গণপ্রত্যাশা

নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, নতুন রাজনৈতিক দল ­


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:১৭

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
দেশে বর্তমানে রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারসহ রাজনৈতিক জোট ও ভোট নিয়ে যেমন আলোচনা-পর্যালোচনা, প্রতিবেদন ও সমীক্ষার কাজ চলছে, তেমনিভাবে অন্য একটি নতুন মাত্রা নিয়েও কথা হচ্ছে আরো জোরালোভাবে। তা হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তথা নতুন ধারার চিন্তা-চেতনা নিয়ে নয়া নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন। আমাদের ভূখণ্ডে বিগত এক শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। তা যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতা, তেমনি রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনÑ কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। এত পরিবর্তনের পরও রয়ে গেছে সেই পুরনো রাজনৈতিক পদ্ধতি তথা বন্দোবস্ত। ব্রিটিশ আমলে এক ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল, পাকিস্তান আমলে তার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তারপর ১৯৭২ সালে বেশ পরিবর্তন করে আরেকটি ধারার প্রচলন করা হয়েছিল। সে ধারা বা রাজনৈতিক বন্দোবস্তে বাংলাদেশ ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলেছে। ১৯৭২ সালে যে ধারা ও বন্দোবস্ত শুরু করা হয়েছে, তা যে ব্যর্থ হয়েছে, তা আজ অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত। শুধুমাত্র জাগতিক উন্নয়ন সামনে রেখে ১৯৭২ সালে যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা দ্বারা বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল, তা সফল হয়নি। তথা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য যে আহ্বান জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি আজও। তাই আজ বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবারই এক সুরÑ সাধারণ জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার, নতুন নেতৃত্ব দরকার, নতুন সংবিধান দরকার। শুধু তাই নয় একটি সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনেরও প্রস্তাব করেছে। তাই দরকার সব পুরনো জঞ্জাল, পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঝেড়ে ফেলে নতুন নেতৃত্ব ও নতুন রাজনৈতিক দল এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই বাংলাদেশে শত বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল যেমন আছে, তেমনি নতুন দলও আছে। এসব পুরনো দলের মধ্যে একটি দল অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনিভাবে দেশ-জাতি সবাই চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আট দশকের একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আজ রাজনীতির থেকে ছিটকে পড়েছে। ছিটকে পড়া বললে ভুল হবে আসলে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট হিসেবে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ না হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক ময়দানে শুধু নিষিদ্ধই নয়, একটা ঘৃণিত দলে পরিগণিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারই ডানপন্থি ও ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে রাজনীতিতে নেতিবাচক ও নিষিদ্ধের রাজনীতি চালু করেছে। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ সব ইসলামী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২৪ সালের ১ আগস্টও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল। নেতিবাচক ও নিষিদ্ধের রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিনিয়ত ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছে। কালক্রমে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ উত্তরাধিকার সূত্রেই একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল।
অপরদিকে দেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং এখনো ক্ষমতার জন্য ও ক্ষমতার সাথে থেকে রাজনীতি করে তাদেরও ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানটা জোরালো নয়। একটি দল তো ফ্যাসিবাদের ক্ষমতার সঙ্গীই ছিল। আর সে দলটি হচ্ছে গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারী এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। গণতন্ত্রের নামে জাতীয় পার্টি বিগত ফ্যাসিস্ট শাসকের শুধু সহযোগীই নয়, তাদের কারণেই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন এত দীর্ঘায়িত হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের নামে বাম রাজনীতি ও লাল সন্ত্রাসের ধারক-বাহক বামপন্থি দলগুলোও ফ্যাসিবাদের সহায়ক হিসেবে আজ গণধিকৃত।
ইতিহাসের এমন নয়া বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেশে নয়া সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত, রাজনৈতিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আধুনিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও পদ্ধতি চালু করা পুরনো ধাঁচের রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে সম্ভব নয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলের অভ্যুদয় খুবই প্রাসঙ্গিক।
নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই বছর তিনেক আগে গঠিত হয়েছে নতুন ধারার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে বিডিপি। এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত দলটি ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধনও পেয়েছে। এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলামকে সভাপতি ও মুহাম্মদ নিজামুল হক নাইমকে সেক্রেটারি করে ১৫১ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটির দলটি সারা দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করা দলটি ইতোমধ্যে সারা দেশে ৪৩টি জেলা ও ৩১৩টি উপজেলায় কমিটি গঠন করেছে। দেশ ও জাতির ব্যাপারে বিডিপির অঙ্গীকার কীÑ এ ব্যাপারে দলটির সভাপতি এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলামের সাথে সোনার বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যয় হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত নৈতিকভিত্তিক একটি স্বাবলম্বী ও কল্যাণমূলক বাংলাদেশ গঠন করা।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রনেতার নেতৃত্বে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ নামে আরেকটি নয়া রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। বিগত ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে একটি মিছিল বের করে দলটি তার জানান দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিসুর রহমানকে প্রধান করে ৭৭ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। দলটির দ্বিতীয় নেতা সাংগঠনিক প্রধান হচ্ছেন ঢাবির আরেক ছাত্রনেতা শফিউর রহমান, আহ্বায়ক খোমেনি এহসান ও সদস্য সচিব হাসান আরিফ।
আসছে ছাত্রনেতাদের নয়া দল
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের একাংশের নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নয়া আরেকটি রাজনৈতিক দল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে তারা দল গঠনের কাজটি গুছিয়ে এনেছেন। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ময়দানে তৎপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে চলতি মাসের দ্বিতীয়ার্ধেই এ নতুন রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আসছে বলে ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃবৃন্দ।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে সারা দেশের নাগরিকদের মতামত গ্রহণের কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, নতুন দলটি আদর্শগতভাবে মধ্যমপন্থি ধারার হবে। দলের নাম কী হবে, সে বিষয়ে বেশকিছু প্রস্তাব তারা পেয়েছেন। তবে এখনো কোনো নাম চূড়ান্ত হয়নি। দলের প্রতীক কী হবে, সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, আমরা একটা মধ্যমপন্থি রাজনীতির কথা বলছি। এটাই আমাদের আদর্শ হবে। আমরা বাম-ডান এমন যে বিভাজন আছে, সেগুলোয় ঢুকতে চাই না। আমরা বাংলাদেশ প্রশ্নে এক থাকতে চাই। ইসলামফোবিয়ার রাজনীতি অথবা উগ্র ইসলামপন্থি বা উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যে আমরা নেই।
তিনি বলেন, আমরা জনগণের কাছে গিয়ে যে ধারণা পেয়েছি এবং বিভিন্ন জরিপেও একটা নতুন দলের আকাক্সক্ষা আছে জনগণের মধ্যে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদের মানুষ দেখেছে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে জনগণের একটা বিশাল অংশ আছে, যারা নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব দেখতে চায়। সে জায়গা থেকে আমরা মনে করি, আমাদের দল গঠিত হলে সেটা জনসমর্থন পাবে। ধীরে ধীরে আমরা একটা বড় দলে পরিণত হতে পারবো।
এক তরুণ উপদেষ্টা নয়া দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্র্বর্তী সরকারের এক তরুণ উপদেষ্টা পদত্যাগ করে নতুন এ দলের দায়িত্ব নিতে পারেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক সূত্র বলছে, প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী অন্তর্র্বর্তী সরকারে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে যে তিনজন উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ) আছেন, তাদের মধ্যে একজন পদত্যাগ করে দলের নেতৃত্ব নেবেন। অন্য দুজন আরও পরে সুবিধাজনক সময়ে পদত্যাগ করে দলে যোগ দিতে পারেন। ওই দুজনের একজন আগামী জুন মাসে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলে যোগ দিতে পারেন।
জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ফেব্রুয়ারির শেষাংশে তাদের রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। দলটি ডান ও বামধারার বাইরে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে মধ্যমপন্থি দল হিসেবে রাজনীতি করবে। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন; কিন্তু কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ননÑ এমন ব্যক্তিদের তারা নতুন দলে নিয়ে আসতে চান।
দলের নাম, নেতৃত্ব, আত্মপ্রকাশের নির্দিষ্ট তারিখ বা কোথায় ও কীভাবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হবে, সেগুলো নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে বলে জানান আখতার হোসেন। তিনি বলেন, ‘শীর্ষনেতৃত্ব নিয়ে আমরা জনমত যাচাই করার চেষ্টা করছি। অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাদের নাম এক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আবার তাঁরা পদত্যাগ করলে সরকারে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বটা কীভাবে থাকবে, সেই আলোচনাও হচ্ছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি সূত্র বলছে, নতুন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আসতে পারেন একজন উপদেষ্টার ভাই। তিনি এখন নাগরিক কমিটির সদস্য। তবে শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরও জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি ‘সিভিল পলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বহাল থাকবে। একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও কার্যক্রম চলবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা প্রথম কমিটি করে গত বছরের ৮ নভেম্বর। এরপর থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৫৭টি থানা ও উপজেলায় প্রতিনিধি কমিটি করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সব মিলিয়ে সারা দেশে তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথম কমিটি করে গত ২ নভেম্বর। এরপর থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩০টি জেলা, ৫টি মহানগর, ৮টি থানা, ২টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি কলেজ ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটিতে তাদের সদস্য রয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার।
ছাত্রদের দল করা দরকার : ড. ইউনূস
নতুন দলের বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ছাত্রদের দল করা দরকার। কারণ রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদের রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেই সব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যদের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ খুঁজছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়তো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না, তারা আমাদের দেশে যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কিনা। এ ধরনের সুযোগ আছে, যা আমাদের নিতে হবে। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে। তিনি বলেন, তরুণরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা নেই। তারা এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার।
রাজনৈতিক দল গঠনের অগ্নিপরীক্ষা
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে রাজনৈতিক বাস্তবতায় নয়া রাজনৈতিক দল গঠন এবং দলকে প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন কাজ। কারণ ইতোপূর্বে ক্ষমতাসীন তিনটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থেকেই রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের সমর্থন নিয়ে তৃণমূল থেকে রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক কঠিন লড়াই ও সংগ্রাম করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী বড় দল হিসেবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীই তৃণমূল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের দলে পরিণত হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীকে এ পর্যায়ে আসতে অসংখ্য নেতাকর্মীকে বহু বছর ধরে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, জীবন ও রক্ত ঝরাতে হয়েছে। এককথায় একদল নেতাকর্মীর দীর্ঘদিনের সাধনার পর আজকে জামায়াতে ইসলামীর এ রাজনৈতিক অবস্থান।
বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের প্রেক্ষিতে নতুন পরিবেশে নয়া রাজনৈতিক দল গঠন করা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছেÑ ছাত্র-জনতার মধ্যে একটি নয়া আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে এবং জনগণ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়। তাই একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের যদি কোনো দল ও ছাত্ররা যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারে, তাহলে নতুন রাজনৈতিক দল জনসমর্থন পেতে পারে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য একটি নাম, কর্মসূচি ও নেতৃত্বই যথেষ্ট নয়, তাকে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণে জনসমর্থন পেতে হবে। রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের জনগণের সামনে যেতে হবে এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও নৈতিকতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই নতুন রাজনৈতিক দল জনসমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে সময়-মেধা-শ্রম তথা জীবন বিসর্জন দিয়ে বিদায় নিতে হবে। রাজনৈতিক দার্শনিকের একটি অমূল্য বাণী আছে, ‘রাজনীতি হচ্ছে আগুনের পোশাক’। রাজনীতিবিদদের এ আগুনের পোশাক পরেই রাজনীতি করতে হয়। এ পোশাক দেখতে যেমন উজ্জ্বল, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভুল করলে এ আগুনের পোশাকে জ¦লে-পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে।