‘ফুলকুমারী’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পিনাকীর চোখে অশ্রু
৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০
প্যারিস থেকে কামরুজ্জামান : সাধারণত একজন বিপ্লবী চোখে থাকে আগুন, তার কথায় থাকে বিপ্লবের অগ্নিবাণ। কিন্তু একজন বিপ্লবী কতটা কষ্ট তার হৃদয়ে ধারণ করলে অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় কিংবা কান্নায় ভেসে যায় তার দু’গণ্ড। সেটা প্রত্যক্ষ করেছেন গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় প্যারিসের লো পারশঁ হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত ২০২৪-এর গণআন্দোলনের অভিসংবাদিত রূপকার পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা বই ‘ফুলকুমারীর’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। শুধু লেখক নয়, অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের জুলুম-নির্যাতনের শিকার শত শত পরিবারের দুঃখের কাহিনী শুনে ।
বইয়ের লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য তার বক্তব্যে বইয়ের একটি অংশ শ্রোতাদের পড়ে শোনান। ওই সময় তিনি বাংলাদেশের টেকনাফে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার খুনি বাহিনী কর্তৃক একরাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ পর্যায়ে নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে বার বার চোখের পানি মুছতে দেখা যায় তাকে। বিপ্লবী ভট্টাচার্যকে কাঁদতে দেখে উপস্থিত সবই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন ।
উল্লেখ্য, ফুলকুমারী পিনাকী ভট্টাচার্যের শরণার্থী জীবন এবং বাংলাদেশে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত। যেখানে লেখক কোভিড মহামারির কঠিন সময়ে নির্বাসিত জীবন এবং একটি ইঁদুরের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে উপন্যাসটির পট তৈরি করেছেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইটির বাংলা এবং ফরাসি ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
বইটি ইতোমধ্যে অনলাইন মার্কেট প্লেস আমাজনে দক্ষিণ এশীয় ক্যাটাগরিতে বেস্ট সেলার হয়েছে। আলোচিত বইটি প্রকাশ করেছে প্যারিসভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা পিক্ট বুকস।
বাংলা এবং ইংরেজি দুই সেশনে পরিচালিত অনুষ্ঠানটির বাংলা সেশনের সঞ্চালনায় ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মাহবুব হোসাইন এবং ইংরেজি সেশনের সঞ্চালনা করেন তরুণ এক্টিভিস্ট মানুচেহের শাফি। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এক্টিভিস্ট মুহাম্মদ আলী চৌধুরী।
বইটির ওপর আলোচনা করেন এক্টিভিস্ট মনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী এবং পিনাকী ভট্টাচার্যের সহধর্মিণী আনজুমান আরা বেগম। প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক মান্নান আজাদ, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব টি এম রেজা, গ্লোবাল সিকিউরিটি কনসালটেন্ট আনিসুর রহমান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক অর্থ সম্পাদক, খুলনা বিভাগীয় সাংবাদিক ফোরামের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও অনলাইন পোর্টাল কুইক নিউজ ২৪ এর সম্পাদক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, কবি বদিউজ্জামান, সাংবাদিক মোসাদ্দেক হোসেন সাইফুল, নারী নেত্রী শামীমা আক্তার রুবী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মীর জাহান প্রমুখ।
ফ্রান্সের বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম, ব্যাংকার ইফতেশাম চৌধুরী, লেখক খান আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক মোমিন আনসারী, তরুণ এক্টিভিস্ট ওয়াদুদ তানভীর, শাহজাহান আহমেদসহ বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্স (বিসিএফ) এবং ফ্রান্স-বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (এফবিজেএ)-এর প্রতিনিধিরা। এছাড়া ফ্রান্সের বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্যারিস ইনস্টিউট ফর ক্রিটিক্যাল থিংকিং (পিক্ট)-এর এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর এভ্রিম সালিম সাইয়ের এবং পিক্ট-এর এডিটর এট লার্জ ডেভিড সালিম সাইয়ের।
এভ্রিম সাইয়ের বলেন, “পিনাকী ভট্টাচার্য আমাদের গবেষণা সংস্থায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ফুলকুমারী প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত। ইতোমধ্যে এটি বেস্ট সেলার হয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে পিনাকীর সাথে আরও কাজ করতে চাই।”
বইটির এডিটর ডেভিড সালিম সাইয়ের বলেন, “আমি এক বছর ধরে বইটি নিয়ে পিনাকীর সাথে কাজ করেছি। এটির শুরু থেকে প্রকাশ পর্যন্ত নানা ছন্দে বিভক্ত ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান ও এটিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনা বইটিকে কেন্দ্র করে পুরো প্রেক্ষাপট পালটে দিয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “ফুলকুমারী শুধুমাত্র উপন্যাস না। এটি মূলত একটি আত্মজীবনীমূলক কথাসাহিত্য। পাঠকরা এটিকে পছন্দ করবেন বলে আমার বিশ্বাস।”
বইটির রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, বিপ্লবীদের বেশিরভাগই সক্রিয়ভাবে দেশ জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করেন!
নিজের বিপ্লবী ও লেখক জীবনে তার স্ত্রীর অবদানের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, উপলব্ধি বিপ্লবের আরেকটি স্বপ্ন! তাই এটি আমার গল্পও! যে আপনি জানেন আমি আমার প্রেমের কাছে এবং আমার স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ আমার জীবনকাল ভালোবেসে তার সঙ্গে কাটাতে চাই। কেননা সে সর্বদা আমাকে সমর্থন দিয়েছে।
বিপ্লবীরা রোমান্টিক হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি সবসময় তরুণ ছাত্রদের বলেছিলাম যে, বিপ্লবের জন্য প্রশ্ন জাগানোর জন্য আপনাকে রোমান্টিক হতে হবে। তোমাকে ভালোবাসতে শিখতে হবে এবং যদি তুমি ভালোবাসতে না পারো, যদি না তুমি জিনিসগুলোকে রোমান্টিক করতে না পারো, তাহলে তুমি বিপ্লবী হতে পারো না। তাই বিপ্লব এমন একটি জিনিস, যা তুমি জানো। তোমার দুটি আবেগ আছে। সত্যিকারের ভালোবাসা এবং এটি তোমাকে সাহস এবং শক্তি দেয় সবকিছু কাটিয়ে ওঠার জন্য, বিপ্লব সফল করতে অনুপ্রেরণা জোগান দেওয়ার জন্য ।
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা বিপ্লব নয়, বরং এটা খুবই সফল ছাত্র আন্দোলন এবং তোমাদের সেই গানগুলো লিখতে হবে, যা আমরা ১৯৯০ সালে লিখেছিলাম। সব প্রেমের গান, ভালোবাসার গান, বিপ্লবের স্লোগান এভাবেই তৈরি হয় এবং ঠিক এটাই আমরা ২০২৪ সালে একসাথে অর্জন করেছি। যদি আপনি এ বিপ্লবের স্মৃতি চিরতরে জাগিয়ে রাখতে চান, তাহলে আমাদের সদা সর্বদা জাগ্রত থাকতে হবে- সব ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে, ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে।
পিনাকী ভট্টাচার্য আরও বলেন, বাংলাদেশি লেখকদের বৈশ্বিক পাঠকমহলকে আকৃষ্ট করতে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় লেখা উচিত। এর ফলে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।