প্রহসনের বিচার : আজহারুল ইসলামের মুক্তি সময়ের অনিবার্য দাবি


৬ মার্চ ২০২৫ ১১:২২

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পুনরায় অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা তার শাসনক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে ভিন্নমত এবং বিরোধীদল নির্মূলের নীলনকশা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক শক্তির যথেচ্ছা ব্যবহার করেছে। আদালত পরিণত হয়েছিল তার ইচ্ছা পূরণের আলাদিনের চেরাগ। আইন, সংবিধান ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বার বার তাকে সতর্ক করেছেন, আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে আন্তর্জাতিক মান ক্ষুণ্ন হয় এমন অপকর্ম বন্ধ করতে। কিন্তু ফলাফল হয়েছে উল্টো। তার অঙ্গুলি হেলানে কাজ করতে অস্বীকার করায় প্রধান বিচারককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আরো অনেক বিচারপতিকে হতে হয়েছে হেনস্তার শিকার। প্রচলিত আদালতের যথেচ্ছা ব্যবহারেও তার সাধ পূরণ হয়নি।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে গঠন করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর বিচারের আওয়াজ তুলে এ আদালত গঠন করার অভিপ্রায়ে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি তৎকালীন হাসিনা সরকার। তাই ইচ্ছে পূরণে গঠন করেছিল ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। আইন বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের বিচারের নামে একটি মীমাংসিত বিষয় নতুন করে সামনে এনে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেই মানবতাবিরোধী অপরাধ শুরু করে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে বিচার শুরুর আগে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক কলামলেখক এবনে গোলাম সামাদ হাসিনা সরকারকে সতর্ক করে লিখেছিলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ দিনজুড়ে হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে জয়ী হয় ভারত (মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যৌথ কমান্ডে অংশ নিয়ে)। হারে পাকিস্তান। ভারতের হাতে বন্দী হয় প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য। সিমলা চুক্তি অনুসারে এ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীদের (চঙড) পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এদের কাউকেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হয়নি। এছাড়া সিমলা চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই রাজি হয় যে, ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে, কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। চুক্তিটির নাম হয় সিমলা চুক্তি। কারণ এটি সম্পাদিত হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা শহরে।… সিমলা চুক্তি অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ আর ওঠা উচিত ছিল না।’ আইনের ফাঁকে এ চুক্তি এড়িয়ে যেতেই হাসিনা সরকার ভারতের সমর্থনে বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের আয়োজন করেছিল ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ নাম দিয়ে। এবনে গোলাম সামাদ একা নন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের একান্ত সচিব ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শেখ মুজিব গঠিত তৎকালীন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রধান কৌঁসুলি (চীফ প্রসিকিউটর) সুপ্রিম কোর্ট বারের একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ দেশের বিবেকবান অনেক বিশিষ্টজনই এ আয়োজনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার মনগড়া ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডহীন এ ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের হাসিনা সরকারের হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা মনে করেন, হাসিনা তার স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে খুন, গুম, আয়নাঘর, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জেল-জুলুমসহ যত অবৈধ অপকর্ম করেছে কথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ছিল তার অন্যতম। তার এ ট্রাইব্যুনাল ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, সেক্রটারি জেনারেল, নায়েবে আমীর, নির্বাহী পরিষদ সদস্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ অনেক প্রবীণ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন যুদ্ধাপরাধীর ট্যাগ লাগিয়ে তাদের হত্যা করেছে। হাসিনার এ অপকর্মকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা “এরাব ধ ফড়ম ধ নধফ হধসব ধহফ যধহম যরস” প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক কূটচালের সাথে তুলনা করেছেন।
শুধু এটিএম আজহারুল ইসলাম নয়, হাসিনার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হয়েছে, তারা সবাই চরম জুলুমের শিকার হয়েছেন। বিচারের নামে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না। কিন্তু যারা এ অবৈধ বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে হাসিনার অপরাধে সহযোগিতা করেছেন, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা সময়ের দাবি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এখন প্রশ্ন হলোÑ হাসিনার এ বিচার প্রক্রিয়াকে কেন জুডিশিয়াল হত্যাকাণ্ডের আয়োজন বলা হচ্ছে, সে বিষয়টি আলোচনা করার আগে এটিএম আজহারুল ইসলামের বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো উল্লেখ করা প্রয়োজন।
এটিএম আজহারুল ইসলামের বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো
এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী বলেছেন, চারটি গ্রাউন্ডে এটিএম আজহারুল ইসলামের রিভিউ অ্যাপ্লিকেশনটি এলাও (অনুমোদন) করে লিভ গ্রান্ট (মঞ্জুর) করেছেন আপিল বিভাগ। আগামী ২২ এপ্রিল মূল আপিলটির ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম গ্রাউন্ড হচ্ছে- আপিল বিভাগ ২০১৯ সালে আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, সেখানে ওনারা ইন্টারন্যাশনাল ল মানেননি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩ সালের আইনে ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাপ্লাই করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের আইনে ইন্টারন্যানল ল কমপ্লাই করার কথা ছিল, কিন্তু সেটা তারা মানেননি। এই মূল গ্রাউন্ডে রিভিউ এলাও (অনুমোদন) হয়েছে।
দ্বিতীয় গ্রাউন্ড হচ্ছে- ওনারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই আইনে স্পষ্ট বলা আছে, আন্তর্জাতিক আইন মেনে রায় দিতে হবে, কিন্তু ওনারা সেটা মানেননি এবং ওনারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে ছিল। এই গ্রাউন্ডেও রিভিউ অ্যাপ্লিকেশনটি এলাও হয়েছে।
তৃতীয়ত, স্পেকচ্যুয়াল পয়েন্ট: মামলার সাক্ষী ঘটনার সময় আসামিকে অনেক দূর থেকে দেখেছেন, তিন কিলোমিটার দূর থেকে, পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে চিহ্নিত করেছেন, যা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
চতুর্থ গ্রাউন্ড হলো এভিডেন্সগত বিষয়- একজন সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, এটিএম আজহারুল ইসলাম তার ক্লাসমেট ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি আজহারুল ইসলামের ক্লাসমেট ছিলেন না।
এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকীর উল্লেখিত বিষয়গুলো মিলে যাচ্ছে সেই সময় ট্রাইব্যুনাল বিটের একটি জাতীয় দৈনিকের নিজস্ব প্রতিবেদক শহীদুল ইসলামের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সাথে। তিনি সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এ প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন, ‘জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা চলছিল ট্রাইব্যুনাল-১-এ। এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ এবং রায় প্রদানে ব্যাপক জালিয়াতির আশ্রয় নেয় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিম। তার মধ্যে একজন সাক্ষীর অবস্থা ছিল এই যে, জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্মতারিখ রয়েছে ১৯৭৪ সালের একটি তারিখ। সেই সাক্ষী জবানবন্দী দেয়ার পর এখন জেরার পালা। এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী এডভোকেট মিজানুল ইসলামের প্রশ্ন- আপনার জন্ম ১৯৭৪ সাল। আপনি ১৯৭১ সালের ঘটনা দেখলেন কীভাবে- যখন আপনার জন্মই হয়নি?
সাক্ষী জবাব দিলেন, আমার জন্ম ৭১ সালের আগে, স্কুলের মাস্টাররা জন্মতারিখ ১৯৭৪ সাল করে দিয়েছে।
উকিলের প্রশ্ন: স্কুলের মাস্টার কত বছর বয়স কমিয়েছে?
সাক্ষীর আর জবাব নেই।
মামলার শুনানির সময় মিজানুল ইসলাম আদালতের কাছে প্রশ্ন রাখেন, স্কুলের মাস্টার এসএসসির ফরম ফিলাপের সময় বয়স কত বছর কমিয়ে থাকেন? ১/২ বছর, বড়জোর চার বছর। তার চেয়ে বেশি কি হতে পারে? ১৭/১৮ বছর কি হওয়া সম্ভব? ৪ বছর কমালেও তো ১৯৭১ সালে তার বয়স হতে পারে বড়জোর এক বছর। এক বছরের শিশু কি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হতে পারে?
শহীদুল ইসলাম আরো লেখেন, মামলার এ শুনানি চলাকালে আমার পাশে বসা ছিলেন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের চিফ রিপোর্টার স্নেহাস্পদ সহকর্মী ছোট ভাই। তাকে বললাম, কাহিনীটা কেমন হতে পারেÑ ১৯৭৪ সালে জন্ম নেয়া ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী?
ঐ সাংবাদিকের বর্ণিত কাহিনীটা ছিল এই- যার জন্ম হয়নি সে তো ছিল আল্লাহর কাছে। আল্লাহ তো থাকেন সবার ওপরে। কাজেই ওই সাক্ষী ওপর থেকে সব দেখেছে।
এই হলোÑ আজহারুল ইসলামের মামলার প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাক্ষীর নমুনা।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও খুনি হাসিনার ক্যাঙ্গারু কোর্ট তার সাক্ষীও গ্রহণ করেছিল।
আসলে গোটা বিচার প্রতিক্রিয়াই ছিল, সাজানো এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করার আয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ মামলার পুরো প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছি। মৃত্যুদণ্ডের রিভিউ থেকে ফের আপিল শুনানি হবে- মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে এটাই প্রথম নজির বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, আবদুল কাদের মোল্লাকে যে রায়ের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে, তা ভুল ছিল। সেটাকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত যদি আমাদের বক্তব্য গ্রহণ করেন, তাহলে আবদুল কাদের মোল্লা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যত আসামির সাজা হয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে।
বিচারের নামে প্রহসন
হাসিনার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসলে বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু হয়নি। অথচ এ ট্রাইব্যুনালের পক্ষে দেশের পরিচিত জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো সম্প্রতি সম্পাদকীয় পাতার মতামত কলামে সাফাই গাওয়া হয়েছে এবং আক্রমণ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দৈনিক প্রথম আলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড জুলাই মাসে চলমান গণহত্যার বিচারের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি অশুভ প্রচেষ্টার অংশ বলে উল্লেখ করেছে আইসিটির চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘এ প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।’
হাসিনার ট্রাইব্যুনাল তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে কী করেছে, তা কারো অজানা নয়। বিশেষ করে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি মিথ্যা সাক্ষী দিতে অস্বীকার করায় তাকে অপহরণ করে ভারতের জেলে রাখা, দেলু রাজাকারের সব দায় আল্লামা সাঈদীর ওপর চাপিয়ে সাজানো মামলায় তাকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড এবং প্রতিবাদী জনতার মিছিলে গুলি চালিয়ে আড়াইশত নিরীহ মানুষ হত্যার পরও আন্দোলন দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড (পৃথিবীর সব দৃষ্টান্ত ভেঙে) দেয়া হয়। পরে চিকিৎসার নামে হত্যা। কসাই কাদেরের বদলে তার অপরাধের দায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মেধাবী ছাত্রনেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে বিচার শেষে শাহবাগ নাটক মঞ্চস্থ করে আইন পরিবর্তন করে জুডিশিয়ল কিলিং। আইন ও বিচার প্রত্যক্ষ করে ভারত ছাড়া কোন দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায়বিচার বলে শিকার করেননি।
আন্তর্জাতিক মহলের সুপারিশ উপেক্ষা করে হাসিনা বিচার নাটক মঞ্চস্থ করেছে। তাই সময়ের দাবি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এ বিচার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হাসিনা ও তার আইনমন্ত্রী, বিচারক এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।
আন্তর্জাতিক মহল যেসব সুপারিশ করেছিল, তা বিস্তারিত তুলে ধরা এ স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তারপরও একনজরে কিছু তুলে ধরা হলো।
হাসিনার উপেক্ষিত আন্তর্জাতিক মহলের সুপারিশ
যুদ্ধাপরাধ বিচার কার্যক্রম দেখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এসেছিলেন তৎকালন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপ। তিনি বাংলাদেশ সফর শেষে সরকারের কাছে লিখিত সুপারিশ দিয়েছিলেন। বিচারের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে তার উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে ছিল আইন সংশোধন ও বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ। কিন্তু হাসিনার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সরাসরিই বলে দিয়েছেন, ট্রাইব্যুনালে কোনো বিদেশি আইনজীবী মামলা পরিচালনায় আসতে পারবে না।
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লর্ড এভিবেরি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ২০টি সমস্যা চিহ্নিত করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের নিকট তুলে ধরেছিলেন। যুক্তরাজ্য সফররত শফিক আহমদের সাথে বৈঠককালে লর্ড এভিবেরি এ সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। তার সুপারিশগুলোকে হাসিনা উপেক্ষা করায় তিনি সরাসরি জানিয়েছিলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যানালসহ অনেক সংস্থা ও আইনজ্ঞ ট্রাইব্যুনাল ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় মন্তব্য করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা সরকার তাদের কারো কথা আমলে নেয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর ১২ দফা সুপারিশসহ একটি আবেদন প্রেরণ করেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- আত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২) ধারায় উল্লিখিত অপরাধের সংজ্ঞা আরো স্পষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা- যাতে এসব সংজ্ঞা অপরাধ সংঘটনকালে দেশের অথবা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার যে সংজ্ঞা ছিল, তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়। আইসিটির এখতিয়ারভুক্ত মামলাগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালনার লক্ষ্যে সরকার এ আদালতের প্রসিকিউটর এবং বিচারকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারেন। আইসিটির ধারা ৬(৮) এর বলে ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং এতে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের নিয়োগ বিষয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটি আইসিসিপিআর-এর অনুচ্ছেদ ১৪(১)-এর আলোকে সংশোধন করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট আইনটিতে যথাযথ প্রক্রিয়া বিষয়ে আসামির অধিকার এমনভাবে নিশ্চিত করতে দেয়াÑ যাতে তা আইসিসিপিআর-এর অনুচ্ছেদ ১৪ এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বিষয়ক রোম সংবিধির ৫৫ ও ৬৭ অনুচ্ছেদের প্রতিফলন ঘটায়।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭(ক) বাতিল করা- যাতে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসহ সকল সাংবিধানিক অধিকার আসামির ক্ষেত্রে রক্ষা করা হয়।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইন সংশোধন এবং মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত না করে হাসিনা সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে তার মনগড়া ট্রাইব্যুনালকে। তাই ন্যায়বিচার এবং এ অবৈধ কাজে জড়িত হাসিনা সরকারের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, মানবাধিকারের পক্ষের সকল মিডিয়া, মানবাধিকার সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা সময়ের অনিবার্য দাবি। এক্ষেত্রে অবহেলা করলে হাসিনার মতো দানবরা বার বার ফিরে আসবে। মানবতা বার বার লাঞ্ছিত হবে, যা কারো কাম্য নয়।