক পথে যার যার বক্তব্য তুলে ধরার ব্যাপারে একমত হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে পর্যবেক্ষক মহল এ মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সরকারের উদ্যোগে শেষ মুহূর্তে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
Email: [email protected]