প্রসঙ্গ জাতীয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং স্বৈরাচারের দোসরদের গণহত্যার বিচার


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৩৪

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
গত ৩টি নির্বাচনে প্রহসন হওয়ার ফলে দেশের মানুষ নির্বাচনের কথা ভুলে যেতে শুরু করেছে। দিনের ভোট রাতে, ভোট ছাড়াই ১৫৪ এমপি হওয়া এবং আমরা আর মামুরা ভোট হওয়ায় মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘদিন কায়েম হয়েছিল এক ব্যক্তির শাসন। কথায় ও কাজে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় গোটা দেশ দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে ফেলে শাসন চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ফলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ২৪-এর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ভয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে স্বৈরশাসক হাসিনা তার প্রিয় মোদির কাছে চলে যায় দুপুরের খাবার টেবিলে রেখেই। দেশের মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে। স্বৈরাচার হাসিনার লোকেরা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে গণভবন পর্যন্ত চোর-বাটপারে ভরে গিয়েছিল। ফলে হাসিনা পালানোর পর সব জায়গা থেকে হয় পালিয়েছে অথবা গা-ঢাকা দিয়েছে অথবা জেলের অভ্যন্তরে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে। আর লুটপাট করা টাকা, ব্যাংক খালি করা টাকা খরচ করে লুকিয়ে থাকা লোক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে, শিল্প-কারখানায় অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যদিও তাদের আশা পূরণ হওয়া সম্ভব নয় এদেশে। পালানোরা কোনোদিন আর ফিরে আসেÑ পৃথিবীতে কোনো প্রমাণ নেই।
স্বৈরাচার হাসিনা পালানোর ফলে এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, মেয়র, কমিশনার, মেম্বার সব কাজ ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বিচার এড়াতে পালিয়েছে। এর বিহিত হওয়া অতি জরুরি। আমরা সাধারণ জনগণের ভালো চাই। মন্ত্রী-এমপি শুধু নয়, আমাদের গ্রামগঞ্জে মেম্বার, কমিশনার, মেয়র, চেয়ারম্যান আমাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করে তাদের দ্বারা শহর-বন্দর শাসিত হোক, তাই জনগণ চায়।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে অতিসত্বর ভোটার লিস্ট হালনাগাদ করে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে গ্রামগঞ্জে ভালো মানুষের শাসন কায়েম করতে পারলেই শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে সহজে। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের এলাকা ছোট তাই এ এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, পণ্যসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের সহযোগী জনগণকে নিয়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। চাঁদাবাজ চাঁদাবাজই। জনগণ যদি রুখে দাঁড়ায় চাঁদাবাজরা পালাতে বাধ্য হবে। এলাকায় এলাকায় চাঁদাবাজবিরোধী সংগ্রাম কমিটি করে প্রশাসনের সহযোগিতায় সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। জনণকে আহ্বান জানাব, আপনার এলাকার সৎ, যোগ্য লোক তালাশ করে দল-মত নির্বিশেষে প্রার্থী বাছাই করুন।
যারা অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেয়ার কথা বলছেন, তাদের কর্মীদের কেউ এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আমি গত দুই মাসে ৬টি জেলায় সফর করেছি। সাধারণ রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে, খুচরা দোকানে, পাইকারি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম চাঁদাবাজি কোনো অংশে কমেনি। হাসিনার দোসররা লুকিয়ে থেকে তাদের নতুন সংস্করণ লোকদের দ্বারা তাদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। চাঁদাবাজি, হাটঘাট, বাজার, রিকশাস্ট্যান্ড ও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করছে আগের মতোই। লোক বদলেছে, কিন্তু কাজ বদলায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো ভালো অবস্থায় ফিরে আসেনি। যৌথবাহিনী মাঠে নামার কারণে শয়তান শিকারের আওতায় গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর; এমনকি রাজধানী থেকেও চাঁদাবাজরা আত্মগোপন করছে অথবা যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। আমরা এর উন্নতি চাই। দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি ভালো দেশের উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই।
প্রধান উপদেষ্টা ভালো মানুষ। তাই সাহস করে উদ্যোগ নিলেই দেশটাকে আমরা ভালো দেশে পরিণত করতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ। প্রমাণস্বরূপ বলতে পারি- হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও সৎ মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে নয়, দুনিয়ায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাংক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু স্বৈরাচারের দোসর এস আলম ২০১৭ সালে হাসিনাার মদদে ইসলামী ব্যাংক দখল করে ৮০ শতাংশ টাকা চুরি করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। পত্র-পত্রিকার সূত্রে প্রকাশ, এর ভাগ নাকি হাসিনা-রেহানার ভাগেও গেছে। এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং টাকা ফেরত আনার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান করছি। এমনই সৎ লোক দ্বারা পরিচালিত দেশের প্রত্যেকটি জেলায় স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা; এমনকি জেলায় জেলায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক-হাসপাতাল গড়ে উঠেছে শুধু একদল নিরলস সৎ ও যোগ্যতর মানুষের বলে।
দেশটাও যদি সৎ, যোগ্য, আল্লাহভীরু লোকদের হাতে পড়ে তবে চাঁদাবাজ, দখলবাজ, ব্যাংক লুটকারীদের পরাস্ত করে বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। জনতা অধির আগ্রহে প্রত্যাশা করছে এমন একটি দেশের দল-মত ভেদে সৎ লোকের শাসনই কাম্য।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে করতে পারলে স্থানীয়ভাবে স্বল্প পরিসর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা আয়ত্তে আনা সম্ভব হবে। জনগণ তাদের পছন্দমতো সৎ, যোগ্য, জনদরদি নেতা নির্বাচন করতে সক্ষম হবে। চাঁদাবাজ, দখলবাজ সিন্ডিকেট ভাঙার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বড় দল বিএনপির কিছু পথভ্রষ্ট নেতাকে হঠাৎ ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসেছে। সাথে যোগ হয়েছে হাসিনার দোসররা এবং প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মনে রাখতে হবে ছাত্র-জনতা আর বোকা নেই।
৫ আগস্ট যেভাবে স্বৈরাচার হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছে ছাত্র-জনতা। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘ডেভিল হান্ট’ শয়তান শিকার অভিযানে দেশের মানুষ ফল পেতে শুরু করেছে। শয়তানদের পাকড়াও করা এবং বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে দেশের মানুষ। হাসিনা বিচারবহির্ভূতভাবে বিরোধীদের ফাঁসি দিয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে। আয়নাঘরে রেখে সামরিক ও বেসামরিক লোকদের বছরের পর বছর শাস্তি দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। আমরা হাসিনা ও তার দোসরদের স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এখানে উল্লেখ করার মতো সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে হাসিনার কুকর্মের রিপোর্ট জনসমুক্ষে আসার ফলে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে হাসিনা ও তার দোসরদের সব কীর্তিকলাপ এবং মানবতাবিরোধী সব কার্যকলাপ প্রকাশ্যে এসেছে। তাই তাদের বিচার করা এখন সহজ হয়েছে। আমরা দ্রুত স্বচ্ছ বিচারের দাবি জানাচ্ছি এবং তাদের জনসম্মুখে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি।
এক্ষেত্রে আমাদের আগস্ট বিপ্লবের পর সিরিয়ায় মাত্র ১২ দিনের আন্দোলনে বাশার আল আসাদের ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। বাশার আল আসাদ দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সিরিয়ায় বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়েছে। বিপ্লবী প্রধান ইতোমধ্যে ক্ষমতায় এসে বিপ্লবী কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। স্বৈরশাসকের শাসনতন্ত্র বাতিল করেছে। ৪ বছর পর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেছে। এ সময়ের মধ্যে স্বৈরশাসকের সব অবৈধ কার্যকলাপ সংশোধন করে দেশটাকে একটি মুসলিম দেশ হিসেবে চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা তাদের মোবারকবাদ জানাই। মহান আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন, কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা কিন্তু বিপ্লব করলেও বিপ্লবী সরকার করতে পারিনি। আমাদের দেশে হাসিনার দোসররা সক্রিয়। নেত্রী পালালেও তাদের দোসররা এবং প্রতিবেশী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে বিপ্লবী সরকার গঠনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের মধ্যকার কিছু লোকও এর সাথে জড়িত। তাদের কারণেই আমরা বঙ্গভবন এখনো দখলে নিতে পারিনি। জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কোনো বিদেশি দালালের কূটকৌশল বাস্তবায়ন করতে দেবে না।
আমরা অবশ্যই জাতীয় নির্বাচন চাই। সংস্কার চাই। সবচেয়ে বড় চাওয়া আমাদের আগস্ট বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের জন্য ন্যায়বিচার। এ বিচার দ্রুত শেষ করেই অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচনে যেতে হবে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেলে দেশ শান্তির দিকে মোড় নেবে। ১৬ বছরের আগাছা দূর করার সুযোগ তৈরি হবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এলাকাগুলো হাসিনা ও তার দোসরদের থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
যারা হাসিনার লোকদের কুসংস্কারকে ভয় দেখান, তারা ভুলে যাবেন না আগস্ট বিপ্লবের চেতনাকে। কোনো স্বৈরাচার আগের বা পরের কাউকেই জনগণ আর প্রশ্রয় দেবে না। ছাত্র-জনতা সজাগ হয়েছে, দ্রব্যমূল্য কমতে শুরু করেছে। সিন্ডিকেট এখনো পুরো ভাঙা যায়নি, চেষ্টা চলছে। দেশের মানুষ সজাগ হলে আর সৎ নেতৃত্ব পেলে সব বাধা-বিপত্তির অবসান করে আমরা একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।
আমরা যেহেতু জবাবদিহিমূলক শাসন কায়েম করতে চাই, তাই আমাদের জয়ের আশা শতভাগ। আমরা যেমন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে চাই, আবার পরকালে মহান আল্লাহর কাছেও জবাবদিহির ভয় পাই।
তাই আসুন, আমরা দেশপ্রেমিক জনতা দেশের কল্যাণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সার্বিকভাবে তার ভালো উদ্যোগকে সহযোগিতা করি। কে কী বলল, কিছুই যায়-আসে না। জনগণ এক থাকলে কোনো দেশি দল বা বিদেশি ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না। আমরা লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। ইতোমধ্যে দেশে ইসলামী জনতার ঢল আপনারা লক্ষ করেছেন। জামায়াতের আমীরের ঘোষণা এবং ড. আজহারীর জনসভাগুলো দেশের ও দেশের বাইরে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। আমরা ছাত্র-জনতা ঐকমত্যের ভিত্তিতে ছোট-খাটো বিভেদ ভুলে জনতার ঐক্য ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যাবÑ এ প্রত্যাশা বোধ করছি। মহান আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।