খাবার সচেতন হলে রোজায় অনেক রোগ থেকে মুক্তি মেলে


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:৩১

॥ হামিম উল কবির ॥
খুবই সাধারণ, কিন্তু শরীরে চরম অস্বস্তি সৃষ্টি করে- এমন অনেক রোগে মানুষ ভুগে থাকেন পবিত্র রমজানে। এর কিছু কিছু রোগ একটু খাবার সচেতন হলেই এড়িয়ে চলা যায়। আবার কিছু কিছু রোগ রয়েছে, যেগুলো সারাতে যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রমজানে খাদ্যের সুব্যবস্থাপনা করতে পারলে এসব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়। কোন খাবারটি খেলে শরীরে অস্বস্তিবোধ হয়, সেগুলো নিজে নিজে নির্ধারণ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। নিজে নিজে তা বের করতে না পারলে ডাক্তারের কাছে গেলেই ডাক্তার নির্ধারণ করে দিতে পারবেন যে, কোন খাবারটি না খেলে আপনি সুস্থ থাকবেন। রমজানের সাধারণ রোগগুলোর জন্য মেডিসিন ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির চিকিৎসকরা সবচেয়ে কার্যকরভাবে পরামর্শ দিতে পারবেন।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
রাসূলুল্লাহ সা. সাহরির খাবার শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি একই সাথে ‘সাহ্রি বাদ না দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। সাহরি খেলে সওয়াবের কথাও বলেছেন তিনি।’ ইফতারের সময় অধিক পরিমাণে মিষ্টি ও চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ না করাই ভালো। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার শর্করা, রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায়, একই সাথে বদহজম, পেপটিক আলসার তৈরি করতে পারে। সন্ধ্যার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে, যেন শরীরের পানিশূন্যতা না হয়। পুষ্টিকর খাবারের সাথে প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টকদই খাবারের তালিকায় রাখা ভালো। পানির মধ্যে ডাবের পানি রোজার মধ্যে শরীরের জ¦ালাপোড়া রোধ করবে। খাদ্যের ক্যালরি ঠিক রেখে খাওয়ার পরিমাণ এবং ধরন ঠিক করতে হবে। কোন খাবারে কত ক্যালরি আছে, তা খাবার জাতীয় আর্টিকেল থেকে জেনে নেয়া যায়। তবে ক্যালরির পরিমাণ যে জানতেই হবে, তাও নয়। যে খাবারগুলো ভালো, তা অনেক দিনের অভ্যাস থেকেও জানা যায়। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। সঠিক ওজন ও ক্যালরির মাত্রা বজায় রাখতে রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া হতো, রমজানে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রেখে খাবারের সময় এবং ধরন বদলাতে হবে। প্রয়োজন হলে পুষ্টিবিদের সাথে যোগাযোগ করে খাবার তালিকা ঠিক করে নেয়া যেতে পারে। ইফতারের সময় যথেষ্ট এবং সাহরিতে অল্প আহার পরিহার করতে হবে। জটিল শর্করাজাতীয় খাবার সাহ্রির সময় পরিহার করতে হবে। অন্যদিকে ইফতারিতে সহজে হজম হয়- এমন খাবার খেতে হবে।
যেসব রোগ হতে পারে রমজানে
রোজাদারদের জীবনযাপনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, ঘুমের স্বাভাবিক চক্রের অস্বাভাবিকতার কারণে রোজায় বুক জ্বলা বা এসিডিটির মাত্রা বেড়ে যায়। বুকে ও পেটে জ্বালা-যন্ত্রণা, অস্বস্তিকর অনুভূতি, হালকা পেটব্যথা, বমি ভাব কিংবা বমি হতে পারে। রোজায় দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকা কিংবা ইফতার ও সাহরি অল্প সময়ে বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলা; বিশেষ করে ইফতারের সময় ভাজাপোড়া এবং বেশি তেল-মসলাসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ প্রভৃতি কারণে রোজায় বুক জ্বলা বা এসিডিটি হতে পারে। রোজায় অতিরিক্ত না খেয়ে পরিমিত ও সুষম খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এবিএম ছফিউল্লাহ। তিনি বলেন, সহজে হজম হয় এমন খাবার খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে, তাহলে সাধারণ অনেক রোগ যেমন বুকজ¦লা বা এসিডিটি রোধ করা যায়। ইফতারে অথবা সাহরিতে তেল-মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করতে পারলে উত্তম। করতে না পারলে অল্প তেলে খাবার রান্না করে খেতে হবে। সাহরিতে অতিরিক্ত লবণজাতীয় খাবার, আচার, লবণাক্ত বিস্কুট ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়। এগুলো খেলে যেমন এসিডিটি বেড়ে যেতে পারে আবার লবণে মানুষকে তৃষ্ণার্ত করে দেয়। রোজায় অযথাই তৃষ্ণা বাড়ানো উচিত নয়। সাহরিতে অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কারণ মিষ্টিজাতীয় খাবারও এসিডিটি বাড়িয়ে থাকে। ডা. ছফিউল্লাহ বলেন, একবারে বেশি পরিমাণে না খেয়ে অল্প অল্প করে খেতে হবে। ক্ষুধা মেটাতে ভরাপেট না খেয়ে কিছুটা ক্ষুধা রেখে খাবার খাওয়া বন্ধ করতে পারলে ভালো। ক্ষুধা রেখে খাবার পরিত্যাগ করার কথা হাদিসে রয়েছে, এতে প্রচুর উপকার রয়েছে। বেশি খেলে এসিডিটি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার সাথে সাথে শরীরে অস্বস্তিবোধও হতে পারে। ইফতার ও সাহরিতে তাড়াহুড়া করে না খেতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। খাওয়ার সময় তা ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে সহজে হজম হয়ে যাবে। সব খাবারে সবার এসিডিটি বাড়ে না, যেসব খাবার খেলে এসিডিটি বাড়ে, সেগুলো ছোটরা না বুঝলেও প্রাপ্তবয়স্করা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারেন। এসিডিটি বাড়ে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। খাবারের শেষে চা-কফি কিংবা ক্যাফেইন রয়েছে- এমন পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। চা অথবা কফি হজমে সমস্যা করে এবং এসিডিটি বাড়িয়ে দিতে পারে। এসিডিটি বাড়াতে পারে কোমল পানীয় ও চকলেটজাতীয় খাবার। এসিডিটি যাদের হয়ে থাকে, তাদের অ্যান্টাসিড ওষুধ অথবা সিরাপ সেবন করা যায় বলে ডা. ছফিউল্লাহ পরামর্শ দেন। যাদের নিয়মিত এসিডিটির সমস্যা রয়েছে, তারা নিয়মিত অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট অথবা সিরাপ রোজার প্রতি রাতেই নিয়ম করে সেবন করতে পারেন। মাসের জন্য নিয়মিত খেতে পারেন। সুস্থ থাকতে হলে ধূমপান ত্যাগ করা উচিত। ধূমপানে অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। রমজান মাস ধূমপান বর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ। বাইরের খোলা, অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বাইরের খাবারগুলো মুখরোচক হলেও নানা ধরনের জীবাণু সংক্রমণের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে বাইরের ঠাণ্ডা খাবার একেবারেই পরিহার করা উচিত। বিভিন্ন ধরনের হেপাটাইটিস, কৃমি বাইরের খাবার থেকে চলে আসতে পারে। ইফতারের খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই শুয়ে পড়া উচিত নয়। মানসিক চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। মানসিক চাপ থেকেও বুকজ্বালা বা এসিডিটির সমস্যা হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজম আরেকটি সমস্যা
রোজায় অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। আবার অনেকের বদহজম হয়ে থাকে। এসব বেশিরভাগই হয়ে থাকে উপযুক্ত খাবার খেতে না পারায়। রিফাইনড ফুডস, অপর্যাপ্ত আঁশজাতীয় খাবার এবং পানিস্বল্পতায় পবিত্র রমজানে প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় অনেকের মধ্যে। সেজন্য অতিরিক্ত রিফাইনড খাবার বর্জন করতে হবে। কারণ রিফাইন্ড খাবার উচ্চরক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে, হার্ট ডিজিজের কারণ হতে পারে এবং গ্রহণকারীকে মোটা করে তুলতে পারে। রিফাইন্ড সুগার (সাদা চিনি) রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের লেবেল বাড়িয়ে দিতে পারে। এ জাতীয় খাবার ফ্যাটি লিভার করতে পারে, কার্ডিওভাস্কোলার ডিজিজ করতে পারে। একই সাথে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে যেতে পারে রিফাইন্ড খাবার খেয়ে। সাদা চিনি, সাদা ব্রেড, বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল খাবার, কেক, সাদা চাল, নুডলস, ফ্রেবার্ড দই, বেকড পটেটো চিপস, নানা ধরনের কোমল পানীয় রিফাইন্ড ফুডের অন্তর্ভুক্ত। এই খাবারগুলো সুস্বাদু, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ খাবারগুলো পরিমাণে বেশি খেতে থাকলে উপরিউক্ত রোগ ছাড়াও এসিডিটি বাড়াতে পারে। বদহজম ও পেটফাঁপা রোজাদারদের আরেকটি সমস্যা। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবারে সাধারণত বদহজম ও পেটফাঁপা সমস্যার কারণ হয়ে থাকে। শাকসবজি অনেকের মধ্যে বদহজম ও পেট ফোলার কারণ হয়ে থাকে। যাদের এমন সমস্যা হয়, তাদের উচিত শাকসবজি পরিহার করা। আবার অনেক সময় এসব খাবার খেলেও বদহজম বা পেট ফোলা সমস্যার সৃষ্টি করে না, যদি চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ওষুধ গ্রহণ করা হয়। এ ওষুধগুলোর অন্যতম হলো ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধ। এখন অনেকে এসব ওষুধ নিজেই দোকান থেকে কিনে খাচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া উত্তম। কারণ একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির ডাক্তারই ভালো জানেন এসিডিটির বিরুদ্ধে কোন ওষুধটা কার জন্য, কতটুকু উপযুক্ত।
নিম্ন রক্তচাপ, মাথাব্যথা, পেশিতে টান লাগে এ সময়
রোজা রাখা হলে সাধারণত বিকেলের দিকে রক্তচাপ কিছুটা কমে যেতে পারে এবং শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে। শরীরে লবণ ও পানির অভাবে এমনটা হয়। এমন হলে ইফতারে অথবা ইফতারের পর তরল খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে হবে এবং খাবারে কিছুটা লবণ যুক্ত করে নিতে হবে। লবণ সবসময় স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়, কিন্তু রক্তচাপ কমে গেলেই তখন কিছুটা লবণ অথবা লবণজাতীয় খাবার খেয়ে নেয়া যায় রক্তচাপ বাড়ানোর জন্য। যাদের ধূমপান বা কফি পানের অভ্যাস আছে, তাদের সাধারণত রোজা শুরুর কয়েক দিন বেশ মাথাব্যথা হতে পারে। কফি ও সিগারেট ধীরে ধীরে কমিয়ে দিলে এ অভ্যাসটা চলে যাবে। চা ও কফির পরিবর্তে হারবাল টি অথবা গ্রিন-টির অভ্যাস করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কারণ এসব চায়ে ক্যাফেইন অথবা ঘুম নষ্ট হওয়ার কিছু থাকে না। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম যুক্ত খাবার কম খেলে পেশিতে টান লাগতে পারে। শাকসবজি, ফল, দুধ, মাংস ও খেজুর খাওয়ার মাধ্যমে প্রচুর ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়। পানিশূন্যতার কারণেও পেশিতে টান পড়তে পারে।
বয়স্কদের অন্যতম সমস্যা ডায়াবেটিস
রোজার মধ্যে বয়স্কদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সারা দিন না খাওয়ায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে আবার ইফতারের পর অতিরিক্ত খাওয়ায় গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে। রোজায় এ সমস্যাটি হলেও অনেক রোগ রোজা করলে উপকার পাওয়া যায়। রোজা করলে স্বাস্থ্যের সমস্যার চেয়ে বরং স্বাস্থ্যের উপকারই বেশি হয়। রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ও রহমতস্বরূপ। ডায়াবেটিক রোগীরা সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে নানারকম উপকার পেতে পারেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ আর রোজা রাখা হতে পারে এক অন্যতম উপায়। এতে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও সুন্দরভাবে করা যায়। যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা হতে পারে আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থা। যারা ইনসুলিন নেন বা মুখে অন্য ওষুধ খান, তাদের ক্ষেত্রেও রোজা ওষুধের মাত্রা কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে ডাক্তারের নির্দেশমতো ইনসুলিন বা মুখে খাওয়ার ওষুধ সমন্বয় করে নিতে হবে। শুধু রক্তের গ্লুকোজই নয়, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখে রোজা। সাথে সাথে রোজা ডায়াবেটিক রোগীকে সংযম, পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়, এগুলো ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অপরিহার্য।
চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রোজা
যাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, রোজা তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। রোজা ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে এবং মন্দ কোলেস্টেরল (এলডিএল) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। যাদের ওজন অতিরিক্ত, তাদের ক্ষেত্রে রোজা ওজন কমানোর জন্য এক সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ। রোজায় ওজন কমানোর সাথে সাথে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, বাতের ব্যথা, অস্টিওআরথ্রাইটিস, গাউটপেইন নিয়ন্ত্রণে রাখে।