বাংলাদেশে মহিলা ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত হাফেজা আসমা খাতুন

দুনিয়ার সফর শেষে চলে গেছেন প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে


৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥
বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের মহিলা অঙ্গনে কিংবদন্তি এক নাম হাফেজা আসমা খাতুন। গত ২০ জানুয়ারি সোমবার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখিকা, সাবেক এমপি, সাবেক ১ম মহিলা বিভাগীয় সেক্রেটারি, বাংলাদেশে মহিলা ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত, আমেরিকাপ্রবাসী নিয়াজ মাখদুম, বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সাইফুল্লাহ মানসুর ও আমাদের প্রিয় নূরজাহান শাম্মী আপার আম্মা হাফেজা আসমা খাতুন দুনিয়ার সফর শেষে চলে গেলেন প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে ওনার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।
উল্লেখ্য, হাফেজা আসমা খাতুন কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার আছমিতা ইউনিয়নের বনেরগাঁও সরকারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী ছাইদুর রহমান আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি ও ফার্সি বিষয়ের শিক্ষক, ইসলামিয়া বোর্ডিংয়ের সেক্রেটারি, পুরান থানা কোহিনূর লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের নির্বাচিত এমএলএ ছিলেন। হাফেজা আসমা খাতুন মাওলানা আতহার আলী (রহ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিজ দায়িত্বে হাফেজ হন। ৮০ দশকের দিকে মহিলা হাফেজা খুব কম পাওয়া যেত! তিনি একাধারে একজন সংগঠক, বাগ্মী, কুরআনের ব্যাখ্যাকারক, পার্লামেন্টারিয়ান ও সুলেখক ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
(১) জান্নাতি দশ মহিলা (১৯৯২)।
(২) ইসলামী সমাজ গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা (১৯৯২)।
(৩) ইসলামে পর্দা-নারী জাতির নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
(৪) আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাজানো জনপদ কক্ষনো শুধু শুধু ধ্বংস করেন না ইত্যাদি।
তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার প্রথম মহিলা হাফেজ। খালাম্মা এ সময়ে তার ছোট মেয়ে রুনী আপার বাসায় ছিলেন। খালাম্মার চলে যাওয়া যেন আমাদের সকলের মাথার ওপর থেকে মাতৃসম মমতাময়ী এক বটবৃক্ষ সরে যাওয়া। তার মমতার পরশে আমার মতো বাংলাদেশের হাজারো মেয়ে- নারী প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত হতাম।
মুমিনের মৃত্যুটা বড়ই সুন্দর! মুমিনের কোনো আকাক্সক্ষাই যেন অপূর্ণ থাকে না। মহান আল্লাহ্ কোনো না কোনোভাবে সেটা পূর্ণ করেন। শুনেছি, খালাম্মা মৃত্যুর তিন-চার দিন আগে ছোট মেয়ে রুনি আপার বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে মৃত্যুর আগের দিন রাতেই রুনি আপার বাসায় নিকটস্থ আপনজন সবাই একত্রিত হয়েছিলেন। মানসুর ভাই ও মোহসিনাও ভুলক্রমে একদিন আগেই টিকিট কেটেছিলেন বাংলাদেশে আসার জন্য, যেন মহান আল্লাহ্ মাকে শেষ দেখার ও মায়ের সান্নিধ্যে নেয়ার এক পরম সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মেজো জামাই মামুন আল আযমী ভাইকেও কাছে পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন খালাম্মা! খালাম্মার সাথে যখন আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, তখনই খালাম্মা জানালেন তার শেষ অসিয়তের কথা। উনি তার বড় ছেলে আমেরিকাপ্রবাসী নিয়াজ মাখদুমকে বলে রেখেছেনÑ ওনার মৃত্যু হলে যেন নিয়াজ ভাই জানাযার নামায পড়ান। তাই মৃত্যুর খবর পেয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে উনি দেশে চলে আসেন মায়ের অসিয়ত পূর্ণ করতে। জীবিত অবস্থায় যেমন খালাম্মার মুখে মিষ্টি একটা হাসি লেগে থাকতো, তেমনি মৃত্যুর পরও যেন মুখে সেই হাসিটাই লেগে ছিল! সুবহানাল্লাহ্।
গত কয়েক মাস আগে খালাম্মার সাথে যখন আমার শেষ দেখা হয়েছিল, তখনো বুঝতে পারিনি এটাই হবে ওনার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। আমাকে দেখে শিশুসুলভ সরলতায় অভিযোগ ও আনন্দ মিশ্রিত সুরে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, এতদিন পরে কেন মা? উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সুবাদে খালাম্মার সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মার আত্মীয় ছিলেন আমার মায়ের। মুন্নী আপা চলে যাবার পর একই নামে নাম হওয়ায় আমাকে যেন আরো বেশি ভালো বাসতেন। সেদিন গিয়েও ওনার চিরচেনা বৈশিষ্ট্য- খুব পরিপাটি দেখলাম। বললাম কেমন আছেন খালাম্মা? জবাব দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ্! আরো জানালেন, এ বয়সেও তিনি কোনো ওষুধ সেবন করেন না! এর গোপন টিপস্ হচ্ছে- উনি ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে ২ গ্লাস পানি পান করেন সবসময়। জানালেন, জেদ্দায় মুন্নী আপার বাসায় বেড়াতে গেলে আপার এক প্রতিবেশী ওনাকে পানি থেরাপির এ টিপস দিয়েছিলেন, তারপর থেকে উনি নিয়মিত মেইন্টেইন করেন। আল কুরআনকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য নিয়মিত রাতে উঠে কুরআন চর্চা করতেন।
টেবিলটি খুব সুন্দর করে সাজানো, একপাশে কুরআনের তাফসির ও হাদীসের বই রয়েছে, পাশেই সোনার বাংলা পত্রিকা। আমাকে জানালেন, সোনার বাংলায় তোমার লেখা পড়ি। আমি এ বয়সে এসেও খালাম্মার পড়াশোনায় সময় দান, রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সচেতনতা দেখে অনেকটা অবাক হয়েছিলাম! বর্তমান সময়ে আন্দোলনি জীবনে তাঁর মতো এত পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ, বিনয়ী সাদা মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। স্নিগ্ধ পরিপাটি স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল মুখাবয়বের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের কোনো বিষয়ে কখনো কোনো হা-হুতাশ করতে দেখিনি! শাম্মী আপা অসুস্থ, সেটা নিয়েও কোনো টেনশন করতে দেখিনি। নিয়তিকে মেনে নেয়ার সবর ও কি অপূর্ব শিক্ষা পেলাম ওনার কাছ থেকে।
একসময়ে সারা দেশে সম্ভাব্য সকল জনপদে হাফেজা আসমা খাতুনের দীপ্ত পদচারণায় জ্বলে উঠেছিল ঈমানী চৈতন্যের দীপ্ত শিখা। যখন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটা উন্নত ছিল না, মোবাইল তো দূরে থাক, টেলিফোনেরও সুব্যবস্থা ছিল না সে সময় দিনের পর দিন সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন, কোনো কষ্টকে আমলে নেননি। ভাবলে অবাক হতে হয়। এখন এত গাড়ি-ঘোড়া মোবাইল নেটের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তার সাথে তুলনা করার মতো যেন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জাতীয় সংসদে যখন উনি বক্তব্য রাখতেন বিরোধী পক্ষরাও তাকে বাঘের বাচ্চা বলে সম্মোধন করতেন। আসা-যাওয়ার পথে তার বর্ণাঢ্য জীবনের এমন বহু গল্প শোনাতেন! আজ ওনার সাথে সে সময়ের সুখময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে বেদনার অশ্রু ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ছে, শেষ সময়ে আরো সঙ্গ চেয়েছিলাম খালাম্মার! সময়ের অভাবে তা পূরণ হলো না। শিগগিরই আবার যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলাম, আজ খাটিয়ায় শোয়ানো খালাম্মার মুচকি হাসিসম মিষ্টি মুখটি দেখে মনে মনে স্মরণ করছিলাম-
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।
জীবিত অবস্থায় আর যেতে না পারার অপরাধবোধ নিয়ে ফিরে এলাম। আসলেই যে জীবন নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত! একদিন সে জীবনকেই ফাঁকি দিয়ে সবাইকে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।
যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়!
যার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিকতায় আজ সংগঠনের এই বিস্তৃতি, তাকে শুধু স্মরণ করলেই হবে না, তার ব্যবহারিক আচার আচরণ, সংগঠন পরিচালনা, পারস্পরিক সম্পর্ক, সবাইকে ভালোবাসা বা নিজে সবার ভালোবাসা পাওয়ার যে যোগ্যতা ছিল, সেসব আদর্শ গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যথাযথ হবে।
আজ ইসলামী আন্দোলনের অগণিত উত্তরসূরি, আমরা সবাই খালাম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, খালাম্মার তার যৌবনের সোনালি সময়ের পুরোটাই সারা দেশের প্রতিটি সবুজ জমিনে মহিলাদের মাঝে দীনের দাওয়াত দানে, দীন প্রচারের কাজে নিবেদিত ছিলেন, মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করবেন, আর বলবেন, হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল হয়ে যাও। আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য দোয়া করছি। মহান আল্লাহ খালাম্মার সকল ভালো কাজ কবুল করে তাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদায় দাখিল করুন। আমিন।