একজন দাঈ ইলাল্লাহর জন্য অনুসরণীয় ১০ মূলনীতি


৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ সৈয়দ এমরান হোসেন ॥
এ পৃথিবীর জীবনে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন পেশায় বা কাজে নিয়োজিত থাকে। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ কৃষিজীবী, কেউ আবার পেশাজীবী। আর বিভিন্ন পেশার এ মানুষদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান আবার বিভিন্ন পর্যায়ের। যারা কেবল দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দেয়, তারা সাধারণত একজন মানুষের সফলতাকে সংজ্ঞায়িত করে তার পেশাগত জীবনের অর্জন থেকে। তাদের দৃষ্টিতে একজন জেলে বা মুদি দোকানদার থেকে একজন বহুজাতিক কোম্পানির কর্ণধার পেশাগত জীবনে অনেক সফল। এ আধুনিক দুনিয়াবি মানসিকতা, সফলতাকে পার্থিব অর্জনের সাথে একাকার করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের রব, আমাদের আল্লাহর কাছে মানুষের কাজের মূল্যায়ন একেবারে ব্যতিক্রম। আমরা কি জানি মানুষের কোন কাজটা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? আমরা কি জানি যে সেই কাজটা আমরা সবাই করতে পারি কিনা? কীভাবে করতে পারি? আমার এ লেখনীতে আজ সেই কাজটির ব্যাপারেই সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব, ইনশাআল্লাহ্। উল্লেখ্য, আমরা জীবন-জীবিকার জন্য যে পেশাই গ্রহণ করি না কেন, একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের সবার ওপর ‘দাঈ ইলাল্লাহ’র দায়িত্ব পালন করা ফরজ। কথার মাধ্যমে না পারলেও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যে কাজ করছি, যেখানে আমার চরিত্র ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দাঈ হিসেবে উপস্থাপন করতেই হবে।
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দের বান্দা হলেন একজন ‘দাঈ ইলাল্লাহ’। একজন দাঈর সংজ্ঞা হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে মূলত অন্যদের কাছে আল্লাহর এ দীনের দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (হা-মীম আস সাজদা : ৩৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অতঃপর (আল্লাহর নৈকট্য তারাও লাভ করতে পারে) যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরে ধৈর্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরে দয়ার উপদেশ দেয়। তারাই হলো ডানপন্থী, তারাই সফলকাম।” (বালাদ : ১৭)।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে দাঈ হওয়াটা ঐচ্ছিক কোনো আমল নয়। আমাদের অবশ্যই এ আমলটি করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। যদি না দাও, তাহলে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলে না।” (মায়েদা : ৬৭)। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবর্তমানে দাওয়াতের এই গুরুভার তাঁর উম্মতের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা আমাদের ওপর এসে পৌঁছেছে। একটি হাদিস থেকে দাওয়াতি কাজের অপরিহার্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি এটা তার দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে মুখ দ্বারা বাধা দিবে, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দ্বারা (তাকে ঘৃণা করবে)। আর এটাই হলো দুর্বলতম ঈমান।” (মুসলিম)।
এ লেখনীতে আমি দাওয়াতি কাজের ধরন, প্রকৃতি, প্রয়োজনীয়তা কিংবা এর সুফল নিয়ে নয়, বরং দাওয়াতি কাজের কিছু মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করবো। কিছুদিন আগে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিনের লিখিত একটি বইয়ের অনুবাদগ্রন্থ ‘ইসলামী জাগরণ : নীতি ও নির্দেশনা’ বইটি পড়ছিলাম। এই বইটিতে শাইখ চমৎকারভাবে দাওয়াতি কাজের বেশকিছু মূলনীতি আলোচনা করেছেন। আমি সংক্ষিপ্তাকারে সেখান থেকে ১০টি মূলনীতি তুলে ধরবো।
প্রথম মূলনীতি হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাকে সম্পূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরা: কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে কখনোই প্রকৃত সাফল্য আশা করা যায় না। দাঈ এবং মুসলিমরা যখন কুরআন এবং সুন্নাহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে, তখন তাদের বিজয় আসবেই এ কথা আজ মুসলিমরা ভুলতে বসেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা দেখি, রাসূল (সা.)-এর সময়ের রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস সাহাবী আবু সুফিয়ানকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা বলছ, তা যদি সত্য হয়, তাহলে শিগগিরই তিনি আমার দু-পায়ের নিচের ভূমিও শাসন করবেন।’ (বুখারী)। সেই সময় হেরাক্লিয়াস জেরুসালেমে অবস্থান করছিলেন আর ঐ উক্তির ঠিক ছয় বছর পরই খলিফা ওমর (রা.) শাসনামলে মুসলিমরা জেরুসালেম বিজয় করে। ইসলামের শত্রুরা তাই আজও মুমিনদের কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত রাখার জন্য নিরলস ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে। হায় আফসোস, আমরা তো অনুধাবনই করতে পারছি না!
দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “(হে রাসূল!) বলে দিন, এটাই আমার পথ। আমি নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করে, তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র ও মহান। এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা ইউসুফ: ১০৮)। আল্লাহ আরোও বলেন, “(হে নবী!) আপনি আপনার পালনকর্তার পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা আহ্বান করুন এবং তাদের সাথে উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করুন।” (সূরা নাহল : ১২৫)।
তৃতীয় মূলনীতি হচ্ছে সঠিক অনুধাবন: মাসলা-মাসায়েল, কুরআনের আয়াত, হাদিসের তরজমা শুধু জানলেই হবে না তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে হবে। ঐশী জ্ঞানের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো হেদায়াত ও শিক্ষা গ্রহণ। চতুর্থ মূলনীতি হচ্ছে হিকমত: দাওয়াতের ক্ষেত্রে হিকমতের চারটি পর্যায় রয়েছে- ১. জ্ঞান; ২. স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া; ৩. সীমালঙ্ঘন করেনি এমন কোনো ব্যক্তির সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা; ৪. সীমালঙ্ঘনকারীর পাপকর্মে বাধা দেওয়া। দাওয়াতি কাজ সব সময় হিকমতের সাথেই পরিচালিত করতে হবে। যেমন ধরুন, জাকাতকে ফরজ করা হয় ২য় হিজরিতে, কিন্তু নবম হিজরিতে নবী মুহাম্মদ (সা.) ব্যক্তিদের কাছ থেকে জাকাত সংগ্রহ করার জন্য সংগ্রাহক পাঠানো শুরু করেন।
পঞ্চম মূলনীতি হচ্ছে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই।” (সূরা হুজুরাত : ১০)। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহর দাস হয়ে যাও- পরস্পর ভাই হিসেবে।” (সহীহ মুসলিম)।
ষষ্ঠ মূলনীতি হলো আল্লাহর পুরস্কারের কথা ভেবে সবর করা: দাওয়াতি কাজ করতে গেলে বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত অথবা বিভিন্ন রকম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করা, কষ্ট সহ্য করা এবং সর্বদা আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিবন্ধকতা যেন আমাদের আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত না করে। আল্লাহর রাসূল যখন তায়েফ থেকে জখম এবং অপমানিত হয়ে ফিরছিলেন, তখন জিবরিল (আ.) পাহাড়ের ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে তাঁর কাছে আসলেন। পাহাড়ের ফেরেশতা বলল, “আপনি যদি চান, আমি ওদেরকে আখশাব পাহাড়দ্বয়ের মাঝে চাপা দিয়ে পিষে ফেলব”। নবী (সা.) বললেন, “না, আল্লাহ হয়তো তাদের মধ্য থেকে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন, যারা আল্লাহর ইবাদত করবে।” (সহিহ বুখারি)। পরিবার-পরিজনের, প্রতিবেশী এবং সমাজের বিভিন্ন মানুষের সাথে সবর এখতিয়ারের মাধ্যমে আমাদের আচার-ব্যবহার সবসময় সুন্দর রাখতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধরো ও ধৈর্যে অটল থাকো এবং পাহারায় নিয়োজিত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো, অবশ্যই তোমরা সফল হবে।” (আলে ইমরান : ২০০)।
সপ্তম মূলনীতি হলো চমৎকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া: মানুষকে ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া এবং নিজেই তা না করা একজন দায়ীর জন্য অত্যন্ত দুর্বলতা। রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত (আল কলম : ৪)। রাসূল (সা.) বলেন, “মানুষের মাঝে ওই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়, যে তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উত্তম চরিত্রের অধিকারী”। (ইবনে মাজাহ)।
অষ্টম মূলনীতি হচ্ছে দয়াশীলতা ও বিনম্রতা : আল্লাহর পথে আহ্বানের ক্ষেত্রে আমাদের সদয় ও বিনম্র হওয়া উচিত। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে আয়েশা! নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়াময় ও করুণাময়, তিনি নম্রতা পছন্দ করেন এবং তিনি নম্রতার প্রতিদানে এমন কিছু দেন, যা কঠোরতার প্রতিদানে দেন না।” (সহীহ মুসলিম)। বিনয় এবং নম্রতার দলিল হিসেবে কুরআনের আরো একটি আয়াত দেখা যেতে পারে যেখানে আল্লাহ বলেছেন, “অতঃপর আল্লাহর রহমতের কারণে তুমি তাদের প্রতি নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের ও কঠিন হৃদয়ের হতে, তাহলে তারা তোমার কাছ থেকে সরে পড়ত।” (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)
নবম মূলনীতি হলো আলেমদের মতপার্থক্যের ব্যাপারে উদার হওয়া আলেমদের সাথে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হলেও তাদের প্রতি সুধারণা রাখা একজন দাঈর কর্তব্য। আলেমের কোনো মতকে বাহ্যিকভাবে ভুল মনে হলেও পারস্পরিক আলোচনা করলে হয়তো বোঝা যাবে, তিনি মূলত সঠিক পথের ওপরই আছেন। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদিসটি স্মরণ রাখা উচিত “প্রত্যেক আদম সন্তান ভুল করে, এদের মধ্যে সে-ই সর্বোৎকৃষ্ট, যে ভুল করে তাওবা করে।” (মুসনাদে আহমাদ)।
দশম মূলনীতি মিথ্যা ও পাপের আধিক্য দেখে হতাশ না হওয়া; বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ মূলনীতি অনুসরণ ও অনুধাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহাগ্রন্থ আল কুরআন এ আল্লাহ্ অনেক জায়গায় বলেছেন, কিয়ামতের সেই ভয়াল দিনে কাফির/পাপাচারীদের কী করুন পরিণতি হবে আর প্রকৃত মোমিন বান্দারা কীভাবে সম্মানিত হবে। তারপরও কেন দুনিয়াতে কাফির/পাপাচারীদের প্রচার প্রসার আমাদের হতাশ করে। আমাদের মনে রাখতে হবে দীন ইসলামই সত্য দীন এবং এ দীনই বিজয়ী হবে। দেখার বিষয় হলো আমি কি এ দীনের একজন প্রকৃত অনুসারী হতে পারি কি না।
সর্বশেষে এটাই বলব, আমরা যদি দুনিয়ার বুকে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে সুনির্দিষ্ট কিছু মূলনীতির অনুসরণ করা আবশ্যক। কারণ এটি এমন এক মহৎ লক্ষ্য, যা নিছক আবেগ দিয়ে অর্জন করা যায় না। তাই আমাদের আবেগকে বুদ্ধি-বিবেচনা ও শরিয়ার বিধিনিষেধের গণ্ডিতে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

লেখক: ব্যারিস্টার-এট-ল (লিনকন্স ইন), এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, পার্টনার, এইচ এন্ড এইচ কোম্পানি।