বিডিআর ম্যাসাকারের নেপথ্যের কালো হাত


১৩ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩৮

॥ জামশেদ মেহ্দী ॥
শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৫০ দিনের মাথায় ঘটে যায় সেই ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক ঘটনা। পিলখানা বিডিআর ক্যাম্পে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এ গণহত্যার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অসংখ্য লেখালেখি হয়। অনেক লেখালেখি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনায় বলা হয় যে, এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পেছনে আওয়ামী লীগ এবং ভারতের হাত রয়েছে। এ বীভৎস হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরপর তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোনো কমিটিই রিপোর্ট সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এমনকি সেই অসম্পূর্ণ রিপোর্টও দিনের আলোর মুখ দেখেনি। এগুলো সব হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের কঠোর স্বৈরাচারী শাসনে এ বিষয়টি হিমঘরেই পড়ে ছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ২২ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। এ কমিশনের প্রধান হলেন বিখ্যাত বড়াইবাড়ী-পদুয়া অভিযানের বীর সেনানী, মুক্তিযোদ্ধা এবং বিডিআরের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান। এ কমিটিকে সময় দেওয়া হয়েছে ৩ মাস। সেই অনুযায়ী আগামী ২২ মার্চ কমিশনের রিপোর্ট দাখিলের কথা। অবশ্য যদি কমিশন সময় চায়, তাহলে হয়তো দাখিলের সময় বাড়তেও পারে।
গত ৮ মার্চের খবরে প্রকাশ, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনকে সাক্ষ্য দিতে ডেকেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিশনের ধানমন্ডি কার্যালয়ে হাজির হয়ে বা অনলাইনে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে। যাদের সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক, জামালপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি মির্জা আজম, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক এমপি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের তৎকালীন অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ শামসুল আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মঈন উ আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় আমি একটি ফোন পেলাম। ফোনের ওধার থেকে বলা হলো যে, এই মাত্র সে একটি ভারতীয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে একটি সংবাদ শুনেছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, বিডিআরের তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল শাকিলকে গুলি করে মারা হয়েছে। তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশের রেডিও এবং টিভি অন করলাম। কিন্তু এ-সংক্রান্ত কোনো খবর নাই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হওয়ার আগেই ভারতীয় গণমাধ্যমে এ খবর সম্প্রচারিত হলো কীভাবে? তাহলে কি যারা ঘাতক, তাদের সাথে ভারতের কোনো যোগাযোগ রয়েছে? উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে ৯টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে জেনারেল শাকিলকে হত্যা করা হয়। আরো জানা গেল, জেনারেল শাকিলের স্ত্রী এবং বিডিআরের ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার মুজিবকেও হত্যা করা হয়েছে। দুপুর ২টার দিকে হাজারীবাগের সুয়ারেজ ড্রেন দিয়ে কর্নেল এনায়েত এবং কর্নেল মুজিবের লাশ বেরিয়ে যেতে দেখা গেল। ঐদিন বিকাল ৩টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘাতকদের সাথে বৈঠক করেন।
পরদিন একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকার ৬ মার্চের সংখ্যায় ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির (অব.) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। হাসান নাসির প্রথম তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। তার লেখা থেকে জানা যায় যে, ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দীর্ঘসময় পিলখানায় কাটিয়েছেন। দুজন মন্ত্রী ২৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পিলখানায় অবস্থানের পরও পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি আবার সেনা অফিসাররা নিহত হলেন কেন? এর মধ্যে ঐ তদন্ত কমিটির মতিগতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফলে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ঐ তদন্ত কমিটি বাতিল করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ১টার দিকে জানা যায় যে, এবার দ্বিতীয় কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটির প্রধান একজন সিভিলিয়ান। নাম আনিসুজ্জামান। ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসিরকে এ কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়।
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ভারত সফর থেকে ফিরে আসার পর কতিপয় আর্মি অফিসারকে বিডিআরে পোস্টিং দেওয়া হয়। এমন অফিসারকেও পোস্টিং দেওয়া হয়, যারা ২৩ ফেব্রুয়ারিতেও জয়েন করেছেন। এই যে নতুন করে শেষ মুহূর্তে পোস্টিং দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ অফিসারই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রশ্ন ওঠেÑ তাহলে শেষ মুহূর্তে এসব পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল কেন? এদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল গুলজার, ক্যাপ্টেন তানভিরসহ আরো অনেকে। বিডিআর বিদ্রোহে সায় দেওয়ার অভিযোগে বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর রাজশাহী কারাগারে তার হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু ৬-৭ ঘণ্টা পর ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পাঠান। মেডিকেল কলেজে আনার পর দেখা যায়, তিনি ইতোমধ্যেই মারা গেছেন।
ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসিরের বর্ণনা মোতাবেক, অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার তোরাব আলী এবং তার ছেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটন এর দু-একদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথে গোপন বৈঠক করেছেন। কল রেকর্ড চেক করে দেখা যায় যে, এ সুবেদারের কাছে ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে একটা মিসডকল ও চারটা কল করা হয়। ভারত থেকেও চারটা কল হয়। তার কাছে দেশের বাইরে থেকে কল এসেছে ৯টি। রিপোর্ট মোতাবেক, ঐ সময় তোরাব আলীসহ ৫-৬ জন আওয়ামী লীগ নেতার কাছে অন্তত ৩০০টি টেলিফোন কল আসে। এর মধ্যে অন্তত ১০০টি কল ডিলিট করা হয়। কর্নেল শামসসহ ৪ জন সেনা অফিসার এ হত্যাকাণ্ডের মধ্যেও বিকাল ৩টার দিকে শেখ হাসিনার অফিস যমুনায় যান। সেখানে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বদলি করে এসএসএফে নেওয়া হয়। বলা হয়, এভাবে বদলি করে কর্নেল শামসকে বাঁচানো হয়।
জেনারেল শাকিলসহ কয়েকজন সেনা অফিসারকে সকাল পৌনে ১০টার মধ্যে হত্যা করা হয়। কিন্তু সকাল ১০টার সময় এটিএন নিউজের রিপোর্টার মুন্নি সাহা কীভাবে একজন বিদ্রোহীর সাথে কথা বলেন? সাত মসজিদ রোডে যে গেট রয়েছে, সেখান থেকে পূর্ব দিকে সামান্য এগোলে আম্বালা সুইটস। সেখানে গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। অথচ তিনি ভেতরের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি। বিকাল ৩টায় ১৪ জন বিডিআর জওয়ান যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। এর আগেই কিন্তু ৫ থেকে ৬ সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। দুপুর ২টায় দুজনের ডেড বডি পাওয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। যারা তার আগেই সেনা অফিসারের রক্তে হাত লাল করেছেন, তাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে আলোচনায় বসেন? ওরা যমুনায় পৌঁছার আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যমুনায় বৈঠক করছিলেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর তিন প্রধান। বিদ্রোহীরা যমুনায় পৌঁছার পর প্রধানমন্ত্রীকে জানান যে, কোনো মিলিটারি অফিসার থাকলে তারা বৈঠক করবে না। তাদের কথা অনুযায়ী ৩ বাহিনীর প্রধানকে ঐ কক্ষ থেকে চলে যেতে হয়। যেখানে তাদেরকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা উচিত ছিল, সেখানে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং ঐদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ঐ ১৪ ঘাতক প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফিরে এসে ঐ রাতে এবং পরদিন আবার গণহত্যা শুরু করে।
২৪ তারিখ রাতে নীলক্ষেত মোড়ে একটা পেট্রোল পাম্প আছে, সেটার মালিক ডিজি জেনারেল শাকিলকে সরাসরি ফোন দেন। তিনি বলেন, ২৫ তারিখ যে দরবার হওয়ার কথা আছে- আপনি সেখানে যাবেন না, আপনাকে মেরে ফেলা হবে। ঐ পাম্প মালিককে সাক্ষী দেওয়ার জন্য খোঁজা হয়েছিল। কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় যে কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেখানে সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডিজিএফআই, ডিজিএনএসআই কেউই আসেননি।
২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় একটি ডিনার ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঐ ডিনারে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যাননি। বেগম খালেদা জিয় প্রশ্ন করেছেনÑ কেন হাসিনা ঐ ডিনারে যাননি? কনক সরওয়ারের নিউজে তিনি বলেছেন, হাসিনা ক্ষমতায় আসার এক-দেড় মাস পরই কেন এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটালেন? তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, হাসিনা এবং সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন এটা নিশ্চয়ই জানতেন। তিনি বলেন, তিনিসহ সব প্রধানমন্ত্রী বিডিআরের এ বার্ষিক ডিনারে যোগদান করেন। এটাই রেওয়াজ। কিন্তু হাসিনা ২৪ ফেব্রুয়ারি কেন যাননি? এর একদিন আগে বিডিআর থেকে তিনটি সাব মেশিন গান হারিয়ে যায়। এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা, যা কোনোদিন ঘটেনি।
২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট বিডিআর গেটে উপস্থিত হয়। তারা দেখে যে, তার আগেই র‌্যাবের একটি ইউনিট সেখানে পৌঁছে গেছে। র‌্যাব কেন ভেতরে ঢুকছে না, সেটি আর্মি ইউনিট জানতে চায়। তারা বলে যে, ওপরের নির্দেশে তারা ভেতরে ঢুকছে না। আর্মি ইউনিটকে পিলখানার ভেতর থেকে একটি রকেট ছোড়া হয়। ফলে একজন আর্মি জওয়ান নাকি মারা যান। এরপর আর তো কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। বরং এ ঘটনা জানালে ওপর থেকে নাকি নির্দেশ আসে যে তোমরা ২ মাইল দূরে সরে যাও। যেখানে কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করে আর্মি ইউনিটের ভেতরে ঢোকার কথা এবং বিদ্রোহীদের ক্রাশ করার কথা, সেখানে পেছনে হটার আদেশ সত্যি রহস্যময়।
ফরেন এলিমেন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবারের একজন বলেছেন, আমার বাসায় যে ১০-১২ জন সৈনিক ঢুকেছে, তাদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলেছে। আরো জানতে পারি বিভিন্ন জায়গায় হিন্দিতে কথা বলা সৈনিক ছিল। আরো অনেক সৈনিক পেয়েছি যাদের মুখ বাঁধা ছিল তারা নিজেদের লুকাচ্ছিল। আর বিডিআররা কিন্তু নিজেদের লুকায়নি। ওইদিন সকালে একটা ট্রাক- যে ট্রাকে ন্যাশনাল লেবেলের খেলোয়াড়রা খোলা মাঠে যায়, আবার ফিরে আসে। ধারণা করা হয়, এই ট্রাকে একটা গ্রুপ ঢুকে পড়ে। তাদের ড্রেস বাইরে সিভিলে বানানো হয়। ২৫ তারিখ রাতে অকস্মাৎ সমগ্র পিলখানায় বিদুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রাত ৮টার দিকে চারটা অ্যাম্বুলেন্স কোনো ধরনের মার্কিং নেই দ্রুতবেগে ভেতরে গেল। কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করলো না। তারা আবার ভর্তি হয়ে বের হলো, কেউ তাদের চেক করলো না। এরকম ঘটনায় ঢোকা এবং বের হবার সময় চেক হবে। কোনো ধরনের চেক হলো না। কোনো নম্বরও ছিল না গাড়িতে। ধারণা করা হয় যে ভারতীয় এবং আওয়ামী লীগের যেসব সশস্ত্র ব্যক্তি ভেতরে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তাদের পার করে দেওয়ার জন্যই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এরপর ওরা ঢাকা বিমানবন্দরে যায়। সেখান থেকে দুবাই। তখন খবর প্রকাশিত হয় যে, এসব রহস্যময় ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ঐ বিমানটিও নাকি ২ ঘণ্টা পর আকাশে উড্ডয়ন করে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ৪ দিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি দুই বাংলার মিলনমেলার আড়ালে বেনাপোল বর্ডারের বিডিআর সদস্যদের জন্য মিষ্টি পাঠানোর নামে সেই মিষ্টি ভারত থেকে যারা এনেছিলেন তারা ঢাকায় আসে, ওইসময় কোনো পাসপোর্ট ভিসার ব্যাপার ছিল না। বর্ডার ওপেন করে দেয়া হয়। ঢাকায় যারা মিষ্টিগুলো নিয়ে এসেছিল, ওদেরই খুনি বলে সন্দেহ করা হয়।
ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার ৭ মার্চ একটি উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বাসাতে হাবিলদার মনির, সিপাহি শাহাব, সিপাহি মনির বৈঠক করেন। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় বিডিআর দরবারসংলগ্ন মাঠে সিপাহি কাজল, সেলিম, মঈন, রেজা এবং বেসামরিক ব্যক্তি জাকিরসহ কয়েকজন বৈঠক করেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় রাজধানীর বনানীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের বাসায় বিডিআরের ডিএডি হাবিব, ডিএডি জলিল, ল্যান্সনায়েক রেজাউল, হাবিলদার মনির, সিপাহি সেলিম, কাজল, শাহাবউদ্দিন, একরাম, আইয়ুব, মঈন, রুবেল, মাসুদ, শাহাদত ও জাকির (বেসামরিক) বৈঠক করেন। এর আগে-পরেও বিডিআর সদস্যরা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। সুবেদার গোফরান মল্লিক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।
উইকিলিকসে উন্মুক্ত হওয়া নথিতে জানা যায়, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিব শংকর মেননকে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। সোয়াচের অধ্যাপক আভিনাশ পালিওয়াল তার সাম্প্রতিক বইতে জানিয়েছেন, হাসিনাকে উদ্ধার করতে তখন প্রায় ১০০০ ভারতীয় ছত্রীসেনা পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুণ্ডা বিমানঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদকে ভারত সতর্ক করেÑ বিদ্রোহী জওয়ানদের ধরার চেষ্টা যাতে না করা হয়। অন্যথায় ভারত সামরিক হামলা চালাবে। এতে জেনারেল মইন পিছিয়ে আসেন।
এ ধরনের আরো অনেক তথ্য বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়। তবে যে ১৫ জনকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে, সেটা দেখে মনে হয় যে জেনারেল ফজলুর রহমানের তদন্ত কমিশন সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
এ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর আরো তিনটি গণহত্যা হয়েছে। এগুলো হলো আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর সারা দেশে যে বিক্ষোভ হয়, সেই বিক্ষোভে নির্বিচার গুলি করে ২৫৩ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হেভি ক্র্যাকডাউন করা হয়। এর ফলে সহস্রাধিক আলেম-ওলামা শহীদ হন বলে হেফাজত দাবি করেছে। এছাড়া শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে আয়নাঘরসহ বিভিন্ন বন্দিশালায় গুম করে যাদের আনা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৩৩৩ জনের খবর এখনো পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে ওরা আর কেউ বেঁচে নাই। সব শেষে জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা।
ওপরের এ সুদীর্ঘ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার শুরুটি হয় পিলখানা ম্যাসাকার দিয়ে। এ সিরিয়াল গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রকামী এবং ইসলামী জনতাকে নিশ্চিহ্ন করা।
এ সম্পর্কে নিউইয়র্কের ইউটিউবার ইলিয়াস হোসেনের এক ঘণ্টাব্যাপী ভিডিও ফুটেজে অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন। শিরোনাম, ‘শ্বাসরুদ্ধকর ৩৩ ঘণ্টা ও পরের ১৬ বছর’।