আলোকে তিমিরে

ড. ইউনূসের আশাবাদ : আমাদের ভবিষ্যৎ


৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ মাহবুবুল হক ॥
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাঝে-ভেতরে-বাইরে নরম সুরে বেশ কয়েকটি কথা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, খুব তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিতে হবে, তাহলে টুকটাক সংস্কার করে এ বছরের শেষে আমরা নির্বাচন দিয়ে দেব। বিভিন্ন ইন্টারভিউতেও তিনি এ ধরনের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, সংস্কার না চাইলে নির্বাচন দিতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশবাসীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী নির্বাচন নাও হতে পারে। আড়ালে-আবডালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাওয়ার ইঙ্গিতও তিনি প্রদান করেছেন। তার এসব কথায় দেশবাসী হতাশ হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, নানা ধাঁচের প্রেসার গ্রুপ তার এসব কথার মৃদু সমালোচনা করে তাকে ধৈর্য ধারণের পরামর্শ প্রদান করেছেন। বিশেষ করে দেশের প্রধান স্টেকহোল্ডার, যারা বিদেশে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করেন, তারা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নানা ভঙ্গিমায় অনুরোধ করেছেন, স্যার, দয়া করে চলে যাবেন না। সরকারে আপনি আছেন বলে আমরা রেমিট্যান্স বাড়িয়ে দিয়েছি। রেমিট্যান্সের অর্থ আগের মতো ঢালাওভাবে লুটপাট হচ্ছে না। তবে হচ্ছে, কারণ সরকার একটা শ্বেতহস্তী। এ শ্বেতহস্তীর আশ্রয়ে লাখ লাখ আমলা, মধ্যমমানের কর্মকর্তা ও দরিদ্র সাধারণ কর্মচারীসহ বিশাল বাহিনী নানাভাবে আশ্রয় উপভোগ করছেন। তাদের মধ্যে এখনো শতকরা ৭০ ভাগ পূর্ববর্তী সরকারের ঠাণ্ডামাথার অনুবর্তী রয়েছেন। তাদের কারণে সরকার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। তারা নেগেটিভ কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য তারা অহর্নিশ কাজ করছেন। সেসব কাজের একটা ফলাফল তো আছে! যা হোক, দেশপ্রেমিক নাগরিক ঘৃণা করলেও ফলত তাদের অপকর্মে বাধা বা প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারছে না।
অভিজ্ঞ নাগরিকদের পরামর্শ হলো, তাড়াহুড়া করে কোনো কিছু করা যাবে না। সংস্কারের রিপোর্টগুলো হাতে পেলে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
ইতোমধ্যে হুটহাট করে অনেক দাবি-দাওয়া উচ্চকিত হয়েছিল। সম্ভবত সেনাবাহিনীসহ দেশের ছাত্র-জনতা যেসব সামাল দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিগণ সেসবের কোনো জবাব না দিয়ে আপন ধারায় পরিকল্পনা ও কাজ আনজাম দিচ্ছেন। আলোচনা-সমালোচনার জোয়ার কিছুটা ভাটা পড়লে এবং সারা দুনিয়ার হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতদের আসা-যাওয়া বেড়ে গেলে একটা সাধারণ স্বস্তি এসে যায়। ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা সামনের নির্বাচন সেরা নির্বাচন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এ আশাবাদ দারুণভাবে যেন কাজ করে ফেলল। প্রাজ্ঞজনরা তার প্রশংসা করে বললেন, আপনি স্যার ধৈর্যধারণ করেছেন, কিন্তু নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত না করে শুধু উচ্চাশা প্রকাশ করেছেন। আপনার কথা থেকে সাধারণ যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো- নির্বাচনের বিষয়ে আপনি যাদের ওপর নির্ভর করছেন, তাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু আপনার এ আস্থা ও বিশ্বাসের পাটাতনে কারা কারা আছেন, কারা কারা আপনাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, কারা কারা সাহস জোগাচ্ছেন- সেই বিষটি ছায়া ছায়া এবং প্রচ্ছন্ন।
ধরে নেয়া যায় যে, ছাত্র-জনতা এখনো বহুলাংশে আপনার সাথে আছে। আপনার গড়া দুর্বল সরকারটিও আপনার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। হয়তো সেনাবাহিনীও আছে এবং আছে কিছু মধ্যম ও ছোটমানের রাজনৈতিক দল। কিন্তু আপনি খুব স্পষ্ট করে জানেন যে, বড় দুটি রাজনৈতিক দল এবং পার্শ্ববর্তী দেশসহ পাশ্চাত্যের কিছু দেশ খুব শক্তভাবে আপনার সরকারের বিরুদ্ধে লেগে আছে। তারা অনুমান করছে, আপনি বিজয় লাভ করলে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও জনগণসহ ইসলামী যোদ্ধারা দারুণভাবে বিজয় লাভ করবে। গণতন্ত্রীরা ইসলামের ভয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে দেশে দেশে আদর-যত্ন করে বসানোর উদাহরণ ইতোপূর্বে অনেকবার সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্র গোল্লায় যাক, মানবাধিকার গোল্লায় যাক, বিশ্বায়ন গোল্লায় যাক, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি গোল্লায় যাক, তবু ইসলামকে ঠেকাতে হবে। তাই আপনার ব্যক্ত আশাবাদে উদ্বেলিত হলেও এসবকে অনেকে উদ্দীপনা হিসেবে অনুভব করার প্রয়াস পাচ্ছে।
সেরা নির্বাচন উপহার দিতে হলে আরো অনেকগুলো ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সংস্কার আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো সেরা জিনিস অর্জন করতে হলে শুধু সেরা মাল-মসলা দিয়ে হবে না। উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন হবে। এর জন্য প্রচুর সময় লাগবে। খামোখা আইওয়াশ করে লাভ নেই। সত্য কথাটি আপনাকে সাহস করে বলতে হবে। কথা বলতে হলে রাজনীতিবিদ হবার দরকার নেই। নাট্যকার হবার দরকার নেই, কূটনৈতিক হবার দরকার নেই, দরকার শুধু হলো চরম ও পরম সত্যের উপলব্ধি এবং সেই উপলব্ধি ও বিবেচনাকে সাহসের সাথে খোলামেলাভাবে প্রকাশ করা। আমরা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করি, আপনি রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স (চালাকি) করতে পারবেন না। আপনি যা পারবেন, তা হলো সত্যকে সহজভাবে নিশ্চিত করা। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ, সকল রাসূলগণ বলেছিলেন, ‘ওমা আলাইনা ইল্লাল বালাগ’। আমাদের দায়িত্ব হলো সত্যকে পৌঁছে দেয়া। ধুনফুন করে এবং নানারকম কায়দা-কানুন ও ফন্দি-ফিকির করে সত্য লুকিয়ে লাভ নেই। সত্যকে সরাসরি প্রকাশ্যে উচ্চকিত করতে হবে। আপনাকে দৃঢ়তার সাথে বলতে হবে, অন্তত ৪ বছর লাগবে দেশকে সঠিক পথে আনতে। সঠিক পথ তথা সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়া সম্ভব হবে।
তবে এ কথা সত্য যে, দেশ আপনি চালান না। দেশ চালান মহান আল্লাহ। দেশ চালানোর কোনো অভিলাষও আপনার ছিল না। ইতোপূর্বে একবার আপনি দল গঠনের সাধারণ অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন এবং কিছু তৎপরতাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই তৎপরতার মধ্যে আকাশচুম্বী দৃঢ়তা ছিল না। আপনার মনের কথা এখন যেভাবে আপনি প্রকাশ করেন, তখন কিন্তু আপনি সেভাবে মন খুলে কথা বলতেন না। এখন কথা বলায় আপনাকে যত স্বচ্ছভাবে আমরা অনুধাবন করতে পারছি। বেয়াদবি নেবেন না, স্যার, তখন কিন্তু আপনার স্বপ্ন, ইচ্ছা, পরিকল্পনা এবং এর বিস্তর সম্পর্কে আমরা অমল বিমল কোনো সারংসংক্ষেপ নির্ণয় করতে পারতাম না। তবে কথা ‘চাউর’ হয়েছিল যে, তিনি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন। নিজের ইচ্ছায় এবং অন্য কোনো দেশের ইচ্ছায়। যা হোক, রাজনীতির বিষয়ে আপনি খুব বেশি মগ্ন গবেষণায় নিবৃত্ত ছিলেন না। আপনি ব্রিলিয়ান্ট মানুষ। আপনার দেশি-বিদেশি বন্ধুদের মধ্যেও অনেক ব্রিলিয়ান্ট ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের পরামর্শে হোক, আপনি রাজনীতির বিষয়টি থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এই যে অল্প সময়ের মধ্যে একটা চমৎকার সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পেরেছিলেন, এজন্য দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ দিলে দিলে, মনে মনে আপনাকে খোশ আমদেদ জানিয়েছিলেন।
এবার ছিল একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আপনার সাথে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটা ন্যূনতম যোগাযোগ ছিল। সে কথাটাও সচেতন কিছু মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানত না। এখন অবশ্য একটু একটু করে প্রকাশ হচ্ছে যে, যেভাবেই হোক বিপ্লবী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আপনার একটা দূরতম সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে বেশি গবেষণার কিছু নেই। আপনি যদি বিদেশি হতেন বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের নাগরিক হতেন, তাহলে হয়তো নানা প্রশ্ন উঠতে পারত।
তবে এদেশের কোটি কোটি মানুষের সাথে আপনিও স্বৈরাচারের দাবানলে পুড়েছিলেন। জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। স্বৈরাচারী হাসিনা কষ্টের বিষয়ে, জুলুমের বিষয়ে আপনাকে কোনো ছাড় দেননি। আপনার ওপর জুলুম ও অত্যাচার কমানোর জন্য আপনার বিদেশি বন্ধুরা স্বৈরাচারী হাসিনাকে অনেক উপরোধ-অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু স্বৈরাচারী হাসিনা সেসবে কান দেননি। ঘটনা যা হোক, আপনি যতটুকু অত্যাচারিত হচ্ছিলেন, সিঁড়ির অপর পিঠে তার দ্বিগুণ, তিনগুণ আপনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এ জনপ্রিয়তার পেছনে শুভেচ্ছা ছিল। শুভ কামনা ছিল। দোয়া ছিল। ভালোবাসা ছিল। শ্রদ্ধা ছিল এবং ছিল অন্তহীন দোয়া ও আশীর্বাদ।
এখন তো দেশবাসী জেনেই ফেলেছে, এ অন্তর্বর্তী সরকারের ‘ক্যাটালিস্টরা’ আপনাকে সরকারের প্রধান বানাতে চায়নি। তারা অন্য একজনকে সিলেক্ট করে রেখেছিলেন। যার কথা এখন দেশবাসী সবাই জানে। সেদিকে আমরা এখন যাচ্ছি না। আমরা বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় সাইডলাইনের বহু কিছু ভুলে থাকার জ্ঞানার্জন করেছি। বিজ্ঞরা বলেন, ঐক্যের জন্য সবকিছু ভুলে যাও, শুধু ফান্ডামেন্টাল জিনিসগুলো মনে রাখ। আমরা অনেক কষ্ট করে অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ মুহূর্তে দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঐক্য। কার ঐক্য? রাজনৈতিক দলের ঐক্য। রাজনৈতিক আদর্শের ঐক্য। দারিদ্র্যবিমোচনের ঐক্য। বৈষম্য দূরকারীদের ঐক্য। স্বৈরাচারবিরোধীদের ঐক্য। বিপ্লবী বা অভ্যুত্থানকারীদের ঐক্য। জাতীয়তাবাদীদের ঐক্য। ইসলামিস্ট ঐক্য। আন্তর্জাতিক মতবাদপন্থীদের ঐক্য।
উপরোক্ত বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানোর পূর্বে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস থেকে একটা দৃষ্টান্ত আমরা নিতে পারি। পাকিস্তান জন্মের অব্যবহিত পর পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম যে স্লোগান উচ্চকিত করলেন, তা ছিল- ইউনিটি, ফেইথ ও ডিসিপ্লিন অর্থাৎ ঐক্য, ঈমান ও শৃঙ্খলা। যারা ভেবেছিল ইসলামের জন্য পাকিস্তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে, অর্থাৎ টু-নেশসন থিওরি বা দ্বি-জাতিতত্ত্বকে পাকিস্তান হাসিলের মূল প্রণোদনা ভেবেছিল, তারা হায় হায় করে বলে উঠল- ইয়ে ক্যায়া হ্যায় ‘ঈমান’ চালা গিয়া দো নম্বর মে? ওরা আন্তরিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে ভেবেছিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমে ঈমানের কথা বলবেন, তারপর ঐক্য এবং শৃঙ্খলার কথা বলবেন। তিনি প্রথমে ঐক্যের কথা উচ্চকিত করায় অনেকেই তখন শুধু নারাজ হয়েছিল এমন নয়, তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। তারা ঈমানকে সামনে আনতে চেয়েছিল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক বিবেচনা দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এ মুহূর্তে পাকিস্তানি জনগণকে ঐক্য ও সবার সাথে সংহতির জন্য সিসাঢালা প্রাচীরের মতো একাট্টা হতে হবে। না হলে যে জাতি এখনো সংহত হয়নি, সবল হয়নি, ডিফেন্সিভ হয়নি। সে জাতির মধ্যে যা পাওয়া গেছে, তা নিয়ে ঐক্য এবং সংহতির দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। জাতিকে একটা সবল জাতিতে পরিণত করতে হবে। জাতিকে ডিফেন্সিভ হওয়ার সাথে সাথে অফেন্সিভ মুডে রিহার্সেল দেয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ অসুস্থ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপূর্ব উপদেশ গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। এখন পর্যন্ত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেয়া স্লোগানের সেনটেন্সটি অবিকল তেমনি রয়েছে। অর্থাৎ ঈমান শব্দটি শুরুতে আসেনি, ঐক্য শব্দটি শুরুতে রয়ে গেছে।
কোনো দেশের বা কোনো জাতির কল্যাণ ও মঙ্গলময় কোনো বিষয় আমরা কখনো অস্বীকার করিনি। আমরা বুঝের জাতি, বোদ্ধার জাতি, সমঝদার জাতি।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন বা তার কিছু পর নেহরুর জাতি নেহরুকে প্রশ্ন করেছিলÑ আপনি তো, কথা দিয়ে কথা রাখেননি। আপনি কংগ্রেসি হয়েও গরিবের কথা বলেছেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলেছেন, বৈষম্য দূর করার কথা বলেছেন, সাম্যবাদ, সমতাবাদ অর্থাৎ কমিউনিজম, সোশ্যালিজম ইত্যাদির কথা বার বার উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এখন তো সেসব নিয়ে ভাবছেন না, কোনো পরিকল্পনা করছেন না। স্বাধীনতার পূর্বে আপনারা যেসব স্লোগান দিয়েছিলেন, যেসব স্লোগান তো এখন স্টোররুমে ঢুকে গেছে।
এ বিষয়ে নেহরুও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একই সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এখন তো আমার দেশ রিসোর্সফুল নয়। এদেশে এখন পূর্ণ দারিদ্র্য বিরাজমান। এখন যদি বণ্টনে এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে তো আমাকে বণ্টন করতে হবে দারিদ্র্য। আমি কী জনগণের মাঝে দারিদ্র্য বণ্টন করব? অবশ্যই জেনেশুনে নতুন করে দারিদ্র্য বণ্টন করা যাবে না। আগে সম্পদ অর্জন করতে হবে। তারপর আসবে বিতরণের প্রশ্ন। ধৈর্যধারণ করতে হবে। সবাই মিলে উন্নতির জন্য, সমৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে।
বিপ্লবের পর ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করা সমীচীন ছিল। যেকোনো কারণে হোক, সেটা হয়নি। যা চলে যায়, তা আর সেভাবে ফিরে আসে না। এখন ঐক্যের জন্য আমাদের কী কী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে, সেসবই হলো আমাদের প্রধান প্রায়োরিটি। স্বীকার করে নিতে হবে, আমরা একচ্ছত্র ঐক্যের মধ্যে অবস্থান করছি না। আমরা কিছুটা বিভাজন ও বিভক্তির মধ্যে অর্থাৎ বিপ্লবপূর্ব রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। দেশি-বিদেশি অনেক উপদেশক ও পরামর্শদাতা আমাদের রয়েছেন। তাদের আবার নিজ নিজ অনেক স্বার্থ রয়েছে।
একটু উদাহরণ দিয়ে বলি, আমাদের দেশে ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যখন অবারিতভাবে সৃষ্টি হচ্ছিল, তখন দেশি-বিদেশি উপদেশকরা এ উন্নাসিক প্রবণতা থামাতে বলেছিলেন। কিন্তু যেসব উপদেশক এখন আর সেসব নিয়ে কোনো কিছু উচ্চারণ করছেন না। এসব কারণ উদ্ঘাটনের জন্য জনগণকে ব্রিলিয়ান্ট হতে হয় না। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এসব ভালোভাবে জানে, বোঝে এবং উপলব্ধি করে।
ঐক্যের ডাক শুধু অন্তর্বর্তী সরকার একা দেয়নি, তাদের মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দল হলো ইসলামপন্থী বড় দল। তারা শুধু ঐক্যের আজান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েননি। ঐক্যের নিশান নিয়ে দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাদের এই ছুটে বেড়ানোর কারণে (ধর্ম, বর্ণ, আদর্শ, মতবাদ, জাতি, উপজাতি ও নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে) কিছুটা যে ফল হয়েছে, তা তো আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এই তো মাত্র সেদিন দুটি বড় ইসলামপন্থী দল কাছাকাছি হয়েছে। পূর্বের বহু বছরের বহু কষ্টের মতবিনিময়ের ফলে তারা এখন কোলাকুলিতে আবদ্ধ হয়েছে। ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। তারা অনৈক্যের দেয়াল ভেঙে ঐক্যের একটি ময়দান তৈরি করবে। সে সময়দান শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে ইনশাআল্লাহ বিস্তৃত হতে থাকবে।
ঠিক এরই পাশাপাশি দেশবাসী লক্ষ করেছে যে, একটি বড় সেকুলার রাজনৈতিক দলের সাথে একটি ছোট ইসলামপন্থী দল ঐক্যের জন্য খোলামনে আলাপ-আলোচনা করছে। দৃশ্যটি অপূর্ব, তবে অচিন্তনীয় নয়। অভাবনীয় নয়। অতীতে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ঐক্যের বিষয়ে এবার সরকার ও ইসলামপন্থী দলগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে। এ বিষয়টি সূর্যের আলোর মতো পরিষ্কার। ধারণা করি এবং দোয়া করি ইনশাআল্লাহ, এ ধারা চলতেই থাকবে।
যদি আল্লাহ না করুন, ঐক্য স্থাপতি না হয়, অর্থাৎ পরিপূর্ণ সংস্কারের পর নির্বাচনের বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত না হয়, তাহলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজন মতো ঢেলে সাজাতে হবে। অভ্যুত্থান ও বিপ্লবকারী ছাত্র-জনতাসহ যারা এ বিপ্লবের সাথে ছিলেন এবং আছেন, তাদের সংখ্যানুপাতে সরকারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এতে না পাওয়ার বেদনা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। যারা বিপ্লবের বাইরে অবস্থান নিয়েছিলেন, কোনো অবস্থায়ই তাদের সরকারের অংশীদার করা যাবে না। করা হলেও যেন অব্যাহতি দেয়া যায়, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এ ‘হায়ার এন্ড ফায়ার সরকারের’ কাজ হবে- ১. পরিপূর্ণ সংস্কার সম্পাদন করা। ২. প্রতিষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সহজ-সরল ও সাবলীলভাবে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা।
এ পদ্ধতিতে যদি অসুবিধা হয়, তাহলে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার (যারা বিপ্লবের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন বা আছেন) বা সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে।
এভাবে সবাইকে নিয়ে আমরা ধাপে ধাপে যদি এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের দেশে ধৈর্য, সংযম, সহিষ্ণুতা, সৌজন্য, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, শুভেচ্ছার গণতান্ত্রিক বাগান আমরা ইনশাআল্লাহ তৈরি করতে পারব।
কুরআন ছাড়া কোনো সংবিধান নেই। তাই আইনকানুন রক্ষার জন্য আমরা আর জীবন দেব না। জীবন দেব মানুষ ও প্রকৃতির স্বার্থ রক্ষার জন্য। সমস্ত প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য। সৃষ্টির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য।