কটিয়াদীতে চিকিৎসক সংকট


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:৫৮

কটিয়াদী উপজেলা সংবাদদাতা : কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। প্রায় ৪ লাখ মানুষের একমাত্র চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র এ হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এতে অনেক সময় রোগীরা সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেশি খরচে বেসরকারি হাসপাতালে নিচ্ছেন চিকিৎসা সেবা।
৩৩ কোটি টাকায় নির্মিত হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের অনুমোদন মিলছে না ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির। নবনির্মিত ভবনটি কাজে আসছে না জনসাধারণের সেবার জন্য। নবনির্মিত ভবনটির মূল ফটকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ৫০ শয্যার কাঠামোয়ও জনবল সংকট। রয়েছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা। স্বাস্থ্যসেবা চরম বিঘ্নিত। জটিল রোগীরা যথাসময়ে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পাচ্ছে না।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় চার বছর পূর্বে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মো. আব্দুল মান্নানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ শয্যা হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেন। বিগত বছরে মে মাসের মাঝামাঝি বাস্তবায়িত প্রকল্প হস্তান্তর করা হয়। সেখানে রয়েছে একটি চারতলা, একটি সাততলা বিশিষ্ট সুবিশাল ভবন। ভবনে রয়েছে অপারেশন থিয়েটার, পরীক্ষা নিরীক্ষার ল্যাব, এক্স-রে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। উন্নত বিদ্যুৎ সঞ্চালনসহ জেনারেটর ব্যবস্থা। আছে অক্সিজেন প্লান্ট। কমপ্লেক্স সীমানার ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে ডাক্তার এবং অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে এলাকাবাসী চিকিৎসাসেবা নিয়ে আশান্বিত হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ১০০ শয্যার হাসপাতালের প্রশাসনিক অনুমোদন না হওয়ায় তালাবদ্ধ রয়েছে সকল কার্যক্রম। সেই আগের ৫০ শয্যা হাসপাতাল কাঠামোর ভিত্তিতেই ঠাসাঠাসি ঘিঞ্জি পরিবেশে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। ৫০ শয্যার হাসপাতাল কাঠামোয় যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন তাও নেই। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। কাক্সিক্ষত সুফল এখনো পাচ্ছে না এলাকাবাসী। ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কাঠামোয় চারটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ চিকিৎসক পদ রয়েছে ৩১ জনের। এর মধ্যে ১৭ জন চিকিৎসক পদায়ন থাকলেও ৫ জন চিকিৎসক ডেপুটেশনে এবং সংযুক্তিতে রাজধানী ঢাকা কিংবা তাদের সুবিধাজনক স্থানে রয়েছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। ফলে ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ ৯ জন ডাক্তার দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এর মধ্যে একজন আবাসিক ও চারজন মেডিকেল অফিসার, দুইজন কনসালট্যান্ট ও একজন ইউনানী চিকিৎসক, একজন হোমিও চিকিৎসক (সপ্তাহে ৩দিন)। সরেজমিন দেখা যায় টিকিট কাউন্টারের অব্যবস্থাপনা। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিকিট কাউন্টারে ভিড় লেগেই আছে। কাউন্টার কক্ষটি খুবই ছোট। একই কক্ষে নারী-পুরুষ ঠেলাঠেলি করে টিকিট নিতে হয়। ফলে চুরিসহ নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে অহরহ। টিকিটের মূল্য ৫ টাকা। কাউন্টার থেকে ভাঙতি দিতে চায় না। ভাঙতি টাকা না দিলে কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা আউটসোর্সিংয়ের লোকজন রোগীর সঙ্গে অসদাচরণ করেন। টিকিট নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলে সেখানে আরেক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ডাক্তারের চারপাশ ঘিরে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। নেই কোনো ডিসিপ্লিন। দেখে মনে হয় মাছের বাজার। কার আগে কে ডাক্তার দেখাবে। চিল্লাচিল্লি আর হইচই অবস্থার মধ্যেই ডাক্তারও কোনোরকম রোগের বর্ণনা শুনে ৫ পাঁচ টাকার ওই টিকিটেই প্রেসক্রিপশন করে বিদায় দেন। তদুপরি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের আনাগোনা তো রয়েছেই। রোগীদের প্রেসক্রিপশন এর ছবি তারা তুলে নিচ্ছে।
ওষুধেরও সংকট রয়েছে। গরিব রোগীরা সবসময় ওষুধ পায় না। টোকেন নিয়ে গেলেও ফেরত দেওয়া হচ্ছে। একটি ওষুধ থাকলে আরেকটি থাকে না। ওষুধ বিতরণে নানারকম অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি লক্ষ করা যায়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দৈনিক ৭-৮শ’ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। তাছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী। তাদেরকে ফ্লোরে বা বারান্দায় রেখে চিকিৎসা করাতে হয়।
১০০ শয্যা অনুমোদন হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ ৫০ জনের অধিক ডাক্তার পদায়ন হবে। নবনির্মিত ভবনে রোগী স্থানান্তর হলে ঘিঞ্জি পরিবেশ থাকবে না। এতে সেবার মান বাড়বে। সকল ধরনের রোগী উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। এক্স-রে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে তালাবদ্ধ আছে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় তালাবদ্ধ থাকায় হয়তো কোটি টাকার এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপোযোগী বা অকেজো হয়ে যাবে। এগুলোর ব্যবহার শুরু হলে দরিদ্র, হতদরিদ্র ও সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসাসেবা নিতে পারতো, যা বর্তমানে অধিক মূল্যে বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে হয়। ১০০ শয্যা হাসপাতালের অবকাঠানো নির্মাণ শেষ হয়েছে। দ্রুত এর অনুমোদন ও কার্যক্রম চালুকরণের দাবি জানান এলাকার লোকজন। এটি চালু হলে মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলোর সঠিক ব্যবহার এবং এলাকার মানুষ উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে।
কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার মো. ঈশা খান বলেন, জনবল সংকটের কারণে রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না, সেবার মানও বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত ওষুধেরও সংকট রয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টরের সাথে জুম মিটিংয়ে হাসপাতালের যাবতীয় সমস্যাসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে নতুন ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য জনশক্তি পদায়ন হলে হাসপাতালে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং সেবার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ের হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। ১০০ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম চালু করতে জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট ইত্যাদি কিছু বিষয় রয়েছে। আমরা মানসিকভাবে তৈরি আছি। অনুমোদন পেলেই কার্যক্রম শুরু করতে পারবো। এ ব্যাপারে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই অনুমোদন হয়ে যাবে।