আলোকে তিমিরে

শিক্ষাঙ্গন থেকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে যারা এলেন…


১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:২২

॥ মাহবুবুল হক ॥
স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথরের আঘাতে আঘাতে যখন আমরা নিষ্পিষ্ট হচ্ছি, শুধু নিষ্পিষ্ট নয়, ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছি, তখন মহান আল্লাহর তরফ থেকে যে বাহিনী আবাবিল পাখির মতো স্বৈরাচারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই বাহিনী বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। বিষয়টিকে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছি। জাতীয় কবি নজরুলের কথায় ফিরে যাই-
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নতুন সৃজন বেদন
আসছে যারা অনাগত
অসুন্দরের করতে ছেদন।
যুগে যুগে, কালে কালে স্বৈরাচারকে উৎখাত করার জন্য যারা এসেছে, তারা শুধু ভাঙতে বা চুরমার করতে আসেনি। কোনো লক্ষ্য ছাড়া কেউ কোনো বড় অভিযান চালিয়েছে, এমন তো নয়।
কুরআন মাজিদে এ বিষয়ে বেশকিছু কাহিনী রয়েছে। সেসবের মোদ্দাকথা হলো, কোনো জাতি যখন মহান আল্লাহকে মান্য করে না, তাঁর হুকুম-আহকাম মতো তাদের দেশ পরিচালনা করে না, তখন সে দেশটি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। শৃঙ্খলা ও ন্যায়নীতির মধ্যে অবস্থান করে না। ন্যায়বিচার-সুবিচার, কল্যাণ-মঙ্গল, মানবাধিকার পুরোপুরি লোপ পায়। সুনীতি শেষ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তখন হয় ওই জাতিকে ধ্বংস করে দেন অথবা ওই জাতির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অন্য কোনো জাতি বা ওই জাতির অভ্যন্তরের কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা বদলে দেন। অতীতে বহু জাতিকে মহান আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করেছেন। মানুষকে; বিশেষ করে সফরকারীকে এসব ধ্বংস দেখতে বলেছেন এবং সেখান থেকে মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন।
আমরা যদি ফিলিস্তিনের দিকে তাকাই, তাহলে কী দেখি? ক্ষমতায় একবার আসছে মুমিনরা, আবার আসছে মহান আল্লাহর বিধানকে অস্বীকারকারীরা। এভাবেই দুনিয়াটা মাঝে মাঝে জ্বলছে। জুলুম ও অত্যাচারকে আল্লাহ তায়ালা বরদাশত করেন না। যারা জুলুম করে, তারা কখনোই টেকসই হতে পারে না।
বহু রাজত্ব দুনিয়ায় এসেছে, আবার চলে গেছে। বহু ধর্ম, বহু মতবাদ, বহু দর্শন দুনিয়ায় এসেছে আবার চলে গেছে। মন্দ কোনো কিছু দুনিয়ায় চিরস্থায়ী হয় না। এসব সাধারণ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা এসব খুব একটা স্মরণ রাখি বলে মনে হয় না। বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী এসব কথা একদম মনে রাখে না।
যারা মহান আল্লাহর অভিপ্রায়ে আবাবিলের মতো এসেছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তাদের আমরা অভিনন্দন জানাই। তারা অপরিসীম সাহস প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে বা আবেগ দিয়ে বেশিদূর এগোনো যাবে না। যাবে, যদি এর সাথে ঈমান, ঐক্য ও শৃঙ্খলা বরাবর বজায় থাকে। এখন এ নতুন দলের প্রধান কাজ হলোÑ তাদের জনগোষ্ঠীকে মাতৃভাষা বাংলায় করআন বুঝে বুঝে পড়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বড় কাজটি সার্বিকভাবে আমাদের দেশে সম্পন্ন হয়নি। অন্তত ’৪৭-এর পরে প্রথম এ কাজটি করা উচিত ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বড় আকারে কেউ এ কাজটির উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সরকারিভাবে হয়নি এবং বেসরকারিভাবেও হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল এ কাজটি এবার হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সূত্র ধরেই এ জনপদ স্বাধীন হয়েছে। সুতরাং বাংলা ভাষা এখানে উচ্চকিত হবে, সমুজ্জ্বল হবেÑ এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনবিধান ও ধর্মের ক্ষেত্রে এ কাজটি একেবারেই হয়নি।
পাকিস্তান আমলেই এ অঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলা গ্রহণ করা হয়েছিল। কথা ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চালু করা হবে। কিন্তু সত্য হলো, সেটা সেভাবে হয়নি। ইংরেজি পাঠ্যবই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য বাংলা একাডেমি ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড সৃষ্টি করা হলেও, আজ পর্যন্ত সেই কাজটি অসম্পন্ন হয়ে আছে। যারা ইংরেজিতে পড়ালেখা করে, তাদের জন্য উন্নতমানের বই থাকলেও, যারা বাংলামাধ্যমে পড়ালেখা করে, তাদের জন্য উৎকৃষ্ট মানের বই এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত অবস্থায় নেই। সরকারি কাজকর্মে কিছুটা উন্নতি হলেও আইনকানুন ও বিচারের ক্ষেত্রে সেটা এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ হবে বলে মনে হয় না। দৃষ্টিভঙ্গিটাই বড় বাধা। আর ধর্মীয় ক্ষেত্রে তেমন কোনো দৃষ্টিও দেয়া হয়নি। প্রথমেই প্রয়োজন ছিল প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা থাকলে সেসবকে প্রকৃষ্টভাবে সম্পাদনা করা। তারপর অন্তত তিন রকমভাবে ভাষান্তর গ্রন্থ প্রস্তুত করা। শিশু-কিশোর, যুবক ও তরুণ এবং বৃদ্ধদের জন্য পৃথক পৃথক এডিশন করা। বাংলাদেশে শতকরা ৮৫ জন মুসলিম, বাকি ১৫ ভাগে আছেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও নানা জাতি ও উপজাতির মানুষ। সরকারের উচিত ছিল প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থাবলি তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছানো। গ্রন্থাবলির নাম আমরা সবাই জানি। কুরআন মাজিদ, বেদ বা ঋগে¦দ। বার্নাবাসের বাইবেল ও ত্রিপিটক। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে এসব জোগান দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্ম-গোষ্ঠী এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু তেমন কোনো কাজ হয়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে একটি উন্নতমানের বাংলা ভাষায় রচিত কুরআন মাজিদ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেটা আছে। মুসলিমদের সেটা অনেক দামে ক্রয় করতে হয়। কিন্তু মুসলিমদের একটা নৈতিক অধিকার ছিল বিনা হাদিয়ায় তা পাওয়া। কিন্তু এ প্রধান অধিকারটি রক্ষিত হয়নি।
বাংলাদেশের সৌদি অ্যাম্বাসি থেকে ১৯৭০-৮০ দশকে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক বাংলা কুরআন শরীফ লাখ লাখ কপি বিলি করা হয়। সেটা যে আকার ও প্রকারে প্রকাশ করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অধিকন্তু সৌদি সরকার এ কুরআনে ভুল আছে বলে ওই প্রকাশনাটি বন্ধ করে দেয়। ফলে প্রখ্যাত আলেম, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান যে মহান উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তাও পূর্ণতা পায়নি। কুরআন মাজিদের ভাষান্তর সেই প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করেছে বিভিন্ন ইসলামী দল ও গোষ্ঠী এবং ইসলামী প্রকাশনা সংস্থাসমূহ। তারা কম দামে করতে পারছেন না। একই ইতিহাস অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বেলায়ও। এদেশের হিন্দুরা বেদ বা ঋগে¦দ খুঁজে পায় না। খুঁজে পায় রামায়ণ ও মহাভারত। খ্রিস্টানরা দুর্ভাগা, তারা সব ধরনের বাইবেল পায়। কিন্তু আসল বাইবেলটা পায় না। বৌদ্ধরাও আমাদের মতো নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে বলে তাদের মধ্যেও স্বধর্ম জানার ব্যাপারে সরলীকরণ নেই। যে চেষ্টাটা করতে পারত সরকার, সে চেষ্টাটা সাধারণ মানুষ করবে কী করে?
নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির কর্ণধারদের প্রতি আমাদের স্বনির্বন্ধ অনুরোধ রইলÑ তারা এখন থেকেই যেন এ মহান কাজকে উচ্চকিত করতে থাকেন। নিজেরা এ বিষয়ে সচেতন হবেন এবং দেশবাসীকেও সচেতন করবেন। আপনারা যখন সুযোগ পাবেন, তখন রাষ্ট্রিকভাবে এ পুণ্য কাজটি সম্পন্ন করবেন। এ কাজটাও এর সাথে অর্থসহ সালাত আদায় ও প্রতিষ্ঠার কাজটি হরদম করতে পারলে জননৈতিকতার ক্ষেত্রে অন্তত ৫০ ভাগ কাজ অগ্রসর হবে বলে আশা করা যায়।
দ্বিতীয় কাজ যেটা তারা করতে পারেন, তা হলো এদেশের লাখ লাখ কুরআনে হাফেজ ও আলেমের জন্য ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। সবাই জানেন, পূর্বতন সরকারগুলো এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষা শেখানোর তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কুরআনে হাফেজগণ ভালোভাবে বাংলা ভাষা জানেন না এবং যে হাফেজগণ মাদরাসায় পড়ার সুযোগ পান না, তারাই তো কুরআন মাজিদের অর্থও জানেন না। তারা অবিরতভাবে কুরআনের টেক্সট পড়ে যান। নানা সুরে, নানা ভঙ্গিমায়। জানা যায়, সাত রকম সূর আছে। যা হোক এ কথা অবিসংবাদিত সত্য যে, আমাদের দেশে কুরআনের অধিকাংশ হাফেজ কুরআনের অর্থ জানেন না। তারা অরিজিনাল আরবি টেক্সট পাঠ করেন বা আবৃত্তি করেন। বরেণ্য গায়ক নানা ভাষায় ‘গান’ গাইতে পারেন। যত ভাষায় তিনি গান গাইতে পারেন; তত ভাষা তিনি জানেন না। এ চরম সত্যটি এখন আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। কারণ আমাদের জীবনবিধানে আছে- যিনি উন্নতমানের কুরআন জানেন, বোঝেন ও বোঝাতে পারেন, তিনি সালাতে ইমামতি করবেন। এক্ষেত্রে আমরা দুর্ভাগ্যবশত ঠিক করে নিয়েছি, যিনি সহিহভাবে শুধু কুরআন পড়তে পারেন।
এসব আলাপ করলেই বোঝা যায়, আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি। আমাদের যে জীবনবিধান- এটা শুধু ইহকালীন সুখ-শান্তি ও স্বস্তির জন্য নয়। পরকালীন মুক্তি ও শাস্তির জন্য। সেসব আলোচনা থাক। যে কাজগুলো আমরা বা আমাদের পূর্বপুরুষরা করতে পারেননি, এখন সেসব কাজ তরুণদের ওপরেই বর্তাবে। ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ এর ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। কেউ তরুণদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়নি। তরুণরা নিজেরাই যুদ্ধকে আলিঙ্গন করেছেন। যুদ্ধকে ‘আহলান সাহলান’ জানিয়েছেন। কিন্তু সেই যুদ্ধ তো থেমে যায়নি। তরুণরা চাইলেও বা বিশ্ববাসী চাইলেও এ যুদ্ধ থামছে না। আপনারা শুরু করেছেন বৈষম্য নিয়ে, সুতরাং বৈষম্যের মধ্যেই থাকুন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকুন। এ যে ওপরের দুটি বৈষম্যের বিষয়ে আলাপ করলাম, তাতে কী মনে হয় পূর্ববর্তী সরকারসমূহ দেশ, রাষ্ট্র বা জাতির মধ্যে বিরাজিত বৈষম্য কখনো দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে? দেশের মানুষকে ধর্মের দিক থেকে মূর্খ রেখে, জ্ঞানের দিক থেকে অপূর্ণ রেখে, শিক্ষার দিক থেকে অসম্পূর্ণ রেখে আমরা কোন ধরনের জাতি তৈরির চেষ্টা করেছি? যে জাতি তার লক্ষ্য জানে না, ডেসটিনি জানে না, জানে না গন্তব্য। আমরা সালাত আদায় করি। অথচ সালাতে মহান আল্লাহর কাছে যা বলি বা আবৃত্তি করি, তার অর্থ জানি না। এ বিষয়টা একটা চরম মূর্খতা। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব, ওলামা কেউ এসব গভীরভাবে চিন্তাভাবনাও করেন না। সবাই জানেন আলেমগণ অন্তত জীবনবিধানের সবকিছু জানেন। শুধু কুরআন ভালোভাবে জানেন না, বোঝেন না বা বোঝাতে পারেন না।
দুনিয়ায় আমাদের দেশ ছাড়া অন্য কোনা দেশের মানুষ কী যে ভাষা জানেন না বা বোঝেন না। তা কি পড়তে চাইবেন? বরং সে ব্যক্তি বিস্মিত হবেন এ ভদ্রলোক বলে কী? আমি তো ওই ভাষা জানি না, পড়তে পারি না, পড়তে পারলেও এর অর্থ জানি না, তাহলে এটা আমাকে পড়তে হবে কেন?
কিন্তু অন্যরা বিষয়গুলো সহজভাবে বুঝতে পারলেও আমরা বুঝতে পারি না। আমরা ফজিলত ও সওয়াবের মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছি।
রাজনীতির ময়দানে নবীনরা আসছেন। তাদের আমরা আহলান-সাহলান জানাচ্ছি। তাদের এটা জানাতে চাচ্ছি যে, শুধু স্বপ্ন দেখালে হবে না, শুধু ভবিষ্যতের কথা বললে হবে না, পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে, অতীতের ধ্বংসগুলো পরখ করতে হবে। অতীত ছাড়া বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই। বিশেষ করে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ফাস্টটার্ম, মিডটার্ম বা লংটার্ম যে পরিকল্পনাই আপনারা প্রণয়ন করুন না কেন, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বিষয়টি সমুজ্জ্বল করে রাখবেন। আপনারা শিক্ষার ময়দান থেকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং আশা করা যায়, শিক্ষার অমোঘ বিষয়টি অবশ্যই আপনারা ভালো বুঝবেন। পরে ধীরে ধীরে আমরা অন্য নিয়মে যাব, ইনশাআল্লাহ।