গঙ্গায় পানিবণ্টন নিয়ে ঢাকা-দিল্লি বৈঠক ব্যর্থ
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:০৬
স্টাফ রিপোর্টার : ফারাক্কায় গঙ্গার পানি মাপার পর দুদিন ধরে বৈঠক করেও একমত হতে পারলেন না বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিরা। প্রথম দিকে সব ঠিকঠাক এগোলেও শেষ পর্যন্ত আলোচনায় জটিলতা দেখা দেয়। আগামী ২০২৬ সালে শেষ হবে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। এ চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতেই নতুন চুক্তির প্রস্তাব করতে চায় বাংলাদেশ ও ভারত। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পরিদর্শনসহ ভারতের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। সরেজমিন ফারাক্কায় পানিবণ্টন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বর্তমানে গঙ্গায় তুলনামূলক পানি কম থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।
জানা গেছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম দিন গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়। দুই দেশের প্রতিনিধিদলের নেতা বৈঠকের সারসংক্ষেপে সই করেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের বৈঠক ছিল সীমান্তের নদীগুলো নিয়ে। সেই বৈঠকের পর সারসংক্ষেপে সই হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা মোহাম্মদ আবুল হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, পরিকল্পনামতো আমাদের বৈঠক হয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কেউ মুখ খোলেননি। বৈঠক শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন হয়নি। কেউ কোনো কথা বলেননি। গত ৭ মার্চ শুক্রবারের বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি, বন্যা রিপোর্ট, সীমান্ত নদীগুলোকে কেন্দ্র করে দুই দেশের পরিকল্পনা। একাধিক বিষয়ের আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারার কারণে বৈঠকের পর এখনো কোনো সারসংক্ষেপ সই করা হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত বছর বন্যায় একাধিক সীমান্ত নদিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেশকিছু জায়গায় বাঁধ ভেঙে পড়েছে। সীমান্ত নদী হওয়ার কারণে এ মেরামতির জন্য দুই দেশের সম্মতি প্রয়োজন। সূত্র জানাচ্ছে, ৭ মার্চের মিটিংয়ে বাংলাদেশ এ নদীগুলোর মেরামতের কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত এখনো তাদের সম্মতি দেয়নি। তারা বিষয়টি আগে খতিয়ে দেখতে চায়। তথ্য ভাগাভাগির বিষয়টি আলোচনা হয়েছে এবং ভারত তাতে রাজি থাকলেও তা সারসংক্ষেপের খাতায় তোলা নিয়ে সমস্যা দেখা যায়। ফলে শেষ পর্যন্ত সারসংক্ষেপে-এ সই হয়নি।
গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি মেনে পানি ভাগাভাগি হচ্ছে কিনা, তা দেখতে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ভারতে যান। এ বছর ৪ মার্চ ফারাক্কায় গিয়ে পানি মাপার পর তারা জানিয়েছিলেন ভাগাভাগি নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। যদিও তারা এও জানান, এ বছর নদীতে পানি কম থাকায় দুই দেশই পানি কম পাচ্ছে। এরপর ৬ মার্চ ভারত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে গঙ্গা পানিবণ্টন, গঙ্গায় কম পানি এবং নদীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। মিটিং শেষে আলোচনার সারাংশে সই করেন ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব শরদ চন্দ্র এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন। তবে ৭ মার্চের বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলো নিয়ে জটিলতা কেটে গেলে পরবর্তীকালে সই হতে পারে।
জানা গেছে, যৌথ নদী কমিশন ভারত যাওয়ার আগে দাবি করেছিল, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি করবে দুই দেশ। কমিশন এ বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটিও করেছে। কমিটির মতামত অনুযায়ী, ভারতের নদী কমিশনকে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। ৬ মার্চ বৃহস্পতি ও ৭ মার্চ শুক্রবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হোটেলে ফারাক্কায় যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন।
এ বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি বাস্তবায়নের পর থেকেই প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আমাদের চার সদস্যের দল এবং ভারতের চার সদস্যের দলের উপস্থিতিতে প্রতিদিন চারবার গঙ্গার পানি মাপা হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী যার যতটুকু পানি পাওয়ার, তা ভাগ করে নেয়। আর এ বিষয়গুলো ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করতে দিল্লি ও ঢাকা থেকে উচ্চপর্যায়ের কমিটি যায় এবং চুক্তি ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না বা আমরা যতটুকু পানি পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছি কি না, সে বিষয়গুলোই তখন পরীক্ষা করা হয়। আমরা গত ৪ মার্চ মঙ্গলবার ফারাক্কা গিয়েছিলাম, সবকিছুই পরীক্ষা করেছি। কোথাও সমস্যা নেই। ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার আমরা কলকাতায় এসে যৌথ বৈঠক করেছি।
কী আছে চুক্তিতে
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গা নদীতে যে পানিপ্রবাহ তৈরি হয়, সেটি দুই দেশ ভাগ করে নেয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে দুই দেশ সমান সমান, অর্থাৎ মোট পানির ৫০ শতাংশ করে পাবে। আর পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেকের বেশি কিন্তু সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে বাংলাদেশ পাবে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার কিউসেক, অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত। কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক রেখে বাকি পানি বাংলাদেশকে দিয়ে দেবে। এই পানি ভাগ হয় প্রতি ১০ দিনের পানির পরিমাণ হিসাব করে। তবে চুক্তিতে শর্ত রয়েছে যে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ও ভারত ১০ দিন ১০ দিন করে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। অর্থাৎ ১১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে, তার পরের ১০ দিন ভারত গ্যারান্টিযুক্তভাবে ২৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। এভাবে ১০ মে পর্যন্ত চলতে থাকবে। এ সময়ে পানির প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সেজন্য উভয় দেশ প্রতি দশ দিনে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে চুক্তিতে এ শর্ত রেখেছে।
যৌথ নদী কমিশন সূত্রমতে, এ চুক্তি করা হয়েছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গঙ্গা নদীর পানির গড় প্রবাহ ধরে। এ চুক্তি অনুযায়ী গত ২৮ বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারত পানি ভাগ করে আসছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৭ কিউসেক পানি পেয়েছে। আর এ সময়ে ভারত পেয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৮ কিউসেক পানি। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ২০২৪ সালে হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনায় রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে এ নিয়ে চুক্তি হয়নি।