ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালানোর ৬ মাস


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:১৪

স্টাফ রিপোর্টার : ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার তার পালানোর ৬ মাস হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় গত বছরের ৮ আগস্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ব্যাপক প্রত্যাশার এ সরকারের ছয় মাসে প্রাপ্তির হিসাব পুরোটা না মিললেও এখনো আশাহত নয় জনগণ। নানা সংকট থাকলেও রাষ্ট্র মেরামত, দুর্নীতি দমনসহ সুশাসন ইস্যুতে জনগণের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান তার সরকারের সব মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতাকর্মীরা। ওইদিনই শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন, তার কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবন জনগণের দখলে চলে যায়। ফ্যাসিবাদের চিহ্ন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডির শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয় মরহুম স্বামীর বাসভবন সুধাসদন এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনে জনগণের রোষের আগুন লাগে। জনগণের সম্পদ লুট করে গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের বিনাভোটের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মুখে পড়ে। ফ্যাসিবাদের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে জনগণের পক্ষ থেকে জোর দাবি ওঠে।
এ সময় আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের কেউ কেউ স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ আকাশপথেও বিদেশ যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিদের একটি অংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। কেউ কেউ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হন। এখনো দলটির অনেক নেতা আত্মগোপনে আছেন। তাদের কেউ কেউ নতুন করে আটক হচ্ছে। কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বিদেশেও চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
এদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মামলার সংখ্যা আড়াইশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা দুই শতাধিক। এখনো নতুন নতুন মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হচ্ছে। এসব মামলায় পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদেরও আসামি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একাধিক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
দেশে আত্মগোপনে থাকাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, এডভোকেট কামরুল ইসলাম, কাজী জাফরউল্লাহ, রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। এছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ‘সুবিধাভোগী’ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে একাধিক মামলায় হুলিয়ার মুখে থাকা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ওই চিঠিতে সাড়া দেয়নি ভারত সরকার। উল্টো শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ মেয়াদে ট্রাভেল পাস দিয়েছে দেশটি। যদিও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। অবশ্য হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করার অনুরোধ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন দেশে দলের নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। ওই বক্তব্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরাসহ ইউনূস সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
বিগত ছয় মাসে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের দুর্নীতি-অনিয়মের নানা ফিরিস্তি সামনে আসছে। ক্ষমতার অপব্যহার ও অনিয়মের মাধ্যমে শেখ হাসিনা নিজে ও তার পরিবারের সদস্যদের পূর্বাচলে সরকারি প্লট বরাদ্দের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে দুদক তদন্ত করছে। বাংলাদেশে ৯টি অবকাঠামো প্রকল্প থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও এ সময়ে এসেছে। এতে তার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের নাম উঠে আসে। ওই ঘটনাসহ যুক্তরাজ্যে ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারি ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে টিউলিপ সম্প্রতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরে ২৫ বিঘা জমির ৪টি বাগানবাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। চারটি বাগানবাড়ির মধ্যে একটির মালিক শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। একটির মালিক শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক। বাকি দুটির মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
হাসিনার গুমের ঘটনা তদন্তে এ সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি গঠন করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একাধিক টাস্কফোর্সও। গুম কমিশন ও টাস্কফোর্সগুলো ধাপে ধাপে তাদের প্রতিবেদন দিতে শুরু করেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি সময়মতো তার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শেখ হাসিনাবিহীন বাংলাদেশ গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা ক্ষেত্রে প্রশংসা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী ড. ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণ দেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনসহ চারটি বিদেশ সফরকালে বিশ্বনেতারা তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কিছুটা শীতল সম্পর্ক তৈরি হলেও বাংলাদেশ তাদের ছাড় দিচ্ছে না।