দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

উইন উইন সিচুয়েশন চায় না দিল্লি


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৫০

তৌহিদ হোসেন জয়শঙ্কর

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
বাংলাদেশ ও ভারত- দুই প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ স্থল ও জলসীমা রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকারটাও বড়। দুই দেশের বহু নাগরিকের আত্মীয়-স্বজনেরও সংযোগ রয়েছে। দুই দেশেই অনেক মানুষের নাড়ির টান রয়েছে। আদর্শিক কারণে যখন ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়ে যায়, তখন পূর্ববঙ্গ থেকে যেমন হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, তেমনিভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচুর মুসলিম পূর্ব বাংলায় আসে। এছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্য বিহার, ঊড়িষ্যা, আসাম ও ত্রিপুরা থেকেও লাখ লাখ মুসলিম পূর্ব বাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আসে মুহাজির হিসেবে। এ মাইগ্রেশন তথা অভিবাসনের কারণে দুই দেশের লাখকোটি জনগণের মধ্যেও আত্মীয়তার সংযোগ রয়েছে। দুই দেশের আত্মীয়দের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু ভারতের তথা দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী সরকারের কারণে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিকতাপূর্ণ এ সম্পর্কটায় ছেদ পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা শুধু শীতল নয়, অনেকটা বিরোধপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ে টাগ অব ওয়ার চলছে। বিশেষ করে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে ঢাকা ও দিল্লিতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে সম্পর্কটা বিরোধপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বেশ অভিযোগের সুরই করতে দেখা যাচ্ছে। ভারত একজন ফ্যাসিবাদীকে দিল্লিতে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। তারপরও দিল্লি অভিযোগের তীর তুলছে ঢাকার দিকে।
বাংলাদেশকে ঠিক করতে হবে ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়: জয়শঙ্কর
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়, তা তাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ঢাকা যদি নয়াদিল্লির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, তবে প্রতিদিন অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য ভারতকে দোষারোপ করা চলবে না।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার এক অনুষ্ঠানে জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার যদি প্রতিদিন উঠে সবকিছুর জন্য ভারতকে দোষারোপ করে, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। একদিকে যদি বলা হয় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় আর অন্যদিকে প্রতিদিন দোষারোপ করা হয়- এটি ঠিক নয়। এ বিষয়ে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মাসকটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের এক সপ্তাহেরও কম সময় পর জয়শঙ্কর এ মন্তব্য করলেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো আমাদের চিন্তার বিষয়। এটি এমন একটি ইস্যু, যা আমরা বার বার তুলে ধরছি। পাশাপাশি তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আছে, কিন্তু দিন শেষে আমরা প্রতিবেশী দেশ।
সম্পর্কের অবনতির জন্য ভারতীয় রাজনীতিকরা দায়ী : তৌহিদ হোসেন
বাংলাদেশের বিষয়ে জয়শঙ্করের বক্তব্য প্রদানের পর মোটামোটি কড়া জবাব দিল ঢাকা। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের বক্তব্যের পাল্টা জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন দুষলেন ভারতীয় রাজনীতিকদের। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার বিষয়ে বলতে গিয়ে ভারতবিরোধী বক্তব্যের যে উদাহরণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর টেনেছেন, সেটির জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন; প্রতিবেশী দেশটির রাজনীতিবিদদের নিয়েও পাল্টা দোষারোপ করলেন তিনি।
ভারত থেকেও বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য আসার উদাহরণ দিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার তিনি বলেন, ‘উনাদের মুখ্যমন্ত্রী তো পারলে এখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী ফোর্স পাঠিয়ে দেয়। উনাদের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অহরহ বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।’
‘এগুলো চলতে থাকবে ধরে নিয়েই আমরা চেষ্টা করছি, সম্পর্ক ভালো করা যায় কি না। কাজেই আমাদের অবস্থান সেটাই। আশপাশ থেকে দু’চারজন কী বলল না বলল সেটাতে মনোযোগ না দিয়ে আমরা বরং আমাদের সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করি।’
সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে জয়শঙ্করের বক্তব্যের বিরোধিতায় তিনি বলেন,‘“সংখ্যালঘু সম্পর্কে উনি আবার বলেছেন। সংখ্যালঘুর বিষয়টা হচ্ছে যে, এই অভিযোগগুলো প্রধানত ভারতীয় মিডিয়ায় একটা বিকৃত তথ্যপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে, তার ভিত্তিতে এগুলো বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তার থেকে বড় কথা হলো যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু তো ভারতের বিষয় হতে পারে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাংলাদেশের বিষয়; যেমন- ভারতের সংখ্যালঘু কেমন যত্ন পাবে, সেটা ভারতের বিষয়। আমি মনে করি যে, এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে আমাদের যেতে হবে।’
‘আমাদের সংখ্যালঘুদের বিষয়টা আমরা দেখছি। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। আমার যতটুকু অধিকার আছে, তাদের প্রত্যেকের ঠিক ততটুকু অধিকার আছে, এদেশের ওপরে এবং সেটাই সরকার সবসময় বাস্তবায়ন করার চেষ্টার করবে।’
অপরদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ভারত সরকার। পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ এবং ‘অতিরঞ্জিত প্রচারণার’ অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার করেছে।
বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত ইস্যু এবং শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক তলবের ঘটনাও ঘটেছে।
হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক পত্র
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। একাধিক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
এরপর প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর ভারত সরকারকে ‘কূটনৈতিকপত্র’ পাঠায় অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে ভারত এখনো তার জবাব দেয়নি।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার পাশাপাশি দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অভিযোগ এনেছে ইউনূস সরকার।
ব্যর্থতা স্বীকার করলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
নিজের ব্যর্থতা একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বললেন, নিশ্চয়ই আমি পারছি না। না হলে আমাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? তবে হ্যাঁ, যদি কাউকে পাওয়া যায় যে আমার চেয়ে ভালো করবেন, আমি সানন্দে তাকে স্বাগত জানিয়ে সরকারের দায়িত্ব থেকে চলে যাবো। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার সেগুনবাগিচায় এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন। বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীলতাকে সামাল দিতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করছে জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, এটা আমাদেরই সামাল দিতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য যে আগুনে ঘি ঢালছে, এটা স্বীকৃত। ভারতের আতিথেয়তায় শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রদান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
উইন উইন সিচুয়েশন
নিকট প্রতিবেশী বা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য পররাষ্ট্রনীতিতে উইন উইন সিচুয়েশন মেইনটেইন করতে হয়। কিন্তু বিগত দিনগুলোয় ভারত তা করতে শুধু ব্যর্থ নয়, বরং কোনো চেষ্টাও করেনি। কূটনীতিকদের অভিমত হচ্ছে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতকে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে দিল্লিকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনেই সম্পর্ককে পুনর্গঠন করতে হবে। বিগত ৫৪ বছরের অধিকাংশ সময়ই ভারত বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মেইনটেইন করেনি। সবসময়ই বড় ভাইসুলভ তথা দাদাগিরি করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তে অব্যাহতভাবে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য কমিয়ে আনতে ভারত তো কোনো উদ্যোগ নেয়নি, বরং বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বিশেষ শুল্কারোপ করেছে। বিগত দিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ভারত স্থল, জল ও রেলপথে করিডোর সুবিধা নিলেও বাংলাদেশকে নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগের কোনো সুবিধা দেয়নি। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে চিকেন নেক নামে যে করিডোর রয়েছে, তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানÑ এ তিন দেশ বাণিজ্য করার জন্য ট্রানজিট সুবিধা পেতে পারে। চিকেন নেক নামক জায়গাটি খুবই ছোট একটি এলাকা, যার দৈর্ঘ্য হচ্ছে মাত্র ২০০ কিমি. আর প্রস্থ হচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ৬০ কিমি.। ভারত যদি এ ৬০ কিমি. দিয়ে ট্রানজিট দেয়, তাহলে নেপাল ও ভুটান এ সুবিধাটা কাজে লাগাতে পারে। নেপাল ও ভুটান এ ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে পারে। কারণ নেপাল ও ভুটান হচ্ছে স্থলবেষ্টিত দেশ, যাদের নিজস্ব কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। চিকেন নেক করিডোর দিয়ে ভারত ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটান আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হতে পারে। ভারত যেমন বাংলাদেশ দিয়ে করিডোর নিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমনিভাবে দিল্লির উচিত চিকেন নেক করিডোর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা দেয়াÑ যাতে করে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। ভারত প্রতিবেশী দেশের মধ্য দিয়ে করিডোর নিয়ে নিজে আর্থিক সুবিধা ও লাভ নেবে, কিন্তু অন্য কাউকে আর্থিক সুবিধা করতে দেবে না, এমন পররাষ্ট্রনীতি দিয়েও পাশের দেশের সাথে সুসম্পর্ক থাক দূরের কথা, সম্পর্ক ঠিক রাখাই সম্ভব হয় না। গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি হচ্ছে উভয় দেশেরই লাভ বা সমমর্যাদা বজায় রাখা, যাকে কূটনীতির ভাষায় বলে উইন উইন সিচুয়েশন। কিন্তু ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে উইন উইন সিচুয়েশন মেইনটেইন করতে চায় না। ভারত শুধুই নিজের সুবিধা নিতে চায়, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোকে কোনোরকম সুবিধা দিতে চায় না। বিগত আট দশকে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে এমন আচরণের কারণে তার নিকট প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথেই সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।