রমাদানের সওগাত


৬ মার্চ ২০২৫ ১১:১৬

॥ মনসুর আহমদ ॥
ইসলামী ক্যালেন্ডারে রমাদান হলো পবিত্রতম মাস। এ মাসে রয়েছে আমাদের জন্য সীমাহীন উপহার। আমরা কি ভেবেছি কী কারণে রমাদান এত বিশেষত্ব লাভ করেছে? বছরের অন্য সকল মাসের মধ্যে এ মাসটি কেন এত পবিত্র ও রহমতপূর্ণ? শুধুমাত্র সিয়াম সাধনার কারণেই নয়, এ মাসে রয়েছে সীমাহীন পুরস্কার, আধ্যাত্মিকতার বর্ধন এবং এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছে। রমাদান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে অধিকতর একটি বিষয়। আল্লাহর সাথে এ মাস এমন সম্পর্কের বৃদ্ধি ঘটায়, পূর্বে যা সম্ভব হয় না। এ মাসে সত্যিকার উপকার পেতে আমাদের এর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনুধাবন প্রচেষ্টা করতে হবে।
রমাদানের বিস্ময়কর গুণাবলি ও তাৎপর্য : রমাদান হলো অসংখ্য গুণাবলি ও তাৎপর্য পূর্ণ মাস।
কিছু গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
১. মহান আল্লাহ এ রমাদান মাসে কুরআন নাজিল করেছেন। আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘রমাদান মাস, এ মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও মহাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস লাভ করবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার। (সূরা আল-বাকারা : ১৮৫)।
২. রমাদানে সিয়াম পালন ইসলামের একটি রোকন বা স্তম্ভ। আল্লাহর রাসূল ফরমান, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভে ওপর দাঁড়িয়ে আছে। (পরীক্ষা করার জন্য যে), তারা স্বীকার করবে আল্লাহ একমাত্র ইলাহ এবং মুহাম্মদ সা. তাঁর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, আল্লাহর ঘরে হজ করবে এবং রমাদানে সিয়াম পালন করবে। (সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম)।
৩. রমাদান মাসের বিশেষ রজনী লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘কদরের (ভাগ্য, শক্তি) রজনী হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ (সূরা আল-কদর : ৩)।
৪. এ মাসে জান্নাতের দরজা খুল দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আল্লাহর রাসূল ফরমান, ‘যখন রামাদানের মাস শুরু হয়, তখন জান্নাতর দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়; শয়তানকে শৃক্সক্ষলিত করা হয়।’ (বুখারী)।
৫. যারা রমাদান মাসকে অবহেলায় কাটায়, তাদের জন্য রয়ছে কঠোর হুঁশিয়ারি। যদি তুমি তোমার পাপকে (এ মাসে) ক্ষমা করাতে না পার, তবে তুমি বিরাট ক্ষতির মধ্যে পতিত হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘নিশ্চয়ই জিবরিল আমার কাছে এসে বলে গেছে, ‘যে ব্যক্তি রমাদান পেল, কিন্তু পাপমুক্ত হলো না, সে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে এবং আল্লাহ তাকে দূরে ঠেলে দেবেন। তাই আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন।’ (ইবনে হিব্বান)।
৬. রমাদানের প্রতিদিন আল্লাহ জাহান্নামিদের মুক্তি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রমাদানের প্রতিদিন ও রাতে তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন।’ (মুসনাদে আহমদ)।
৭. আল্লাহ এক রমাদান থেকে পরবর্তী রমাদান পর্যন্ত পাপীদের কৃত পাপরাশি মাফ করে দেন। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় এবং এক শুক্রবার থেকে পরবর্তী শুক্রবার এবং এক রমাদান থেকে পরবর্তী রমাদান পর্যন্ত যেসব পাপ করা হয়, তা আল্লাহ ক্ষমা করে দেন, যদি সে কবীরা গুনাহ্ থেকে দূরে থাকে। (মুসলিম)।
৮. রমাদান মাস হলো আল্লাহভীতি এবং ধর্মপ্রাণতা (তাকওয়া) অর্জনের মাস। আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা : ১৮৩)।
৯. রমাদানে সিয়াম পালনের পুরস্কার জান্নাত। রাসূল সা. বলেন, ‘জান্নাতে রাইয়্যান নামের একটি দরজা রয়েছে। বিচার দিবসে সিয়াম পালনকারীরা এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের সাথে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, ‘সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন সিয়াম পালনকারীরা সাড়া দেবে এবং তারা ব্যতীত অন্য কোনো বান্দাই এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সব সিয়াম পালনকারী প্রবেশ শেষ করবে, তখন দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং অন্য কেউ আর প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারী)।
১০. রমাদান মাসের সিয়াম পালন করা বছরের অন্য দশ মাসের সিয়াম পালনের সমান। রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাস সিয়াম পালন করল এবং শওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল। (মুসলিম)।
(ইসলামে উত্তম কাজে দশগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে বলা হয়েছে। সে হিসেবে রমাদানের সিয়ামের বদলা দশ মাস ও শওয়ালের ছয়টির বদলা ৬০ দিন বা দুই মাস, মোট বারো মাস।)
১১. ইমামের পেছনে এ মাসে কিয়ামুল লাইলের কিছুটা সময় সালাত আদায়ের মর্যাদা গোটা রাতভর সালাত আদায়ের মর্যাদার সমান। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমাদানে ইমামের পেছনে তাঁর সালাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে রয়, তাঁর জন্য সারা রাত জেগে থেকে সালাত আদায়ের সওয়াব লিখিত হয়।’ (তিরমিযী)।
১২. রমাদানে ওমরাহ পালন হজ সম্পন্ন করার সমান। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘নিশ্চয়ই রমাদানে ওমরা পালন হজের সমান।’ (মুসলিম)।
১৩. ইফতার বিতরণে দ্বিগুণ সওয়াব। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাওম আদায়কারীকে ইফতারী বিতরণ করবে, সে সাওম পালনকারীর সমান সওয়াব লাভ করবে; তাকে সাওম আদায়কারীকে দেওয়া সওয়াবের পরিমাণের চেয়ে কম দেওয়া হবে না।’ (সুনান আত-তিরমিযী; সুনান ইবনে-মাজাহ)।
১৪. রমাদান উত্তম অভ্যাস গঠনের সব চেয়ে উপযুক্ত সময়। সাহরীর জন্য শেষ রাতে জাগা, তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য শেষ রাতে জাগা, ফজরে মসজিদে যাওয়া এবং মানুষের প্রতি দয়ালু হওয়াসহ উত্তম অভ্যাস গঠনের জন্য রমাদান একটি বিশেষ সুযোগ। এ মাসে অনেকে ধূমপান পরিত্যাগ, মিথ্যা কথা বলা এবং পেছনে কুৎসা গাওয়া (গিবত) থেকে বিরত থাকার সংকল্প গ্রহণ করে থাকে। তাই এ মাসটি সৎ চরিত্র ও অভ্যাস গঠন এবং মন্দ কাজ ও অভ্যাস পরিত্যাগের জন্য উপযুক্ত সময়।
১৫. এ রমাদান মাসটি উদারতার স্বভাব সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে উত্তম মাস, যা অন্যসব মাসে করা সম্ভব নয়। আল্লাহর রাসূল অন্য সব মাসের চেয়ে এ মাসে অনেক বেশি দয়ার্দ্র হৃদয়ের হতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সব মানুষের জন্য দয়ালু ছিলেন, তবে রামাদান মাসে অন্যসব মাসের চেয়ে অত্যাধিক দয়ালু হতেন যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সাথে দেখা করতেন… প্রবল বায়ু প্রবাহের চেয়ে অধিক জোরে তার দয়া ছড়িয়ে পড়ত। (বুখারী)।
তাই আমরা যদি বদান্য হতে চাই, তাহলে রামাদানকে এজন্য বেছে নেয়া উচিত, অধিকন্তু এটাই সুন্নাত।
১৬. সিদ্দিকীন ও শুহাদাদের দলভুক্ত হতে রমাদান সবচেয়ে উত্তম সময়। একদিন এক লোক রাসূলের কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে উপাসনার যোগ্য মনে করি না (দ্বিতীয় উপাস্য নেই), আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, আমি পাঁচবার সালাত আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, রমাদানে সিয়াম পালন করি এবং এ মাসের রাতে আমি সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাই। বলুন আমি কোন দলের? রাসূল উত্তরে বললেন, ‘তুমি সিদ্দিকীন ও শুহাদাদের অন্তর্ভুক্ত।’ (ইবনে হাব্বান)। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের দলের অন্তর্ভুক্ত করুন।
১৭. আল্লাহ আমাদেরকে রমাদানে ক্ষমা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং (আল্লাহর মাগফিরাত) আশায় রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, আল্লাহ তার অতীতের সব পাপ মাফ করে দেন।’ (সুনান আন-নাসাই)।
আল্লাহর রাসূল অন্য একটি হাদিসে ফরমান, যে ব্যক্তি ঈমান ও আল্লাহর কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় রমাদানের সিয়াম পালন করে, আল্লাহ তার সব অতীত পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেন।’ (বুখারী)।
১৮. কুরআন এবং সিয়াম তোমার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘বিচার দিবসে কুরআন এবং সিয়াম আল্লাহর বান্দাদের জন্য প্রার্থনা জানাবে এই বলে যে, ‘সিয়াম বলবে, প্রভু! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও অভিলাষ-উপভোগ থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার পক্ষে অমার মধ্যস্থতা (সুপারিশ) গ্রহণ কর। কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তুমি তার জন্য আমার মধ্যস্থতা গ্রহণ কর। তখন আল্লাহ উভয়ের (সুপারিশ) মধ্যস্থতা গ্রহণ করে বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ)।
রমাদান হলো ধ্যান, ঈমান বৃদ্ধি এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার মাস। এসব সত্য অনুধাবন করে তা জীবনের সকল কর্মে বাস্তবায়িত করে আমরা এ মাসটিকে অর্থবহ করে তুলতে পারি। আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, যেন আল্লাহ আমাদের কর্ম ও প্রচেষ্টা কবুল করেন এবং দয়ার চাদরে আচ্ছাদিত করেন। আমীন।