গণপরিষদ গঠনের আগে নির্বাচনের সুযোগ নেই


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:২১

॥ জামশেদ মেহ্দী॥
উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ। এটি কবি শামসুর রাহমানের কবিতার একটি লাইন। তিনি আওয়ামী ঘরানার কবি ছিলেন। তিনি কবিতাটি লিখেছেন এরশাদের সামরিক শাসনকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তার কবিতার এ লাইন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য কিনা বিচার করা কঠিন। এখন বাংলাদেশে যে সরকার রয়েছে, সেটি কোন্ ধরনের সরকার? সেটি কি বিপ্লবী সরকার? যদি বিপ্লবী শব্দ ব্যবহার করতে না চান, তাহলে প্রশ্ন হবে- এটি কি গণঅভ্যুত্থানের সরকার? নাকি এটি সাংবিধানিক সরকার? আসলে আপনি এ সরকারকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বা ইতিহাসের কোনো সংজ্ঞাতেই ফেলতে পারেন না। ৫ আগস্ট যখন ঢাকা মহানগরীতে প্রায় কোটি খানিক লোক বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শেখ হাসিনাকে ধরার জন্য গণভবনের দিকে ছুটে আসছিলেন, তখন প্রাণ ভয়ে হাসিনা সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। ফলে বাংলাদেশ অকস্মাৎ প্রশাসন শূন্য অথবা সরকার শূন্য হয়ে পড়ে। এমন একটি পরিস্থিতিতে গণবিপ্লবের (আমরা এটিকে গণবিপ্লব বলেই মনে করি) নায়করা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এর ২ দিন আগেও অর্থাৎ ৩ আগস্টেই তারা ভাবতে পারেননি যে এর ১ দিন পর ২ দিনের মাথায় এমন মহাদানবীয় সরকার এভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে যাবে। হাসিনার পতন হলে পরবর্তীতে কী ধরনের সরকার গঠিত হবে, কাদেরকে নিয়ে গঠিত হবে- এ সম্পর্কে তাদের কোনো ব্লুপ্রিন্ট বা নীলনকশা ছিল না। দেশের মধ্যে সেই সময় সর্বজন গ্রহণযোগ্য এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় এমন কোনো ব্যক্তিও চোখে পড়ছিল না, যাকে সরকারপ্রধান করা যায়। এমন ক্রিটিক্যাল একটি মুহূর্তে ছাত্রনেতাদের মাথায় আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। তখন তিনি প্যারিসের একটি হাসপাতালে শুয়েছিলেন। তার একটি ছোট্ট অপারেশন হয়েছিল। ছাত্ররা তাকে দেশের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। অনেক সাধা-সাধির পর ২৪ ঘণ্টা পরে তিনি রাজি হন এবং পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ড. ইউনূসের বিমান যখন ঢাকার উদ্দেশে আকাশে উড়লো, তখন ঢাকায় এক ভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া এ বিপ্লবের শুরু এবং শেষ সম্পর্কে ফেসবুকে অনেকগুলো স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এসব স্ট্যাটাসের মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি প্রদত্ত ১৭নং স্ট্যাটাসে এ নাটকের শেষ অংশের মঞ্চায়নের চিত্র এঁকেছেন। এখানে তিনি বলেন, নাটকের চূড়ান্ত দৃশ্য অভিনিত হলো সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। এখানে বিএনপির অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে আকবর এবং সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী বা ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে সেনাপ্রধান কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সেনা সদরে ডাকেন। এরা হলেন বিমানবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, ৫টি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ড. আসিফ নজরুল। এই ৫টি রাজনৈতিক দলের প্রধানদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আরো দুজন নেতা। জেনারেল ইকবাল করিমের মতে, এ উদ্যোগটি ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। কারণ যারা বিজিত বা পরাজিত তারা বিজয়ীদের কাছে যায়। কিন্তু এখানে যারা বিজয়ী তারাই বিজিত বা পরাজিতদের কাছে গেলেন।
সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান, ডিজিএফআই প্রধান এবং রাজনীতিবিদ ও আসিফ নজরুলের এ বৈঠকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। জেনারেল ইকবাল করিমের মতে, সেনাপ্রধান সংবিধানকে বাতিল না করে বহাল রাখা এবং প্রেসিডেন্টকেও বহাল রাখার ওপর Insist (জিদ) করেন। (আমি এই ইংরেজি শব্দটি রেখে দিলাম। কারণ জেনারেল ভূঁইয়া ঐ শব্দটি ব্যবহার করেছেন)। তিনি আরো বলেন, কেয়ারটেকার সরকারের পরিবর্তে বর্তমান সংবিধানের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার বা ইন্টারিম গভর্মেন্ট গঠন করা হোক। পরবর্তীতে তারা বঙ্গভবনে মিলিত হন। সেখানে ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং ড. ইউনূসও উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই ঠিক করা হয় যে ড. ইউনূস হবেন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান। (আসলে সামরিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী কেয়ারটেকারের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়)। এ স্থানে সাবেক সেনাপ্রধান মন্তব্য করেছেন যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে যে বিপ্লবের শুরু হয়েছিল, তার সুর কার্যকরভাবে নরম করা হলো। জেনারেল করিম এ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা হুবহু তুলে দেওয়া হলো। A revolution that had begun with significant momentum was effectively toned down, delivered through a figurative premature caesarian by a small circle of powerbrokers.

এমন স্বতঃস্ফূর্ত একটি বিপ্লবকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবের পথ অনুসরণ করে বিপ্লবীদের উচিত ছিল, শুধুমাত্র গণভবন নয়, বঙ্গভবনও দখল করা এবং সংবিধান বাতিল করা এবং প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা। আরো প্রয়োজন ছিল সেই সব সামরিক অফিসার, যারা শেখ হাসিনার সরকারের দোসর ছিল, তাদের অপসারণ করা। যদি সেটা করা হতো, তাহলে বিপ্লব তার সফল পরিণতি পেতো।
জেনারেল করিমের মতে, এরপর উচিত ছিল একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা। এ বিপ্লবী পরিষদ নতুন একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পুরনো শাসন ব্যবস্থা (হাসিনার শাসন ব্যবস্থা) বিসর্জন দিয়ে একটি নতুন বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারতেন। সেই বিপ্লবী সরকার ফরমান জারির মাধ্যমে ব্যাপক সংস্কার করতেন এবং একটি নতুন সংবিধান রচনা করতেন। প্রয়োজন হলে তারা একটি গণপরিষদ গঠন করতে পারতেন। এজন্য দরকার হলে নির্বাচিত সরকারে ফিরে যাওয়ার পূর্বে একটি গণভোট অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সেনাবাহিনী অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পুরনো গৎবাঁধা সরকার গঠন করেন। এভাবে এক নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ হারিয়ে গেল। আর সেই সাথে খুলে গেল আরেকটি নতুন দরজা। যে দরজা দিয়ে আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য সুড়ৎ করে ঢুকে গেল আরেকটি রাজনৈতিক দল। এর ফলে আবার একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার গঠনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হলো।
আসলে বিগত ৬ মাস ধরে বাংলাদেশের শিক্ষিত সচেতন জনগণের মনের মধ্যে যেসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেসব প্রশ্নের মোটামুটি জবাব মিলেছে জেনারেল করিমের আলোচ্য স্ট্যাটাস থেকে। আসলেই একটি সম্ভাবনাময় বিপ্লব সাংবিধানিক চোরাগলি পথে হারিয়ে গেল। শেখ হাসিনার পতন তো সাংবিধানিক পথে হয়নি। কোটি জনগণ রাজপথে নেমে তাকে ধরার জন্য গণভবন অভিমুখে ছুটে গিয়েছিলেন। প্রাণ ভয়ে হাসিনা পালিয়ে যান। সেনা সদর এবং বঙ্গভবনে বৈঠকের পর শেখ হাসিনার জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। যদি সংবিধানের কথাই বলা হয়, তাহলে জাতীয় সংসদ ভাঙা তো সংবিধান মোতাবেক হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ মোতাবেক প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংসদ ভাঙতে হবে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হন এবং ২০ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। তার উপদেষ্টা পরিষদকে ইন্টারিম গভর্মেন্ট বলা হয়। আবার বলছি, সংবিধানে তো অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো প্রভিশন নেই। জাতীয় সংসদ ভাঙা হলো, কিন্তু সংবিধান অক্ষত রইল। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নেন এবং সংবিধান রক্ষা করার ওয়াদা করেন।
যদি সংবিধান এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে সেই সংবিধানের ১২৩নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ইউনূসের শপথ গ্রহণের দিন থেকে (৮ আগস্ট ২০২৪) ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। সেটি তো করা হয়নি। সব বিষয় জগাখিচুড়িতে রূপান্তর করা হয়েছে।
একদিকে বিএনপি নির্বাচন চাচ্ছে; অন্যদিকে এ সরকার রাষ্ট্রের সংস্কার করতে চাচ্ছে। সংস্কার করার জন্য ১০টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন সংস্কার কমিশনসহ ৪টি কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। এসব রিপোর্টে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, সংখ্যানুপাতিক সংসদীয় আসন, জনপ্রশাসন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৪টি প্রদেশ গঠন ইত্যাদি রয়েছে। ৪টি কমিশনের রিপোর্টের প্রধান অংশগুলো আমাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো আলোচনা করা থেকে বিরত রইলাম। প্রশ্ন হলো, সংস্কার কমিশনসমূহের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। অথবা নতুন সংবিধান লিখতে হবে। নতুন সংবিধান লেখায় বাধা দিয়েছে বিএনপি। তাহলে বর্তমান সংবিধানের সংস্কার কোন পথে হবে? একটি জাতীয় দৈনিককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, এসব সংস্কার কে করবে? দেশে কোনো পার্লামেন্ট নেই। নাই কোনো গণভোটের ব্যবস্থা। নেই কোনো গণপরিষদ। তাহলে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দিস্তার পর দিস্তা কাগজে কিছু সুপারিশ লিখলেই হলো?
একই প্রশ্ন করা যেতে পারে মির্জা ফখরুলকে। তারা অবিলম্বে নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে গেছেন। যদি নির্বাচন করতে হয়, তাহলে কোন সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হবে? বর্তমান সংবিধান? ধরে নিলাম, বর্তমান সংবিধানের অধীনে ৩০০টি আসনে নির্বাচন হলো। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তারা তো ইচ্ছামতো সংবিধান সংস্কার করতে পারবেন না। কারণ সংবিধান ৭ (খ) অনুচ্ছেদ এবং ৯৩ অনুচ্ছেদ নতুন পার্লামেন্টের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। ৭ (খ) অনুচ্ছেদে এ সংবিধানের ৫৪টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে হাত দেওয়া যাবে না। ৯৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, যদি প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে কোনো সংশোধনী আনতে চান, তাহলে সেই সংশোধনী এ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। আপনি যে কোনো সংশোধনী আনুন না কেন, সেটি ৭ (খ) অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক হবেই। সুতরাং কোনো সংস্কার হতে পারবে না। ৪টি প্রদেশ গঠন তো বর্তমান ইউনিটারি বা এককেন্দ্রিক সরকারকে রূপান্তর করে ফেডারেল সরকারে পরিণত করবে। ৭ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনোভাবেই সেটা করা যাবে না। তাহলে উপায় কী?
উপায় আছে। একটি মাত্র উপায়। আর সেটা হলো সর্বাগ্রে গণপরিষদের নির্বাচন। এখানেও একটি সমস্যা রয়েছে। সেটি হলো, এ সংবিধানে গণপরিষদ গঠনের কোনো প্রভিশন নেই। সবচেয়ে সহজ সমাধান ছিল সংবিধান বাতিল, বর্তমান প্রেসিডেন্টকে অপসারণ এবং ড. ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা। অতঃপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ড. ইউনূস অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংস্কার করবেন এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমেই গণপরিষদ গঠনের আদেশ দেবেন। যেসব দেশে মার্শাল ল হয়েছে তারা প্রথমেই সংবিধান বাতিল করেছে। তারপর অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশ চালিয়েছে এবং ধীরে-সুস্থে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেছে। বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তাই হয়। ফরাসি, রুশ, মার্কিন প্রভৃতি দেশে বিপ্লবের পর এভাবেই সংবিধান রচিত হয়েছে। ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ আজ গণতন্ত্রের রোলমডেল।
জগাখিচুড়ি তো আগেই পাকানো হয়েছে। আরেকবার সেটা পাকাতে হবে। ড. ইউনূস প্রেসিডেন্ট চুপ্পুকে দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের ফরমান জারি করাবেন। অতঃপর গণপরিষদ গঠিত হবে। সেই গণপরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে। সংবিধান প্রণয়ন করার পর গণপরিষদ ভেঙে যাবে এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এভাবেই দেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরতে পারে। গণপরিষদ গঠন ছাড়া পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নাই। এটা বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে।