একটি নক্ষত্রের পতন


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৪৭

॥ প্রফেসর ডা. মো. রুহুল আমিন ॥
বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তিনি একটি গতিশীল বাংলাদেশের জন্য সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। প্রয়োজন সুন্দর গবেষণার মাধ্যমে সত্যকে তুলে আনা। বারাকাহ ফাউন্ডেশনের সাথেও তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ বিষয়সমূহ নিয়ে কথা বলতে চাই। তার জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের গোষ্টা গ্রামে। মৃত্যু ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।) ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব।’ সূরা বাকারার ১৫৬ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষ। এই আদি প্রকৃত্রিম ও চির সত্য কথাটা অনুসরণ করে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বিচারপতি আব্দুর রউফ তার নিজের প্রতিষ্ঠিত ইনসাফ বারাকাহ্ হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন আল্লাহর নিকট। সবাই শোকবিহ্বল। একজন কর্মময় মানুষের দুনিয়ার জীবন সমাপ্ত। রেখে গেলেন তার উত্তরসূরিদের তার অসমাপ্ত কাজগুলো আরো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য। মৃত্যু ও জীবনের কথা সূরা মুলকে আল্লাহ তায়ালা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘পুণ্যময় সেই মহান সত্তা যার হাতে রাজত্ব এবং যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন যাতে করে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন কর্মের বিবেচনায় কে তোমাদের মধ্যে উত্তম।’ সূরা মুলক : ১-২। আল্লাহ তাকে দান করেছেন অনেক মহিমান্বিত গুণাবলি, যা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। আছে সন্তান-সন্তানাদি, সহায়-সম্পদ, সম্মান ও কল্যাণ। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বড় ছেলে মোহাম্মদ আশরাফ রউফ অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল। তাকে আলোকিত করেছে অনেক বিষয়। গবেষকরাই এসব বিষয়ে অনেক কিছু নির্ধারণ করবেন বলে আশা করি। আমিও তাকে দেখেছি, তার সাথে মিশেছি হৃদয়মনের সকল আন্তরিকতায় সিকি শতাব্দীর ওপর। বলতে চাই কবির ভাষায় :
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।
বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ নানা স্তরের হাজারো মানুষ, বিচারপতি আব্দুর রউফ সম্পর্কে যেসব মতামত ও মন্তব্য করেছেন, তা যে কোনো মানুষকে বিমোহিত করবে। তার সম্পর্কে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমীর প্রখ্যাত জননেতা ডাক্তার শফিকুর রহমান বলেন, ‘আইন এবং আদালত অঙ্গনে তার দীর্ঘ আইনগত পেশা জীবনে পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্ববোধের যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন তা একেবারেই বিরল।’
আমার জানামতে সত্যিকারের মজলুমদের পাশে দাঁড়াতে তিনি কখনো কারো সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির পরোয়া করেননি। অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে আইনের যে সহযোগিতা প্রদান করেছেন, তা একেবারেই বিরল। তার এ লড়াই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আরো বলেন, তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে ১৯৯১ সালে জাতীয় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন।
যে নির্বাচন দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। তার নিরপেক্ষতা, সততা, যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের পর বর্তমান দেশে গণতন্ত্র আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে তার মতো একজন মহান অভিভাবকের বড় প্রয়োজন ছিল। তার ইন্তেকালে জাতি একজন অত্যন্ত আদর্শবান দেশপ্রেমিক উদার গণতন্ত্রমনা আইন বিশেষজ্ঞ ন্যায়বিচারক ও একজন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে হারালো। এরকম দেশের অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মনীষীবৃন্দ তার ব্যাপারে সুন্দর সুন্দর মন্তব্য ও মতামত দিয়েছেন, যা পরবর্তী মানবসভ্যতার জন্য হতে পারে অনেক কল্যাণের দিকনির্দেশনা। সবকিছু ছাড়িয়ে বারাকাহ ফাউন্ডেশন বিচারপতি আব্দুর রউফকে নিয়ে গেছে এক সুমহান উচ্চতায়, তা আমরা কতজন জানি। আব্দুর রউফ ও বারাকাহ্ ফাউন্ডেশন জাতিকে এমন কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, যা এখনো অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই, লিখতে চাই, বই প্রকাশ করতে চাই। আসুন, এ গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু আমরা মানুষের নিকট উপস্থাপনের চেষ্টা করি।
বারাকাহ ফাউন্ডেশনে এমনকি দান করলো, যা তাকে দিতে পারে অমরতা। গভীর অনুসন্ধানে ও বিশ্লেষণে জেনেছি, তার এ সুমহান গুণাবলিকে আরও বিকশিত করার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বারাকাহ্ ফাউন্ডশন। যে ব্যক্তি তাকে এই পথের সন্ধান দিয়ে নিজেও হয়েছেন অমর তার নাম মরহুম ডাক্তার ওমর ফারুক। আমি এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় একজন জীবন্ত সাক্ষী। ইতোমধ্যে বারাকাহ ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও অন্যদের সমন্বয়ে ড. আহসান হাবিব ইমরোজ, এ কাইয়ুম আল ফয়সাল সম্পাদনা পরিষদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় স্বল্পব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবার রূপকার ডাক্তার ওমর ফারুক স্মারক গ্রন্থ। বইটি বারাকাহ ফাউন্ডেশন সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক দলিল।
সেখানে বিচারপতি আব্দুর রউফ এক ঐতিহাসিক সত্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে গেছেন বারাকাহ ফাউন্ডেশন ও ওমর ফারুক সম্পর্কে। তিনি ওমর ফারুক স্মরণে বলেন, ‘তিনি ছিলেন আর্তমানবতার সেবা প্রদানে এক নজিরবিহীন বিরাট সম্ভাবনাময় তরুণ চিকিৎসক। ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কর্মরত বিচারক অবস্থায় তার সহকর্মী আরো তিনজন তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মানবসেবায় এক বিপ্লবাত্মক পরিকল্পনা উপস্থাপন করে আমার আশীর্বাদ কামনা করেন। এ পরিকল্পনা অত্যন্ত বাস্তবমুখী ও সাড়া জাগানোর মতো ছিল বিধায় অবসর জীবনে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বাসনা প্রকাশ করেছিলাম। তারই জেরে ১৯৯৯ সাল থেকে অরাজনৈতিক মানবসেবা ধর্মীয় সংস্থা বারাকাহ্ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি।’
এটি ছিল বিচারপতি মো. আব্দুর রউফের অবসর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারা, যা তাকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অবসরে থাকতে দেয়নি। অবসর জীবনকে গতিময় জীবনের রূপ দিতে মরহুম ওমর ফারুকের উদ্যোগটি কেন এতটা কার্যকরী এবং ম্যাজিক মেডিসিনের মতো কাজ করেছে, তা এ জাতিকে অনুভব করতে হলে আমাদের ক্রমান্বয়ে আরেকটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
এ বিষয়ে প্রফেসর এম ফখরুল ইসলাম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ইউরোলজিস্ট এবং বারাকাহ্ ফাউন্ডেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ খুব চমৎকারভাবে এ রহস্যের দুয়ার উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেন, আমি তখন রাজধানীর মৌচাক রেলগেটের ভূইয়া পলি ক্লিনিকে নিয়মিত বৈকালিক চেম্বার ও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি। ১৯৯৩ সালে আমার চেম্বারে প্রাক যোগাযোগ সহকারে একজন ইয়ং স্মার্ট ছেলে এসে কিছু আলোচনা সূত্রপাত করল, যা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। বাল্যকাল থেকেই আমার বেশিরভাগ কাজ চিন্তা-চেতনা ছিল গণমুখী। আলোচনার শুরুতেই তিনি বললেন, ফখরুল ভাই আমরা এমন একটা হাসপাতাল করতে যাচ্ছি, যেখানে লো-কস্ট সার্ভিস দেব। সেই ওমর ফারুকের লো-কস্ট হাইটেক মেডিকেল সার্ভিস কনসেপ্টটি গ্রহণ করি এবং এগিয়ে যাই তৈরি করি বারাকাহ ফাউন্ডেশন।
প্রফেসর ডাক্তার মতিউর রহমান বলেন, ডাক্তার ওমর ফারুক স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসাসেবার যে ব্যবস্থা করে গেছেন আল্লাহ চাহে তো কিয়ামত পর্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং এমনকি উচ্চবিত্তরা উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা পেয়ে কৃতজ্ঞ হবেন।
ওমর ফারুকের সাথে আমার সোনালি সময় কেটেছে ময়মনসিংহের এ বিশাল জনপদে। আবার দেখা হলো ৯০ সালে ঢাকায়। বলল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাকরি করার চেয়ে বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে চাই। আগত চিকিৎসকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য কাজ করতে চাইÑ যাতে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে পারি। আমি এই নবীন চিকিৎসকের এ অনুভূতি ও সাহসকে স্বাচ্ছন্দ্যে অনুমোদন করলাম, উৎসাহিত করলাম, দোয়া করলাম, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
সেসব সিদ্ধান্তের ফসল হলো বারাকাহ্ ফাউন্ডেশন, যা আজ বিশাল গতিশীল একটি স্রোতধারার নাম, একটি বিশাল নদী প্রবাহের নাম যা সাগর পানে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এটি সত্য সুন্দরকে বাংলাদেশের জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে হেলথ সেক্টরে আমাদের লো-কস্ট হাইটেক কনসেপ্ট যেভাবে সমর্থিত হলো এবং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জন্ম নিলো ইনসাফ বারাকাহ কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতাল মগবাজার এবং রাজারবাগে দি বারাকাহ্ জেনারেল হাসপাতাল লিমিটেড, মদনপুর নারায়ণগঞ্জ ঢাকা চিটাগাং হাইওয়ের পার ঘেষে দি বারাকাহ হাসপাতাল মদনপুর।
এসব হাসপাতালসমূহ প্রতিষ্ঠায় যত বাধা আসুক, প্রতিবন্ধকতা আসুক, কোনো সমস্যা নেই আমাদের পাশে থাকতেন সবসময় বিচারপতি আব্দুর রউফ। তিনি সবসময় বলতেন ডিঙ্গিনৌকা দিয়ে কখনো সাগর পাড়ি দেওয়া যায় না। সাগর পাড়ি দিতে হলে বড় নৌকাই লাগবে, যা আমাদেরকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে উৎসাহিত করেছে উজ্জীবিত করেছে।
সম্মানিত শেয়ারহোল্ডারদের জন্য, শুভাকাক্সক্ষীদের জন্য, আগত ভবিষ্যতের কর্ণধারদের জন্য তার সবসময়ের একটি অমীয় বাণী ছিল সার্ভিস ফাস্ট প্রফিট নেক্সট। এই সকল কনসেপ্টসমূহ এবং আমাদের সাহসের ওপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা তৈরি করতে যাচ্ছি মালিবাগ রেলগেটে বারাকাহ স্পেশালিস্ট হসপিটাল লিমিটেড। সেখানে ট্রপিকাল হোমস লিমিটেডের মাধ্যমে তৈরি হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশে আর টলেস্ট ৪৫তলা বিল্ডিং, টিএ টাওয়ার, যেখানে হাসপাতাল ছাড়াও গড়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। আমরা এমন হাসপাতাল বিনির্মাণ করতে চাই, যাতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারে।
বাংলাদেশি রোগীদের বিদেশে যে চিকিৎসা করার প্রবণতা রোদ হতে পারে, বিদেশি রোগীরা বাংলাদেশে এসে আমাদের হাসপাতালে সেবা পেয়ে ধন্য হতে পারে এবং আমরা মানবকল্যাণে একটা শ্রেষ্ঠ নমুনা হয়ে গড়ে উঠতে পারি। অবসরে থাকাকালীন বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ মানবসেবা ও মানবকল্যাণে বারাকাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনুপ্রেরণার একটি উৎস কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন। তার সাথে যুক্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। যুক্ত হয়েছেন ট্রপিক্যাল হোমস এবং তার চেয়ারম্যান মরহুম ডাক্তার রেজাউল করিম। আজ দুজনেই মরহুম, চলে গেছেন আল্লাহর নিকট, সেখানে তারা শান্তিতে থাকুন, জান্নাতে থাকুন এবং গল্পে থাকুন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তবে তাদের দুজনের স্বপ্ন টিএ টাওয়ারে তৈরি হবে বারাকাহ ফাউন্ডেশনের অনেক বড় মাপের অফিস, যা উৎসর্গীকৃত হবে মানবসেবা ও মেডিকেল শিক্ষা, গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ কতদূর, সময়ই তা বলে দেবে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান, দি বারাকাহ ফাউন্ডেশন; সাবেক অধ্যক্ষ, সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ।