আগে বিচার, তারপর নির্বাচন
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:১৭
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
১৬ বছরের স্বৈরশাসন থেকে দেশ মুক্ত হলো আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। শহীদ হলো প্রায় ২ হাজার তাজা তরুণ ছাত্র-জনতা। আহত-পঙ্গু হলো প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা। এ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক ছিল না। গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দরে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে শহীদ ও আহতদের সব তালিকা আমরা এখনো পাইনি। জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সরকারিভাবে এখনো পুরো তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। আমরা সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করবÑ আগে শহীদ ও আহতদের তালিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করুন।
যারা শহীদ হলো সম্মুখসমরে তাদের তালিকার সাথে সাথে হুকুমদাতা ও সরাসরি গুলি করা লোকদের চিহ্নিত করে তাদের বিচার সব কাজের আগে করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য শহীদ আবু সাঈদের কেস আদালতে উঠতে লাগল ৬ মাস। আরো রয়েছে প্রায় ২ হাজার শহীদ। তাদের তালিকা করে প্রত্যেকের বিচার করার উদ্যোগ নিতে হবে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। হুমকি-ধমকি দিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। আমি তাদের বিনীত অনুরোধ করতে চাইÑ খুনিদের বিচারকাজ দ্রুততম সময়ে শেষ করে বাকি কাজে হাত দিতে হবে। দেশটা ছোট। দলে দলে আত্মীয়তার পরিচয় আমাদের বিচারকাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হলো হতাহতের বিচারের কাজে অধিক গুরুত্ব দেয়া।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা মরিয়া তাদের উদ্দেশে কথা হলো আপনারা জুলাই-আগস্টে কারা কোন ময়দানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন? কতজন শহীদ বা আহত হয়েছেন, তা কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকলে আমাদের আরো সাড়ে ৪ বছর অপেক্ষা করতে হতো নির্বাচনের জন্য। তাও আবার সে নির্বাচনে আমরা ভোট দিতে পারতাম না, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাই নিজেদের দল গোছান, এলাকায় চাঁদাবাজি কমান। কারা চাঁদাবাজি করছে, তাদের ধরেন। বাজার-ঘাটে গেলেই চাঁদাবাজদের তালিকা পাওয়া যাবে। স্থানীয় প্রশাসনসহ রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের সমন্বয়ে সংগ্রাম কমিটি করে চাঁদাবাজদের উৎস খুঁজে এবং তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে সাজার ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে দল-মত-ধর্ম দেখা হবে না। আমরা সৎ ও চাঁদাবাজিমুক্ত সমাজ গড়তে চাই। আমরা সবাই একমত হবো জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। সব দলের নির্বাচনে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই। আর কোনো স্বৈরাচার উত্থানের পথ উন্মুক্ত রাখব না। নিজেরা ভালো থাকব, অন্যদের ভালো থাকার বা রাখার ব্যবস্থা করব।
যাদের ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাতিজা আগস্ট বিপ্লবে শহীদ হয়েছে, তাদের আর্তনাদ কি আমাদের চিন্তার মধ্যে আছে। একমাত্র ছেলে শহীদ হয়েছে, তার ভবিষ্যৎ, আশা-আকাক্সক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা কজন তাদের খোঁজ রাখছি। যারা আহত হয়েছে, যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছে তাদের খোঁজখবর কয়জন রাখছি। কয়জন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাদের কয়জনের খোঁজখবর নিচ্ছি।
বাংলাদেশ আমাদের সবার। দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা অধিকার পেতে চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। স্বৈরাচারদের আমরা দেখেছি। বিনা দোষে অনেককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। গুম করা হয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয়েছে। যারা প্রকাশ্যে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের সকলের দায়িত্ব। বিচার না হলে দেশ ভালো করা যাবে না। স্বৈরাচারর বিচার এখন সহজ হয়ে গেছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে শেখ হাসিনাসহ তার দোসরদের গণহত্যার রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। সাথে সাথে সরকারি ও বেসরকারি লোকদের কুখ্যাত আয়নাঘরের রিপোর্টও প্রকাশ পেয়েছে। তাই হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার সহজ হয়ে গেছে। স্বৈরাচারের দোসর বা প্রতিটি বিভাগে এখনো স্বপদে থেকে আগস্ট বিপ্লবের বিরোধিতা করছে। যারা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, তারা তাদের অবৈধ টাকা ঢেলে বর্তমান সরকারকে অকার্যকর করার চেষ্টায় লিপ্ত। আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছি। বঙ্গভবন এখনো স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের দখলে।
সুতরাং আসুন, আগে আমাদের কলিজার টুকরো ছেলেমেয়েদের যারা খুন, গুম করেছে, তাদের বিচার করি। আইনের আওতায় এনে স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে খুনিদের বিচার করে ফাঁসির ব্যবস্থা করি। আইনের মাধ্যমেই আমরা ফাঁসি কার্যকর করতে চাই। বিনা বিচারে আমরা কোনো খুনিকে শাস্তি দিতে চাই না। যেহেতু আগস্ট বিপ্লবের দিনক্ষণ বেশিদিন হয়নি তাই খুনিদের চাক্ষুস সাক্ষী পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। পত্রপত্রিকা, মিডিয়ার বদৌলতে সাক্ষীর মাধ্যমেই বিচারের কাজ সম্পাদন করা যাবে।
ইতোমধ্যে খুনি শেখ হাসিনাসহ তাদের দোসরদের বিচারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। বিচারের সময় যেন আমরা নির্বাচন, নির্বাচন করে না চিল্লাই। নির্বাচন যথাসময়ে হবে। দেশের মানুষ গত ৫৪ বছরে দলবাজ, চাঁদাবাজ লোকদের শাসন দেখেছে। এবার সৎ, যোগ্য লোকদের স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে চায়। আর মানুষ ঠকতে চায় না। গ্রামের মেম্বার-কমিশনার থেকে শুরু করে মেয়র, চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রী সৎ মানুষের শাসন কায়েম করতে চাই। গ্রামগঞ্জে যখন দেখেন সাধারণ ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা কেন্দ্রে কারা চাঁদাবাজি করছে। কোনো তদন্ত কমিটির দরকার হবে না। আমাদের সবারই কমবেশি বাজারে যাওয়ার অভ্যাস আছে। একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখুন না, কারা চাঁদাবাজি করছে। এরা আমার-আপনার ছেলে, ভাই-ভাতিজা। তাদের আগে কন্ট্রোল করুন। পরে নির্বাচনের কথা সামনে আনুন।
মেজর জিয়া থেকে শুরু করে বেগম জিয়া, তারেক জিয়া কেউই চাঁদাবাজদের শাসন চান না। চাঁদাবাজদের মূল্যেৎপাটন করার জন্য আসুন, সব দল-মতের লোক এক হই। চাঁদাবাজ-দখলবাজ সমাজে থাকবে না। আমরা চাঁদাবাজ-দখলবাজমুক্ত করে স্বাধীন নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে আমাদের সৎ-যোগ্য নেতা বানাতে চাই। দেশকে একটি ভালো দেশ হিসেবে দুনিয়ার বুকে তুলে ধরতে চাই।
এখানে বর্তমান সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা না বললেই নয়। তিনি সারা জীবন গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করেছেন। হাজার হাজার গ্রামের মেয়েদের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কাজ করতে গেলে ভুল-ভ্রান্তি হবেই। তিনি কিন্তু স্বৈরাচার হাসিনার মতো লাখকোটি টাকা বিদেশে পাচার করেননি, হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে খুন-গুম করেননি। দেশের আলেম-সমাজ জামায়াতের ৫ নেতাকে স্বৈরাচার হাসিনা ফাঁসি দিয়েছে, তার বিচার আগে করতে হবে। বাকি কাজ আস্তে আস্তে হবে।
ইতোমধ্যে বাজারে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজে বাজারে গিয়ে বাজার মনিটরিং করছেন। ভালো উদ্যোগ। রমজানে পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকার নিচে। টমেটো ১৫-২০ টাকা কেজি। ধৈর্য ধরুন। সবকিছুই আমরা করতে পারব, ইনশাআল্লাহ। তাই আগস্ট বিপ্লবের খুনিদের আগে বিচার করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই ভোটার লিস্ট আপডেটের কাজ করছেন। আশা করা যায়, এবার গায়েবি ভোটার লিস্ট হবে না। নির্বাচন কমিশন ভোট নেয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেই ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করা যাবে।
আরেকটি কথা একটু জোর দিয়ে বলতে চাই। ভোট প্রথমে স্থানীয়ভাবেই করতে হবে। কারণ একজন গ্রামের মেম্বার, কমিশনারকে যেভাবে সাধারণ মানুষ চিনতে পারবে। সৎ, যোগ্য লোককে ভোট দিতে পারবে বিনা প্ররোচনায়। এমপি ভোট কিন্তু সেভাবে হবে না। স্বৈরাচারের দোসররা টাকার থলে নিয়ে মানুষ কেনার ব্যবস্থা করবে। খারাপ লোকদের নির্বাচিত হওয়ার দ্বার খুলে যাবে। আগস্ট বিপ্লবের চেতনায় আমরা স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ ও ভালো লোকদের নির্বাচন করে স্থানীয়ভাবে এলাকার উন্নয়নে সহযোগিতা করতে চাই এর কোনো বিকল্প নেই। চাঁদাবাজদের সহযোগী ছাড়া সবাই দল-মত নির্বিশেষে স্থানীয় নির্বাচন করার পক্ষে আসবে, যারা সৎ-যোগ্য লোক নির্বাচিত করতে চায়। এখানে টাকার ছড়াছড়ি করার সুযোগ কম। স্থানীয়ভাবে প্রত্যক্ষ করেই সৎ, যোগ্য লোক বাছাই করবে জনগণ। তাই কে কী বলল, সেদিকে না তাকিয়ে সরকারকে বলব, আগে স্থানীয় নির্বাচন দিন। পরে জাতীয় নির্বাচন করা যাবে। নির্বাচন কমিশনারেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে, তারা সঠিকভাবে ভোট নিতে পারদর্শী কিনা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিমত ৬৪টি জেলায় প্রতিদিন দুটি জেলায় স্থানীয় নির্বাচনের তারিখ দিলে মোট ৩২ দিনে সব স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে। প্রশাসনিক লোকবল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরীক্ষা হয়ে যাবে। স্বল্প পরিসরে নির্বাচনকালে সহজে নিয়মনীতি রক্ষা করা সম্ভব হবে। গত ৮ মার্চ শনিবার দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেন্টার ফর পলিসি এনালাইসিস এন্ড এডভোকেসির উদ্যোগে সেমিনারে সৎ, যোগ্য ও চাঁদাবাজ মুক্ত ভোটের জন্য স্থানীয় নির্বাচন আগে দেয়ার ব্যাপারে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিটির প্রস্তাবের আলোকে স্থানীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও বিবেচনা করা যেতে পারে। মূলকথা হলো- সর্বক্ষেত্রেই সৎ, যোগ্য, চাঁদাবাজমুক্ত লোক আমরা নির্বাচিত দেখতে চাই। এক্ষেত্রে প্রার্থীর টাকাও কম খরচ হবে। নির্বাচিত হয়ে খরচ উঠানোর চিন্তা করতে হবে না। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় দ্বন্দ্ব-কলহ শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে নির্বাচিত সৎ, যোগ্য লোকেরা স্থানীয়ভাবে প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রামগঞ্জে শান্তি-শৃঙ্খলা আয়ত্তে আনতে পারবে। লোকজন ভালো লোকের প্রভাবে নিজেরা ভালো থাকবে। অন্যকেও ভালো থাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে। আমরা ভালোর সাথে আছি। মন্দকে বর্জন করে দেশকে ভালো দেশে পরিণত করতে চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।