বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে কেন মেনে নিতে পারছে না ভারত?


১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:১৫

সরদার আবদুর রহমান : বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ভারত। প্রশ্ন উঠছেÑ এটি কেন? বাংলাদেশের এ পরিবর্তন কেবলই রাজনৈতিক হলেও ভারত কি এর বাইরেও অন্য কিছু দেখছে? প্রায় সাত মাস হতে চললো, তথাপি ভারত কেন যেন ধাতস্থ হতে পারছে না। পারছে না তার ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠতে। বিশ্লেষকরা বলে আসছেন, একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হতেই পারে এবং সেটি সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু এ পরিবর্তনের বিষয়টি ভারতীয় পক্ষ এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতির ওপর আগামীর অনেক কিছুই নির্ভর করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সরকার বদলের পর বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও স্বাভাবিক হচ্ছে না কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক। এ নিয়ে এক প্রবল অস্থিরতা বিরাজ করছে ভারতের শাসক মহলে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বৃহৎ দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেন অতি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
হাসিনার প্রতি ভারতের কৃতজ্ঞতা
তাহলে কি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছিলেন, সেটি একশত ভাগ সত্য? তিনি বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে যা দিয়েছে, দেশটিকে তা সারা জীবন মনে রাখতে হবে।” ২০১৮ সালের ৩০ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।”
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনি এর কোনো প্রতিদান চেয়েছেন কিনা? চাইলে কোনো আশ্বাস পেয়েছেন কিনা।’ জবাবে হাসিনা বলেন, ‘আমি কোনো প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেয়ার অভ্যাস বেশি।’
হাসিনা প্রকাশ্যে যা দিয়েছেন, তা বিভিন্ন চুক্তি ও মেমোরেন্ডামে উল্লেখ আছে। তবে গোপনে হয়তো এমন কিছু দিয়েছেন, যা একমাত্র তিনি এবং তার একান্ত ঘনিষ্ঠরা জেনে থাকবেন। এ চরম পাওয়া এখন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বেদনার ভার হয়তো সামলাতে পারছেন না ভারতীয় নীতিনির্ধারকগণ।
প্রসঙ্গ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ
হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশের নির্বাচনে দুর্নীতির বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলা হতো ‘এটি সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ আর এখন ভারতের সেনাপ্রধান পর্যন্ত বলতে ছাড়ছেন না যে, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হলে সম্পর্কের উন্নতি হবে। ‘সরকার পাল্টালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র ত্রিবেদী। গত ৮ মার্চ শনিবার নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভের এক অধিবেশনে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলার সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ কথা বলেন তিনি। এর আগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন দেশটিতে সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এ বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়সহ বাংলাদেশ ও ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। ৬ মার্চ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ৫ মার্চ জয়শঙ্কর ও ডেভিড ল্যামি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। দুই মন্ত্রী ইউক্রেন, বাংলাদেশ, পশ্চিম এশিয়া ও কমনওয়েলথ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠছেÑ ভারত কি বাংলাদেশে সরকার বদল আর ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরিস্থিতি এক করে দেখাতে চাচ্ছেন? এছাড়া গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু ট্রাম্প তাতে পাত্তা দেননি বলে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়।
তারও আগে গত ২৫ জানুয়ারি কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারে এক সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সেই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, তা নিয়ে দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে বলে জানান ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি। সভায় তিনি জানান, ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা অজিত দোভালের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে এবং সে বৈঠকের বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশ এবং এর সম্ভাব্য নির্বাচন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। আলোচনায়ও অংশ নিয়েছি। বাংলাদেশ ইস্যুতে আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল নির্বাচন। কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে- এ নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে।’
এখন প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশে পরপর তিনটি নির্বাচন হয়েছে, যার তিনটিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ তথা বিশ্ববাসী সেই নির্বাচনগুলোকে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি। সেসব ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী ছিল? ভারত কি এসব নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গেয়ে যায়নি? পোকায় খাওয়া এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের কি ইন্ধন ছিল না? এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার নৈতিক সাহস কি তাদের আছে? তাহলে তারা কোন মুখে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলে?
সর্বশেষ অবস্থান
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগই যেন পছন্দ হচ্ছে না ভারত সরকারের। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ‘হাসিনাবিহীন’ সরকারকে মেনে নিতে না পারা। অতি সম্প্রতি দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। বিবিসি জানায়, এ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে কথিত হিন্দু নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে ভারত সরকার যা যা বলেছে, তার কোনটিই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রশংসাসূচক নয়। সম্প্রতি ভারতের আমন্ত্রণে দ্বিপাক্ষিক স্তরে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে যেসব বৈঠক হয়েছে, সেগুলোকেও ‘রুটিন বৈঠক’ বলে বর্ণনা করে সেগুলোর গুরুত্ব খাটো করে দেখাতে চেয়েছে ভারত। অর্থাৎ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ভারতের দিক থেকেও তাগিদ আছে, বিষয়টাকে যাতে সেভাবে ব্যাখ্যা না করা হয়, মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কথাতে পরিষ্কার সেই ইঙ্গিত ছিল। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নেও দিল্লির অবস্থান যে ‘আগের মতোই’ আছে, সেটাও জানিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে ভারত মনে করছে না, মুখপাত্রের কথা থেকে তা কার্যত স্পষ্ট হয়ে গেছে।
এখন কথা হলো, যেসব বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্রিফিংয়ের বিষয় হিসেবে বক্তব্য দিয়েছে সেসব বিষয় তো ভারতেও বিরাজমান। তাহলে বাংলাদেশও বলতে পারবে ভারতে কী প্রকারে মুসলিম ও দলিত নির্যাতন হয়। ভারতের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ কি উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারবে? তখন কি সেটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত হবে?
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ‘কোনো অবনতি হয়নি’ এবং ‘সম্পর্ক সবসময় ভালো আছে’ বলে সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তবে ভারতের পক্ষ থেকে কার্যত স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে গতি-প্রকৃতি, তাতে ভারতের দৃষ্টিতে অন্তত কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিবিসি বলছে, এদিন ভারত সরকারের অন্তত তিন-চারটি বক্তব্য থেকে তাদের এ মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগেও তারা এ প্রশ্নগুলোয় যে সুরে কথা বলেছিলেন, আজও অবিকল সেই ভাষা ও ভঙ্গিতেই অভিযোগগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন।
এ পরিস্থিতির একটি সংক্ষিপ্ত ‘মূল্যায়ন’ দিয়েছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ। গত ৮ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন ‘বাংলাদেশকে ভারতের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের দেখা ঠিক হবে না।’ ড্যানিলোভিচ বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ‘মিথ্যা প্রচারণা’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তথ্য যুদ্ধের সম্মুখীন। এর বড় অংশটি চালানো হয় ভারত থেকে। ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণ করছে, তা ভারতের স্বার্থের জন্য অনুকূল নয়।’