গণঅভ্যুত্থানগাথা

খেতে বসে ভুলে এখনো শহীদ তানহাকে ডাকেন মা


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৯

বাসস : মিরপুরের হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়তেন মেহেরুন নেছা তানহা। তার বাবা মোশাররফ হোসেন (৬৪) গাড়িচালক। অসচ্ছল হলেও সবাইকে নিয়ে মোশাররফের ছিল সুখের সংসার। বাবার ১৬ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না। তাই বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাসার পাশেই একটি শোরুমে চাকরি করে পড়ালেখার খরচ চালাতেন তানহা। পরিবারকেও সহায়তা করতেন।
রাজধানীর মিরপুর-১৩ এর কাফরুল থানার ৪নং ওয়ার্ডের পূর্ব বাইশটেকের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মেহেরুন নেছা তানহার বাবা মোশাররফ হোসেন ও তার গৃহিণী মা আছমা আক্তার (৪৫) এসব কথা বলেন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না, বুঝিও না। আমার মেয়েও রাজনীতি করত না। ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর মিরপুরের মাজার রোডে মিছিলে ছিল তানহার মামাতো ভাই আকরাম খান রাব্বি। এমবিএ পরীক্ষা দিয়েছিল সে। ছেলেটার হাতে জায়নামাজও ছিল। কোনো অপরাধ করেনি। তবে পুলিশ প্রথমে রাব্বির হাতে গুলি করে। মাটিতে পড়ে গেলে পেটে গুলি করে। তিন দিন হাসপাতালের মর্গে রাব্বির লাশ আটকে রেখেছিল। পচাগলা লাশ ফেরত দিয়েছে। গোসল পর্যন্ত করানো যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘রাব্বি হত্যার পর বদলে যেতে শুরু করে তার ছেলে ও মেয়ে। তানহা প্লাকার্ড লিখত, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। এটা লিখে রাস্তায় দাঁড়াত।
শুরুর দিকে আন্দোলনে কম গেলেও মামাতো ভাইকে হারানোর পরে ওদের আর ঘরে রাখা যেত না। আমি অনেক চেষ্টা করেও ওদের আন্দোলন থেকে ফেরাতে পারিনি। ওরা বলতো, আমার ভাই শহীদ হয়েছে, আমরা ঘরে বসে থাকলে চলবে না। এ সরকারের পতন ঘটানোর জন্যই আন্দোলনে যেতে হবে।’
তানহার আব্দুর রহমান তারিফ (১৯) নামে একটি ভাই রয়েছে। সে এ বছর (২০২৪) এইচএসসি পাস করেছে। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তানহার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার আজিমনগর গ্রামে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা মানুষ উল্লাস শুরু করে। বিজয় মিছিলে অংশ নিতে তানহা ও তার ভাই তারিফ বাসার বাইরে বের হন। গণভবনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিজয় উৎসবে মাতেন তারা। একপর্যায়ে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় বাসায় ফিরে আসেন মেহেরুন নেছা তানহা। তবে সে সময়ে মিরপুর-১৩ এর নতুন বাজার এলাকায় গোলাগুলি চলছিল। বাসায় ফিরে মার হাত থেকে পানি খেয়ে, নিজ রুমে গিয়ে মাথার চুল বেঁধে পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই জানালা দিয়ে একটি গুলি এসে তানহার বুকে লাগে এবং তিনি রুমের মধ্যে পড়ে যান। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ৫ আগস্ট রাত পৌনে ৮টায় তানহা শহীদ হন। পরে সেই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মিছিলে যেতে মানা করতাম। মেয়ে শুনত না। অন্যদিনের মতো ৫ আগস্টও শেখ হাসিনার পালানোর খবরে গণভবনে যায় তানহা। ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। রাত পৌনে ৮টায় বাসায় ফিরে ঘরের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার সামনে মরে গেল। আমি এ হত্যার বিচার চাই।’
তানহার মা আছমা আক্তার বলেন, ‘ওইদিন রাতে মেয়ে আমার জন্য ফুল নিয়ে আসে। এসে বলে মা দেখো, তোমার জন্য গণভবন থেকে ফুল নিয়ে এসেছি। নাও এটা গণভবনের ফুল। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। সারা রাস্তা হেঁটে এসেছি। আমি ওকে পানি দিই। পানি খেয়ে ও নিজের চুল আঁচড়িয়ে রুমের লাইট বন্ধ করে নিজের পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি তানহাকে বলি চারদিকে ঝামেলা হচ্ছে, ভাই কোথায়? তানহা বলে ও যে কোন দিকে গেল আমি জানি না। তখন ছেলেকে ফোন দিতে বলি, ওর ভাই তারিফকে ফোন দিয়ে বলে নতুন বাজারের দিকে ঝামেলা হচ্ছে। তুই পেছনের রাস্তা দিয়ে বাসায় আয়, এই কথা বলা শেষ হতেই তানহা মেঝেতে পড়ে যায়। আমি তাকিয়ে দেখি মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওর বুক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তখন আমি ওর আব্বাকে ফোন করি। ওর আব্বা দৌড়ে এসে ওকে ধরে নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
মাকে দেওয়া শেষ উপহারের ফুলগুলো দেখিয়ে তানহার মা বলেন, ‘দেখো বাবা আমার মেয়ের দেওয়া ফুলগুলো আমি যত্নে রেখে দিয়েছি। ও আর কোনোদিন ফিরবে না। আমি ফুলগুলো যত্নে রেখে দিয়েছি। কিন্তু ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে।’
আছমা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েটা ঝাল খেতে পছন্দ করতো। বোম্বাই মরিচ তার খুব পছন্দের ছিল। প্রতি শুক্রবার নিজ হাতে পোলাও-মাংস রান্না করতো। এখন আমি পোলাও-মাংস রান্না করতে গেলেই মেয়েটার কথা মনে হয়। ওরা ভাই-বোন এক রুমে ঘুমাত। তানহা চলে যাওয়ার পর ওর ভাই ঠিকমতো ঘুমায় না, খাবার খায় না, কথাও বলে না।’
তিনি আরো বলেন, আশা ছিল মেয়েটা পড়ালেখা শেষ করলে একটা চাকরি করবে। ভালো ঘর দেখে ওর একটা বিয়ে দেব। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এখনো ভুল করে অনেক সময় খেতে বসে ডাকি, ‘তানহা খেতে আয়’। কিছু সময় পরে মনে হয়, ও কীভাবে খেতে আসবে? চোখের পলকেই আমার সব শেষ হয়ে গেল। এখন আর আমাকে কেউ বলে না ‘আমি বেতন পেয়েছি, মা তোমার কি লাগবে’? এই বলে কাঁদতে থাকেন মা আছমা আক্তার।
তানহার বাবা বলেন, ‘ওর মা যখন ফোনে আমাকে বলে তানহার গুলি লাগছে। আমি নিচে ছিলাম। দৌড়ে বাসায় আসি। এসে দেখি মেয়ে আমার মেঝেতে পড়ে আছে। ওর শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে। তখন ওকে আমি একটু পানি খাওয়াই। মা, মা বলে ডাকি, মা আমার চোখ খোলে না। আমার দিকে তাকায় না। পরে আলোক হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। মাটা আমাকে ছেড়ে চলেই গেল। আমি এমন হতভাগ্য বাবা, আমার কোলের মধ্যে মেয়েটা মারা গেল, আমি কিছুই করতে পারলাম না।’
কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা- জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি।
মেয়ের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা আছমা আক্তার। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নির্দোষ মেয়েটারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা দিল। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যৎ চাই। আমার এ অল্প আয় দিয়ে তো সংসার চলে না। আমার বয়স হয়েছে। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান, আমার ছেলের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করেÑ যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ওর যেন একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
মেহেরুন নেছা তানহার মামা ফারুক খান বলেন, ‘আমাদের একমাত্র ভাগ্নি ছিল তানহা। তাই আমরা সবাই ওকে আদর করতাম। আন্দোলনে আমার ছেলে (ওর ভাই রাব্বি) শহীদ হয়েছে ১৯ জুলাই। এরপর থেকে তানহা ওর মামিকে দেখাশুনা করার জন্য আমার বাসাতেই ছিল। ৫ আগস্ট সকালে নিজের বাসায় আসে। কেন যে মেয়েটাকে আসতে দিলাম। যদি আসতে না দিতাম, তাহলে ছেলের পর ভাগ্নিটারে হারাতে হতো না।’
এদিকে মেহেরুন নেছা তানহা হত্যার ঘটনায় তার বাবা মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।