সৈয়দপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্প : ৬ মাসেই মেঝে-দেয়ালে ফাটল ও ধস


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:০৫

মো. জাকির হোসেন, সৈয়দপুর (নীলফামারী) : আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা আমলের শেষদিকে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে নীলফামারীর সৈয়দপুর ঢেলাপীর উত্তরা আবাসনে ১২১টি ঘর নির্মাণে দলীয় দাপটে চরম হরিলুট করা হয়েছে। ইউএনও, আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদারের যোগসাজশে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরগুলো তৈরির কাজ করার মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘর বরাদ্দের বাণিজ্য করে আরও প্রায় কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে সংশ্লিষ্টরা। নিয়মবহির্ভূতভাবে নামকাওয়াস্তে কাজ করার ফলে ঘরগুলো বরাদ্দের মাত্র ৬ মাসেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতে বসবাসকারীরা ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢেলাপীর আবাসনে সর্বশেষ ১২১টি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। প্রতিটি ঘর নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এসব ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়েছে বলে অভিযোগে মিলেছে। সিডিউল অনুযায়ী ঘরের ইটের গাঁথুনির ক্ষেত্রে সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণ করার কথা ১-৩ হিসেবে। কিন্তু দেয়া হয়েছে ১ বস্তা সিমেন্টের বিপরিতে ৭ বস্তা বালু দিয়ে মসলা তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া ১ নম্বর ইটের পরিবর্তে ২ ও ৩ নম্বর ইটের মিশেল দেয়া হয়েছে। টিনের চালা দেয়ার ক্ষেত্রেও কাঁচা ও অপরিপক্ব গাছের কাঠ দিয়ে ফ্রেম করা হয়েছে।
মহাসড়কের পশ্চিম পাশের প্রায় ১০ ফুট গভীর গর্ত পূরণেও ঘাপলা করা হয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত মাটি ভরাট না করে শুধু কলাগাছ ও পৌরসভার আবর্জনা ফেলে তার ওপর সামান্য পরিমাণ বালু ফেলা হয়। কোনোরকম ডাম্পিং না করেই কাঁচা অবস্থাতেই সেখানে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে প্রায় ২০-৩০টি ঘর ওই গর্তের ওপর হওয়ায় সেগুলো ডেবে গেছে। আর ঘরের মেঝে ভরাটেও মাটি সঠিকভাবে দেয়া হয়নি। এর ফলে মেঝে ডেবে ও ফেটে গেছে। একইভাবে নিম্নমানের মসলার মিশ্রণে প্লাস্টার করায় দেয়ালেও দেখা দিয়েছে ফাটল। প্রায় ৮০ ভাগ ঘরেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরেজমিন উত্তরা আবাসন আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় গেলে বাড়ি নং ৪-এর বাসিন্দা মো. আলাল হোসেনের স্ত্রী নজুফা বলেন, এমনভাবে বাড়ির কাজ করা হয়েছে যে মাত্র ৬ মাসেই ঘরের মেঝে ডেবে গেছে। স্থানে স্থানে প্লাস্টার উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাছাড়া ভিত্তির সময় আশপাশে পর্যাপ্ত মাটি না দেয়ায় বর্ষার সময় বৃষ্টির পানির তোরে দেয়ালের গোড়া ধসে পড়েছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছি।
একইভাবে ১৭ ও ১৮নং বাড়ির বাসিন্দা সবুরের ছেলে অলিউল বলেন, এখানে বিশাল গর্ত ছিল। এই গর্ত পূরণে মাটি না দিয়ে কলাগাছ ও আবর্জনা ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেগুলো বসতে না বসতেই ভিত্তি দেয়ায় এখন প্রায় ১ ফুট নিচে ডেবে গেছে। আলগা অবস্থায় ঘরগুলো তৈরি করায় রাস্তা দিয়ে ভাড়ি যানবাহন গেলেই ঘরগুলো প্রচণ্ডভাবে কাপতে থাকে। মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। যে কোনো সময় ঘরগুলো ধ্বসে গিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়তে পারি আমরা।
এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার বাড়ি কুড়িগ্রামে। নদীভাঙনের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর আগে সপরিবারে সৈয়দপুরে চলে আসি। গত ১১ বছর যাবত ঢেলাপীর এলাকায় বসবাস করি। এখানেই আমার বাবা-মা মারা গেছেন। অথচ বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও আমি একটা বাসা বরাদ্দ পাইনি। শেষ ১২১টি ঘর নির্মাণের সময় এখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি। এতে দেখেছি ঠিকাদার মুকুলের নির্দেশে মিস্ত্রি এক বস্তা সিমেন্টের সাথে ৭ বস্তা বালু দিয়ে মসলা তৈরি করে তা দিয়ে গাঁথুনি ও প্লাস্টারের কাজ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তৎকালীন এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলামের কাছে অভিযোগ করলে ঠিকাদার আমাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে তার অনুগত লোকজনকে দিয়ে নিম্নমানের কাজ করিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হানকে বিষয়টি জানালে তিনিও কোনো পদক্ষেপ নেননি।
তাছাড়া বাড়িগুলো বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকৃত ভূমিহীনদের না দিয়ে টাকার বিনিময়ে সচ্ছল ব্যক্তিদের দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নাইটগার্ড বাদশার মাধ্যমে তহশিলদার দিপু এ টাকা নিয়েছে। আমার কাছেও ৬০ হাজার টাকা চেয়েছিল তারা। না দেয়ায় আমাকে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অথচ বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান সরকার জুন মাসে রাতের আধারে লোকজনকে এনে ঘরে তুলেছে। টাকার বিনিময়ে তিনিও অনিয়ম করেছেন। আমি এর সুবিচার চাই।
এ ব্যাপারে ঠিকাদার সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম মুকুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে কল রিসিভ না করায় তার মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তৎকালীন এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলাম অন্যত্র বদলি হওয়ায় তাদের মতামত নেয়াও যায়নি। তবে ইউএনও ফয়সাল রায়হান অভিযোগের বিষয়ে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা ঠিক নয়। বরং নিয়মানুযায়ী সঠিকভাবেই কাজ করা হয়েছে। প্রয়োজনে তদন্ত করে দেখতে পারেন।