১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস

হিজাব নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ


৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ সুমাইয়্যা সিদ্দিকা ॥
১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস! নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাজমা খানের উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে গত এক যুগ ধরে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর সব ধর্ম ও শ্রেণি-পেশার নারীর কাছে হিজাবের সৌন্দর্যকে পরিচিত করা।
ইসলামের বিধানসমূহের মধ্যে হিজাব একটি গুরুত¦পূর্ণ বিধান। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, “হে রাসূল! মুমিন পুরুষদের বলে দিন! তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” (সূরা ২৪ আন-নূর :৩০)। আল্লাহ আরো বলেন, “হে নবী! মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” (সূরা ২৪ আন-নূর: ৩১)। মূলত হিজাবের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে বন্ধ করা। যার মাধ্যমে সমাজ থেকে অনাচার বিলুপ্ত হবে। ইসলামের প্রথম যুগে হিজাবের বিধান নাজিল হওয়ার পর সর্বপ্রথম এ বিধানটি পালন করেছিলেন মহিলা সাহাবীগণ। হিজাব পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন তারা। হিজাব পালনের মাধ্যমে তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। উম্মাহর খেদমতে নিজেদের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়েছিলেন। হিজাবের মধ্যে অবস্থান করে তাদের জীবনব্যবস্থা কেমন ছিল তার কিছু খণ্ডচিত্র জানার চেষ্টা করব আজ আমরা। যার মাধ্যমে হিজাবের প্রকৃত স্বরূপ ও গুরুত্ব আমাদের হৃদময়ঙ্গম করতে সহজ হবে আশা করি।
হিজাব পালনে প্রথমেই আসে পোশাকের কথা। ঐতিহাসিক ইবন সাদ তার আত-তাবাকাত গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন যার মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি পাতলা কাপড় যাতে শরীর দৃশ্যমান হয় এমন পোশাক পছন্দ করতেন না। হযরত আয়েশা (রা.)-এর ভাতিজী হাফসা বিনত আবিদর রহমান মাথায় একটি পাতলা ওড়না পরে তাঁর সাথে দেখা করতে এলে তিনি তাকে একটি মোটা ওড়না পরতে দিয়ে বলেন, “তুমি জান না, আল্লাহ তায়ালা সূরা নূর-এ কি বলেছেন!”
পায়ের কোন অংশ বের হয়ে থাকাও ছিল তাদের কাছে অপছন্দনীয়। তিরমিযীর হাদীসে আছে, হযরত ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, “যে ব্যক্তি তার পরিধেয় বস্ত্র অহঙ্কার বসত ঝুলিয়ে দিয়ে চলা-ফেরা করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার দিকে তাকাবেন না। এ কথা শুনে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা (রা.) বললেন, তাহলে মহিলারা তাদের কাপড়ের আঁচল কীভাবে রাখবে? তিনি বললেন, এক বিঘত ঝুলিয়ে দেবে। অতঃপর তিনি বললেন, তাতে যদি তাদের পা উন্মুক্ত থাকে। তিনি বললেন, তবে এক হাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে, এর বেশি নয়।”
অন্ধ ব্যক্তির সাথে খোলামেলা চলাফেরা করাও তারা অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। আত-তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখিত আরেকটি ঘটনায় জানা যায়। ইসহাক নামে একজন অন্ধ তাবেঈ ছিলেন। একবার তিনি হযরত আয়েশা (রা.) সাথে দেখা করতে আসলে তিনি তার সাথে আড়ালে থেকে কথা বলে নিজের পর্দা করলেন। তখন ইসহাক অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমার থেকে পর্দা করছেন! আমি তো আপনাকে দেখতে পাইনে। এ কথার উত্তরে আয়েশা বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখতে পাওনা তাতে কি হয়েছে, আমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছি।’
হজের ভিড়ের মধ্যে যেতেও অত্যন্ত অনীহা ছিল মহিলা সাহাবীগণের। এমনকি কখনো দিনের বেলায় তাওয়াফের প্রয়োজন হলে কা’বার চত্বর থেকে পুরুষদের সরিয়ে দেওয়া হতো। সহীহ আল-বুখারীতে এসেছে, আয়েশা (রা.) একবার হজ পালনের সময় অন্য মহিলারা বললেন, উম্মুল মুমিনীন! চলুন, হাজারে আসওয়াদে চুমু দেবেন। বললেন, তোমরা যেতে পার। আমি পুরুষদের ভিড়ে মধ্যে যেতে পারি না। আসহাবে রাসূলের জীবনকথা বইয়ে এসেছেন, হযরত সাওদা (রা.) বিদায় হজের সময় মানুষের ভিড়ের আগে তিনি মুযদালাফা থেকে মীনায় চলে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুমতি লাভ করেছিলেন।
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন একজন শিক্ষিকা। প্রচুর পুরুষ তাবেঈ তার থেকে হাদীস শিক্ষালাভ করেছিলেন। ইবনে সা’দ আত-তাবাকাতে উল্লেখ করেছেন, হযরত ‘আয়েশা (রা.) শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নারী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে এবং পুরুষদের থেকে পর্দার প্রয়োজন ছিল না, তাদেরকে হুজরার ভেতরের মসজিদে বসাতেন। আর অন্যরা বসতেন হুজরার বাইরের মসজিদে নববীতে। দরজায় পর্দা টানানো থাকতো। পর্দার আড়ালে তিনি নিজে বসতেন। আসহাবে রাসূলের জীবনকথা গ্রন্থাকার লিখেছেন, যাদের ঘরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না, এমন গায়রে মুহাররম ব্যক্তিরা আফসোস করে বলতো ইলম হাসিলের ভালো সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত। কুবয়সা বলতেন, ‘উরওয়া আমার চেয়ে জ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো সে আয়েশার (রা.) গৃহাভ্যন্তরে যেতে পারতো।’
হযরত আয়েশা (রা.) ও অন্যান্য সাহাবীদের জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি ও অন্যান্য মহিলা সাহাবীগণ তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে পছন্দ করতেন। বুখারীতে উল্লেখিত হযরত আয়েশা (রা.) ইফকের ঘটনা বর্ণনায় এক দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন, ‘আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পেছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌঁছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে ফেলি’। অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘আমি ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।’ এছাড়া ইমাম হাকিম এর আল-মুসতাদরাকে রয়েছে, ফাতিমা বিনতে মুনযির রাহ. বলেন, ‘আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম।’ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা বইয়ে এসেছে, ‘আয়েশা (রা.) শরীয়াতে মৃতদের থেকে পর্দার হুকুম না থাকলেও এ বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা.) পাশে ওমরকে (রা.) দাফন করার পর, সেখানে পর্দা ছাড়া যেতেন না। তিনি বলতেন, এখন ওখানে যেতে গেলে হিজাবের প্রয়োজন হয়।’
স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতে যুদ্ধের ময়দানে মহিলা সাহাবীগণ পর্দা রক্ষা করে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করতেন। পানি পান করাতেন। ইমাম বায়হাকী তার দালায়িল আন-নবুওয়াহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মহিলা সাহাবীগণ উহুদের যুদ্ধে তাদের পিঠে করে পানি ও খাদ্য বহন করে নিয়ে গিয়েছেন। উম্মাহাতুল মুমিনূন হযরত আয়েশা, উম্মু সুলাইম, আসমা বিনত ইয়াযিদ, হামনা বিনত জাহশ, উম্মু হাকীম, আর রুবায়্যিউ বিনত মু’আওবিয, উম্মু আয়মান, সাফিয়্যা, উম্মু উমারা (রা.)সহ আরো বহু নারী সাহাবী সম্পর্কে জানা যায় তারা রাসূলুল্লাহর (সা.) যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণ করেছেন।’
উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত যায়নাব নিজ হাতে চামড়া দাবাগাত কর পাকা করে অর্থ উপাজন করতেন, যা অভাবী মানুষের জন্য ব্যয় করতেন। হযরত শিফাকে (রা.) হযরত ওমর (রা.) তার শাসনামলে বাজার পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের স্ত্রী যায়নাব বিনত আবী মু’আবিয়া ছিলেন একজন হস্তশিল্পী। নিজের হাতে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে বিক্রি করে সংসারের জন্য ব্যয় করতেন। হযরত আসমা বিনতে আবু বকর মদীনা থেকে দূরবর্তী এক খেজুর বাগান থেকে খেজুরের বীচি কুড়িয়ে বস্তা ভরে মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসতেন।
উপরের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে নারীকে প্রয়োজনের তাগিদে হিজাব রক্ষা করে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ইসলাম অনুমোদন করে। তবে কোন অবস্থায় হিজাববিহীন বা গায়রে মাহরামের সাথে অবাধ মেলামেশাকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম হিজাবের মাধ্যমে নারীকে আবদ্ধ করে রাখেনি, বরং নারীকে নিরাপত্তা ও সম্মান দান করেছে।
পত্রপত্রিকা খুললেই নারী নিগ্রহের যে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাই, তার পেছনে অন্য অনেক কারণের সাথে নারী ও পুরুষ উভয়ের পর্দাহীনতা, অবাধ মেলামেশা একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই সমাজের নারী-পুরুষ উভয়েরই হিজাবের বিধানের মধ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়াটা জরুরি। প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।
লেখক : শিক্ষক, সাহিত্যিক ও গবেষক।