সবার আগে নিজেকে গড়তে হবে


১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৩

॥ শারমিন আকতার ॥
‘পৃথিবীকে গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়’Ñ শিশু-কিশোরদের সংগঠন ফুলকুঁড়ির অসাধারণ একটি স্লোগান এটি। আসলেই পৃথিবীকে গড়তে চাইলে নিজেকে আগে না গড়ার কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি ভালো লেখক হতে চায়, তাহলে তাকে আগে ভালো পাঠক হতে হবে। ভালো লেখকের বই পড়ে জানতে হবে তারা কীভাবে লিখেছেন, তাদের লেখার উপস্থাপন কেমন। কেউ যদি ভালো শিক্ষক হতে চায়, তাহলে আগে ভালো ছাত্র হতে হবে। শিক্ষক হিসেবে যা ছাত্রদের সেখাতে চায়, আগে তা নিজেকে ভালো করে বুঝতে ও আত্মস্থ করতে হবে। তেমনি কোনো মুসলিম আল্লাহর পথে একজন দায়ি হতে চাইলে তথা আমর বিল মারুফ বা নাহি আনেল মুনকারের কাজ করতে হলে অবশ্যই আগে সেই লোককে ভালো কাজের একনিষ্ঠ কর্মী হতে হবে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে অধিক সচেতন থাকতে হবে।
এ বিষয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে, “একবার এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস রা. নিকট এসে বললেন, আমি দীনের দাওয়াত অর্থাৎ আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকারের কাজ করতে চাই। তিনি বললেন, তুমি কি উক্ত মর্যাদায় পৌঁছেছো? তিনি বললেন, হ্যাঁ আশা তো করি। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, যদি তুমি মনে কর যে কুরআন মজিদের তিনটি আয়াত কর্তৃক তোমার অপমানিত হবার আশঙ্কা নেই, তাহলে অবশ্যই তুমি দীনের দাওয়াতের কাজ করবে। সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো আয়াত তিনটি কী? ইবনে আব্বাস রা. বললেন, প্রথম আয়াত- ‘তোমরা কি লোকদের ভালো কাজের নির্দেশ দিচ্ছো আর নিজেদের কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছো?’ [সূরা আল বাকারা : ৪৪]। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তুমি কি এই আয়াতের ওপর ভালোভাবে আমল করেছো? তিনি বললেন, না। দ্বিতীয় আয়াত, “তোমরা কেন এমন কথা বলো যা নিজেরা করো না?” [সূরা সফ : ২]। এই আয়াতের ওপর কি তুমি যথাযথ আমল করছো? তিনি বললেন, না করিনি। তৃতীয় আয়াত, “সুয়াইব আ. নিজ জাতিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, আমি যেসব খারাপ কাজ করতে তোমাদের নিষেধ করেছি সেসব কাজ আমি নিজে করব এমন উদ্দেশ্য আমার নেই। বরং এমন কাজ হতে আমি নিজে বহু দূরে থাকবো এবং তোমরা আমার কথা ও কাজে কোনো অমিল দেখতে পাবে না।” [ সূরা হুদ : ৮৮]। ইবনে আব্বাস রা. জিজ্ঞেস করলেন, এ আয়াতের ওপর তুমি ভালোভাবে আমল করছো? তিনি বললেন, না। তখন ইবনে আব্বাস রা. বললেন, যাও সর্বপ্রথম নিজেকে সৎকাজের আদেশ দাও এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখো। এ হলো একজন মুবাল্লিগের জন্য প্রথম সোপান। (আল দাওয়াত)। [সূত্র : রাহে আমল, ২য় খণ্ড। হাদিস নং-৩২৫]।
আমরা সবসময় অন্যকে গড়তে চাই। আমরা অন্যকে যা বলছি, তা যদি নিজেরা না করি, মনে-প্রাণে যদি তা লালন না করি, তাহলে মানুষ যে আমাদের সে দাওয়াত গ্রহণ করবে না, তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। আমরা ভাবি, আমি ভালো কথা বললাম; দোয়া-দরূদ পড়লাম, পুরুষ হলে দাড়ি, টুপি, লম্বা পাঞ্জাবি আর নারী হলে বোরকা, হিজাব পরলাম, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, বছরে এক মাস রোজা, রোজায় বা সারা বছর সৌদি বা পাকিস্তানি মেসওয়াক দিয়ে মেসওয়াক করা, ব্যাস হয়ে গেল নিজের জীবনে ইসলামের বাস্তবায়ন!
শুধুমাত্র এটুকু ইসলাম না, ইসলামের একটা খণ্ডাংশ; ইসলামী আনুষ্ঠানিকতার একটা অংশ মাত্র। ইসলামের একটা খণ্ডাংশ নিয়ে আমরা নিজেকে এত বেশি ব্যস্ত রাখি যে নিজেদের অজান্তে ইসলামী মূল্যবোধের যে সামগ্রিক রূপ আমরা আমাদের সমগ্র জীবনে এড়িয়ে গেছি তাই বুঝতে পারি না। তাই তো আমরা না রাসূলের আদর্শে নিজেকে গড়তে পারি, না অন্যকে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইউনাইটেড কিংডম লন্ডনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফারুক মুরাদ গত বছর ১১ অক্টোবর সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় তার সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন বলি ইসলামী মূল্যবোধ, এটা শুধু বাহ্যিক কোনো বিষয়কে বোঝায় না। যেমন শুধু মানুষের পোশাক পরিবর্তন, মহিলারা চাকরি করে কিনা, পুরুষদের দাড়ি আছে কিনা। ইসলামী মূল্যবোধ সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কের একটি বিষয়। ইসলামের আদর্শের অনুসারী ব্যক্তিদের সাথে এর সম্পর্ক আরও বেশি। কারণ এটাই ইসলামের মূল ধারণা। মাকাসিদ আল শরিয়াহর অর্থাৎ ইসলামী শরিয়াহর মূল উদ্দেশ্যও তাই। সামাজিক অবিচার ও অন্যায় দূর করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা…।” এ জায়গায় আমরা বাঙালি মুসলিমসহ এশিয়া ও প্রাচ্যের মুসলিমরা আসলেই অনেক পিছিয়ে।
পশ্চিমা বিশ্বের লোকেরা শুধুমাত্র বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক, পরকীয়া ও অবাধ নারী স্বাধীনতার বিষয়ে আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকলেও ইসলামী মূল্যবোধের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ; যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, মুয়ামালাত তথা অর্থনৈতিক লেনদেনে ন্যায়নিষ্ঠ থাকা, মুয়াশারাত তথা সুন্দর আখলাক যেমন মিথ্যা কথা না বলা, ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা রাখা, অন্যের হক নষ্ট না করা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধের সবটা পশ্চিমারা লালন না করলেও সামগ্রিক অর্থে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ইসলামী অনুশাসন খুঁজে পাওয়া যায় পশ্চিমের দেশে। আর আমাদের এশিয়া ও প্রাচ্যে পাওয়া যায় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইসলাম। সামগ্রিক ইসলামী রূপ সুদূরপরাহত বিষয়।
একজন জাপানি নব্য মুসলিম বলেছেন, ‘আমি পশ্চিমা দেশগুলোয় অমুসলিমদের ইসলামের বিধান পালন করতে দেখি, আর পূর্বের দেশগুলোয় মুসলিম দেখি, কিন্তু কোনো ইসলাম দেখি না। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আগেই ইসলাম এবং মুসলমানদের পার্থক্য বুঝেই আল্লাহর ধর্ম গ্রহণ করেছি।’
সারা বিশ্বে মুসলিম দেশগুলো কতখানি ইসলামিক এ নিয়ে গবেষণা করেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক হুসেইন আসকারী। তিনি তার গবেষণায় ২০৮টি দেশকে নমুনা হিসেবে রাখেন। ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র ও সমাজ চলার যে বিধান দেয়া হয়েছে, তা যে দেশগুলো প্রতিদিনের জীবনে মেনে চলে, তা খুঁজতে যেয়ে গবেষণার ফলাফলে দেখতে পান, যে দেশগুলো সত্যিকারভাবে ইসলামিক বিধানে চলে, তারা কেউ মুসলিম দেশ নয়।
স্টাডিতে দেখা গেছে, সবচেয়ে ইসলামিক বিধান মেনে চলা দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড এবং দ্বিতীয় অবস্থানে লুক্সেমবার্গ। তারপর এসেছে পর্য্যায়ক্রমে আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ষষ্ঠ ও কানাডা সপ্তম অবস্থানে। মালয়েশিয়া ৩৮তম, কুয়েত ৪৮তম, বাহরাইন ৬৪তম এবং অবাক করা কাণ্ড সৌদি আরব ১৩১তম অবস্থানে। গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান সৌদিদেরও নিচে। গবেষণায় দেখা গেছে, মুসলমানরা নামাজ, রোজা, সুন্নাহ, নিয়মিত কুরআন পড়া, হিজাব, দাড়ি, লেবাস নিয়ে অতি সতর্ক কিন্তু রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনে ইসলামের আইন মেনে চলে না।
একজন বিধর্মী চাইনিজ ব্যবসায়ী বলেছিলেন, “মুসলমান ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসে দুই নম্বর নকল জিনিস বানানোর অর্ডার দিয়ে বলে, অমুক বিখ্যাত কোম্পানির লেবেল লাগাবেন। পরে যখন তাদেরকে বলি আমাদের সাথে খানা খান, তখন তাঁরা বলেন, হালাল না, তাই খাবো না। তাহলে নকল মাল বিক্রি করা কি হালাল?”
আমাদের শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইসলাম মানার প্রবণতা থেকে বের হয়ে সুন্দর মুয়াশারাত, মুয়ামালাত ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ইসলামে নিজের জীবন সাজাতে হবে। নিজে দোয়া-দরূদ পড়লাম, ফরজের সাথে নিয়মিত নফল নামাজ পড়ে গেলাম সওয়াবের আশায়। আর মানুষকে সেসব কাজ করতে বললাম; আর মানুষ ভালো হয়ে যাব এমন প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। নিজে সত্যের সাক্ষ্য না হতে পারলে তথা নিজেকে নিজের জীবন, নিজের পরিবার ও সমাজ থেকে অন্যায় দূর করার সংগ্রামে যুক্ত না রেখে অন্যকে কীভাবে সত্যিকারের সত্যের দাওয়াত দেব আর মানুষ তা গ্রহণ করবে?
আপানারা বাচ্চাদের কথাই ভাবেন, বাচ্চারা আমাদের কথার চেয়ে আমাদের কাজকে অনুসরণ করে বেশি। আমরা যদি রাতের বেলা ঘুমাতে যাবার আগে সন্তানকে বলি রাতে ব্রাশ করে ঘুমাতে হয়, তাহলে আমাদের বাচ্চারা এমনি এমনি আপনার, আমার কথা শুনবে না। আদেশ অনুসরণ করবে না। কিন্তু আমরা যদি নিজে ব্রাশ করি, আর বলি রাতে ব্রাশ করে ঘুমাতে হয়, তাহলে দাঁত ভালো থাকে, সকাল বেলা মুখে দুর্গন্ধ হয় না। তাহলে দেখবেন আপানার ও আমার সাথে সাথে সেও ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করা শুরু করেছে।
এরকম প্রতিটি ভালো কাজ আপনি আমি যদি নিজে করি, তাহলে সেও করবে। মিথ্যা আপনি আমি নিজে বলি, আবার বাচ্চাকে বলি মিথ্যা বলা মহাপাপ! বাচ্চা আপনার, আমার নীতিবাক্যের কোনো মূল্য দিবে? আপনি, আমি নিজে বাচ্চাকে নানা ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা রাখি না। আবার বাচ্চাকে বলি ‘ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা না রাখা মুনাফিকের কাজ’। সে আপনার, আমার এ হক কথা মানবে? আপনি-আমি নিজের বাবা-মা, নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান করি না, কিন্তু বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সারাক্ষণ বয়ান দিই বাবা-মার আদেশ মান্য করতে হয়, বাবা-মাকে সম্মান করতে হয়, সে আপনাকে, আমাকে সম্মান করবে? আমাদের কারও থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা করলে সবার আগে সেটা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। লর্ড বার্নার্ড শ একবার বলেছিলেন, ‘ইসলাম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং মুসলমানরা হচ্ছে সর্ব নিকৃষ্ট অনুসারী।’
ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক মোহাম্মাদ ফারিস তার “প্রোডাক্টিভ মুসলিম” বইয়ে উল্লেখ করেন, “অসাধারণ কিছু মূল্যবোধ আর গাইডলাইন নিয়ে ইসলামের আগমন। বাইর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়; বরং ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মার্জিত ব্যবহার, আল্লাহ ও তার রাসূল সা.-এর নির্দেশনার কাছে আত্মসমর্পণই ইসলাম। এসব মূল্যবোধের মধ্যে বসবাস করলে কিংবা নিজেদের জীবনে তার বাস্তবায়ন করলে কেবল ব্যক্তির উৎকর্ষতাই নিশ্চিত হয় না; বৃহদার্থে গোটা সমাজ কাঠামো তার বেনিফিসিয়ারি হয়। আমানতদারিতা, সততা এবং ইহসান (মহত্ত) আমাদের জীবনের ব্যাপারে সত্যবাদী করে তোলে। সুবিচার, দয়ানুভবতা এবং সৌজন্যতা সমাজে আমাদের সম্মানিত ও মর্যাদাবান হিসেবে জায়গা করে দেয়। ঠিক এ কারণেই ইসলাম তার অনুসারীদের এমন এক নৈতিক কম্পাস ব্যবহার করতে বলে, যা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের দিক নির্দেশনা করবে।”
সবার শেষে সুফি কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই, “গতকাল চালাক ছিলাম, তাই পৃথিবী বদলাতে চেয়েছিলাম… আজ আমি বিজ্ঞ তাই নিজেকে বদলাতে চাই।”
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও সম্পাদক, মহীয়সী ডটকম।