কিশোরগঞ্জে ইজারাদারদের সিন্ডিকেট রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৩৯
আহসানুল হক জুয়েল, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারের ইজারাদারদের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণে সরকার প্রতি বছর হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। সিন্ডিকেটের বেড়াজালে আবদ্ধ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বছরের পর বছর সরকারি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ ধরনের কৌশলের সুযোগে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। অসাধুরা কোটিপতি বনে গেলেও সচরাচর সরকারি ইজারা মূল্যের তেমন একটা পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়নি। নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলার ন্যায় জেলার সকল উপজেলার ইজারাধীন হাট-বাজারগুলোয় এমন দৃশ্য বিদ্যমান। তুলনামূলকভাবে গ্রামগঞ্জের হাটগুলোয় অধিক পরিমাণে এ অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সুকৌশলে করে থাকে প্রভাবশালী মহলের সুবিধাভোগীরা অবৈধ সিডিউল বাণিজ্য। এমনি এক বাস্তবতা মিলে বাজিতপুর উপজেলার ঐতিহাসিক সরারচর হাট-বাজারকে কেন্দ্র করে। কয়েকশত বছরের ঐতিহাসিক এ হাট-বাজারের নামমাত্র ইজারামূল্য নিয়েও সীমাহীন সমালোচনা দীর্ঘদিন থেকেই। এছাড়া রয়েছে হাটের তদারকির বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জানা গেছে, ১৯৭২ সালের দিকে সরকারিভাবে হাটটি পরিপূর্ণভাবে ইজারায় আসে। ইজারা হয় মূলত সরারচর বাজারের নামেই। যার অধীনে রয়েছে গরুর হাটও। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য আর কৌশলের কাছে ইজারা নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে যান দূরদূরান্তের লোকেরা। যে কারণে পূর্বের নামমাত্র মূল্যেই ইজারা ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এবারও গুঞ্জন উঠেছে হাতবদল হলেও কৌশল বদলের সম্ভাবনা খুবই কম। নিকুজিশনের সম্ভাবনাই বেশি রয়েছে। ইতোমধ্যে এ বাজারের দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা।
ঐতিহাসিক হাটটি ঘুরে সরেজমিন দেখা মিলে গরুর হাটের আড়ালে চলে সপ্তাহের শনিবার ব্যতীত অন্য সময়ে সাবলিজ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই চলে এখানকার ব্যবসা। বৃষ্টির মৌসুমে পানি সরানোর ড্রেনের অকার্যকর থাকায় দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায়ও থাকে না। পানি জমাটবদ্ধ হয়ে নোংরা কাদাতে পরিণত হয়ে উঠে অধিকাংশ জায়গা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে হাটের দিনে। বছরের পর বছর ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতাকর্মীরা সুবিধা নিলেও উন্নয়নের দেখা মেলে না এ বাজারে। এ নিয়ে ইজারাদার, সভাপতি ও বাজার কমিটির বিরুদ্ধে সীমাহীন সমালোচনা থাকলেও ইজারাদার মহিউদ্দিনের ভাষ্য, প্রায় ১৮ বছর ইজারা নিয়েছেন সত্য তবে ৭ শতাংশ টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে চলে যায়। বাকিটা স্থানীয় রাজস্ব খাতে। উপজেলা উন্নয়ন কমিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ হাটটির দিকে নজর দেয়নি বলেই উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। তবে শিডিউল বাণিজ্যের বিষয়টি মহিউদ্দিন একেবারেই অস্বীকার করেছেন।
বাজিতপুর উপজেলা অফিস সূত্র নিশ্চিত করেছেন, ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০টির অধিক শিডিউল বিক্রি হয়েছে। ২০ তারিখে শিডিউল ড্র হলে নামমাত্র মূল্যে স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এ বছর ইজারাদার নিযুক্ত হন। শুধু গরুর হাট নয়, সামগ্রিকভাবেই বাজারটিকে বার্ষিক ইজারা দেয়া হয়। ৩ বছরের গড়ের সাথে শতকরা ৬ ভাগ টাকা জমা হয়। গত ২০২৪ সালে বাজারটির ইজারা মূল্য ছিল ৪৩ লাখ ১০০ টাকা। অফিস সূত্র আরও জানায়, ইজারার এ টাকা থেকে ৪১% চলে যায় উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলে, ১৫% বাজারের উন্নয়নে, সরকারি ও চৌকিদারের বেতন বাবদ ১২%, ইউনিয়ন পরিষদকে দেয়া হয় ১০% এছাড়া মুক্তি যোদ্ধাদের জন্যে ৪%সহ অন্যান্য খাতের কথা উল্লেখ করা হয়।
বাজারটির অধীনে রয়েছে কাঁচাবাজার, মাছ, পাট মহল, সরিষা, চাল, মুদি, ভ্রাম্যমাণ দোকানসহ হাঁস-মুরগি, গরু ও ছাগলের পৃথক পৃথক মহল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় এ বাজারের খ্যাতি রয়েছে। এ বাজারে সপ্তাহের শনিবারেই বসে গরুর হাট। এলাকার নাম অনুসারেই এ হাট-বাজারটির নামকরণ করা হয়েছে। জেলার প্রায় অর্ধেক উপজেলার পশু ক্রেতা বিক্রেতাদের সমাগম ঘটে এ হাটে। এছাড়া পশু কেনাবেচার উদ্দেশ্যে শনিবারে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ী লোকজন এসে থাকেন। তবে সেই বাজারের ঐতিহ্য নজরদারির অভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। পার্শ্ববর্তী উপজেলা নিকলীর জারইতলার আঠার বাড়িয়ার গরুর হাট হয়ে উঠেছে তুলনামূলক অনেকটা জমজমাট।
সিন্ডিকেটের কারণে লাখ লাখ টাকা ইজারা মূল্যের বাজার নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিলেও উন্নয়নের পথেও রয়েছে এই হাট-বাজারটির নানা অন্তরায়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নিকলী উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ১৮ বাড়িয়া গরুর হাটের ইজারাদার নিয়োগ করা হয় উন্মুক্ত টেন্ডার এর মাধ্যমে। গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ে ইজারাদার নিযুক্ত করা হয়। ইজারাদার নিযুক্ত হন স্থানীয় সাংবাদিক আলী জামশেদ। এদিকে সরারচর বাজার গরুর হাটের ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে দোকান বানিয়ে সাব-লিজ দিয়েও বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে আক্ষেপের সুরে তারা বলেন, ইজারা মূল্যপ্রতি বছর কাছাকাছি থাকলেও ভাড়া নিয়মিত বেড়েই চলেছে। দুঃখের বিষয় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। গরুর হাটের নোংরা ড্রেইনের আশপাশে দুর্গন্ধ সত্ত্বেও শনিবারের হাটের দিন ব্যতীত সাবলিজে বসে ৮৬টি দোকান। রাখা হয় প্রায় ৮০টি মালবাহী লরি ও ট্রাক।
সরারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন জনান, ঐতিহ্যবাহী এ বাজারে ছোট-বড় সব মিলে প্রায় ১ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। এছাড়া সপ্তাহের শনিবারে বসে ভ্রাম্যমাণ দোকানিরাও। তবে উন্নয়ন প্রশ্নে চুপসে যান।
সরারচর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী মাহফুজ হাসান জানান, ৩ একরের অধিক পরিমাণের সরারচর বাজারে মোট চান্দিনা ভিটির সংখ্যা ৬৫টি। বাজারটি মজলিশপুর মৌজায় পড়েছে ২৮৬ দাগে ১ একর ৭৭ শতাংশ। বাকি মিরাপুর মৌজার ৭৯ দাগে ১ একর ২৬ শতাংশ।
বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারাশিদ বিন এনামের কাছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য বিষয়ে জানতে চাওয়ার জবাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, যদি কেউ বাজার ইজারা নিতে প্রস্তুত থাকেন সেক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে সহযোগিতার কোনোই কমতি থাকবে না। জেলা উপজেলার একাধিক স্থান থেকে সেই সুযোগ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।