রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাসূল সা.-এর কর্মকৌশল
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:২৪
॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার ॥
মহানবী (সা.) ছিলেন পৃথিবীতে সর্বক্ষেত্রে এক আদর্শ মহামানব। মহাবিশ্বে তিনি সর্বক্ষেত্রে যে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা সকল যুগে সব মানুষের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য অবশ্যই। আল্লাহর রাসূল (সা.) পারিবারিক জীবনে যেমন একজন আদর্শ গৃহকর্তা, যা স্ত্রীদের ক্ষেত্রে স্বামী, সন্তান-সন্ততিদের ক্ষেত্রে পিতা, তেমনি প্রতিবেশীদের নিকট পরম বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী, অতুলনীয় সমাজ সংস্কারক তথা সমাজপতি, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, সুদক্ষ সেনানায়ক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রপ্রধান। মানবজীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই তাঁর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হোক না কেন, তাঁর সাথে কোনো মানুষই তুলনীয় হতে পারে না। মহানবী (সা.) ৪০ বছর জীবনে আনুষ্ঠানিকভাবে রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পক্ষ থেকে ওহি নাজিল হবার পর থেকে ২৩ বছর পর্যন্ত আল্লাহর দীন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি যেসব পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তা ছিল বিশ্ব পরিচালনা তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার এক নির্ভুল রাজপথ। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ২৩ বছরের রিসালাতের জীবনের ১৩ বছর মক্কায় তিনি দীন প্রচার করতে গিয়ে বিরোধীদের হাতে অবর্ণনীয় লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার হয়েছিলেন। অবশেষে তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে মক্কার দাম্ভিক তথা জালেম নেতাদের পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মদীনায় উপনীত হন।
মহানবী (সা.) ২৭ সফর মোতাবেক ১২ অথবা ১৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মধ্যরাতের সামান্য কিছু পর হযরত আবু বকর (রা.)-কে সাথে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং মক্কার পাঁচ মাইল দক্ষিণে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন অতঃপর ১ম হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসের চাঁদনী রাত মোতাবেক ১৬ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ বিন উরাহাক্বত্ব লাইসী নামক ভ্রমণ অভিজ্ঞ পথ নির্দেশকের সহায়তায় মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) ১ম হিজরীর ৮ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদীনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে পৌঁছেন। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা মসজিদে কুবা নামে এখনো পরিচিত। এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) জুমাবার কুবা থেকে রওনা হয়ে মদীনা শহরে প্রবেশ করেন এবং বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী দণ্ডায়মান, সেখানেই স্বীয় কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) মদীনায় পৌঁছে মসজিদ নির্মাণসহ আনসার মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক তৈরি করে দেন এবং ইহুদি ও অমুসলিমদের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। (সূত্র: আর রাহীকুল মাখতুম)। এ চুক্তিটিই ঐতিহাসিক মদীনা সনদ নামে খ্যাত।
মহানবী (সা.) মদীনায় পৌঁছেই একটি আদর্শ ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। এই মদীনা রাষ্ট্রটিকে কেন্দ্র করেই তদানিন্তন অর্ধ পৃথিবীব্যাপী ইসলামের বিজয় পতাকা স্বগৌরবে উড্ডীন হয়েছিল। মহানবী (সা.) মদীনায় ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার নিরাপত্তা ও সুশাসনের যেমন ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনি প্রতিপক্ষ মক্কার চিরদুশমন মুশরিক কুরাইশদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নিস্তেজ করারও সুদৃঢ় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এ কারণে যে, শত্রুরা যেন ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ না নিতে পারে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) মদীনায় পৌঁছার পর সিরিয়ায় কুরাইশদের বাণিজ্যিক বহরকে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যার ফল ২য় হিজরীর রমজান মাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের বিশাল বাণিজ্য বহরকে বিশ্বনবী (সা.) কর্তৃক বাধাদানের প্রচেষ্টা। ঐ বাণিজ্য বহরকে উদ্ধারের জন্যই আবু জেহলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত কুরাইশ বাহিনী মক্কা থেকে বের হয়। এছাড়া ১ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস থেকে ২য় হিজরীর রমজান মাস পর্যন্ত বদর যুদ্ধ ছাড়াও আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন বিশিষ্ট সাহাবীদের নেতৃত্বে প্রায় ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করে বহির্বিশ্বের সাথে তাদের অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
মহানবী (সা.) মদীনায় পৌঁছেই দাম্ভিক কুরাইশদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযান পরিচালনা করেছিলেন- ১ ম হিজরী রমযান মাস মোতাবেক ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে কুরাইশ সর্দার আবু জাহেলের সিরিয়া অভিমুখী বাণিজ্য কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট কমান্ডো বাহিনী প্রেরণ, ১ম হিজরীর জিলকদ মাস মোতাবেক ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে খারার অভিমুখে সাদ বিন আবি আক্কাসের নেতৃত্বে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার উদ্দেশে একটি বাহিনী প্রেরণ, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে এবং ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রমে আবওয়া তথা আদ্দান এবং বুওয়াত্বের অভিযানে মহানবী (সা.) স্বয়ং নিজে নেতৃত্ব দেন। এভাবে কুরয ইবনে জারির ফিহরীর নেতৃত্বে লুটেরা বাহিনী মদীনার চারণভূমিতে বিচরণকৃত পশুপালের ওপর চড়াও হলে মহানবী (সা.) তাদের পিছু ধাওয়া করেন এবং দ্বিতীয় হিজরীর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে একটি শক্তিশালী কুরাইশ কাফিলা সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলে বিশ্বনবী (সা.) দু’শত মুহাজির সাহাবী নিয়ে তাদের সন্ধানে মদীনা থেকে বের হন। এভাবে দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাস মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে ১২ সদস্যবিশিষ্ট ক্ষুদ্র বাহিনী কুরাইশদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য মক্কার উপকণ্ঠে নাখলাহ অভিমুখে প্রেরণ করেন। (সূত্র: আল মাত্তাহিবর লাদুন্নিয়্যাহ ১ম খণ্ড এবং আর রাহীকুল মাখতুম)। এরপর দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমযানে কুরাইশদের সাথে ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
দ্বিতীয় হিজরীর বদর যুদ্ধের পর মক্কার মুশরিকগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে উহুদ প্রান্তরে প্রতিশোধমূলক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ বদর ও উহুদ যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে আরও ৮টি অভিযান শত্রুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ অভিযানগুলো ছিলো গাযওয়ায়ে বনী সুলাইমের যুদ্ধ, গাযওয়ায়ে বনি কাইনুকা অভিযান, গাযওয়ায়ে সাভীক বা ছাতুর যুদ্ধ, গাযওয়ায়ে যু-আমর, কাব ইবনে আশরাফের হত্যা, গাযওয়ায়ে বুহরান এবং সারিয়্যাতু যায়েদ ইবনে হারিসাহ ইত্যাদি। এসব অভিযানগুলোর মধ্যে তৃতীয় হিজরীর জুমাদিউস সানী মাসের হযরত যায়েদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বাধীনে কারদাহ অভিযান ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। যে অভিযানটা বদর এবং উহুদ যুদ্ধের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কুরাইশদের শাম অর্থাৎ সিরিয়ায় বাণিজ্য ছিল জীবন জীবিকা তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের প্রধানতম উপায়। মহানবী (সা.) মুশরিকদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভঙ্গুর করার লক্ষ্যে তাদের এ বানিজ্য পথ বন্ধ করতে তৎপর ছিলেন। ঘটনার বিবরণ এভাবে এসেছে- সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া যাকে ঐ বছর সিরিয়ায় গমনকারী বাণিজ্য বহরের আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল, সে কুরাইশদের বলল মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা আমাদের বাণিজ্য পথ কঠিন করে ফেলেছে, তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করবো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। যদি আমরা বাড়িতেই বসে থাকি তবে মূল ধনও খেয়ে ফেলবো কিছুই বাকি থাকবে না। কেননা গ্রীষ্মকালে সিরিয়ার সঙ্গে এবং শীতকালে আবিসিনিয়ায় ব্যবসা করার ওপরে আমাদের জীবিকা নির্ভর করছে। এ বিষয় চিন্তাভাবনার পর আসওয়াদ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব সাফওয়ানকে পরামর্শ দিলো, তুমি উপকূলের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ইরাকের রাস্তায় গমন করো। (আর রাহীকুল মাখতুম)। প্রকাশ থাকে যে, এটা খুবই দীর্ঘ রাস্তা যা নজদ হয়ে সিরিয়ায় চলে গেছে এবং মদীনার পূর্ব দিক হয়ে চলে গেছে যে, রাস্তা সম্পর্কে কুরাইশদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। সাফওয়ান বাকর ইবনে ওয়াইলের সাথে সম্পর্কযুক্ত ফুরাত ইবনে হাইয়ানকে পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নেয়।
সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার নেতৃত্বে কুরাইশদের বাণিজ্য বহর সিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলো। সালীত ইবনে নুমান যিনি মুসলমান হয়েছিলেন নাঈম ইবনে মাসউদ যিনি তখনো মুশরিক ছিলেন এক আড্ডায় উপস্থিত থেকে এসব খবর জানতে পেরে সালীত বিষয়টি দ্রুতবেগে মদীনায় উপস্থিত হয়ে মহানবী (সা.) কে অবহিত করেন। বিশ্বনবী (সা.) তৎক্ষণাৎ কুরাইশদের এ বাণিজ্যবহরকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং যায়েদ ইবনে হারিসার নেতৃত্ব একশজন অশ্বরোহীর বাহিনীকে প্রেরণ করেন।
হযরত যায়েদ (রা.) অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পথ অতিক্রম করলেন। কুরাইশ বাণিজ্যবহর সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায় কারদাহ নামক ঝর্ণার পাশে শিবির স্থাপনে ব্যস্ত ছিল, ইত্যবসরে মুসলিম বাহিনী ঝটিকাবেগে আক্রমণ চালিয়ে কুরাইশ বাণিজ্যবহরকে তছনছ করে দেয় এবং যায়েদ ইবনে হারিসাহ (রা.) পুরো কাফেলার ওপর অধিকার লাভ করেন। মুসলমানগণ কুরাইশ বাণিজ্যবহরের পথ প্রদর্শক ফুরাত ইবনে হাইয়ান ও আরো দুই ব্যক্তিকে বন্দী করে মহানবী (সা.) এর নিকট নিয়ে আসলে ফুরাত ইবনে হাইয়ান আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র হাতে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)। এ অভিযানে মুসলিমগণ প্রায় এক লাখ দিরহাম রৌপ্য লাভ করেন। মহানবী (সা.) শরিয়তের বিধান অনুযায়ী এর এক-পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকিগুলো মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) শত্রু শিবিরকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সিরিয়ায় বাণিজ্যবহরের নেতৃত্ব ব্যর্থতার পর কুরাইশগণ গর্বে ও অহংকারে ফেটে পড়লো। তাদের সামনে এখন দুটি পথই খোলা ছিল হয় তারা গর্ব ও অহংকার ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করবে না হয় ভীষণ যুদ্ধ করে তাদের মর্যাদা রক্ষা করবে। মক্কার দাম্ভিক কুরাইশরা দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলো এবং মুসলমানদর মোকাবিলা করার জন্য তাদের ঘরে ঢুকে আক্রমণ চালানোর পূর্ণমাত্রায় প্রস্তুতি শুরু করে দিল যার ফলেই উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।