সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রাসূল (সা.)-এর অবদান
১৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫০
॥ মনসুর আহমদ ॥
“পাখীরে দিয়েছ সুর পাখী গান গায়
তার বেশি করে না সে দান
আমারে দিয়েছ সুর আমি তারো বেশি করি দান
আমি গাই গান।” (বলাকা)
যিনি পাখিকে সুর দিয়েছেন, তিনি আমাকে স্বর ও সুর দিয়েছেন। তিনি ঝর্ণায় দিয়েছেন নৃত্যের ছন্দ, বিহগকুলকে দিয়েছেন মুক্তির আনন্দ। সমুদ্র পেল অতল গভীরতা, পর্বত পেল অসীম দৃঢ়তা। সূর্যের আছে তীব্র প্রখরতা, চন্দ্রের রয়েছে মাদকীয় স্নিগ্ধতা। পাওয়ার এ আনন্দেই সবাই গেয়ে চলছে যুগ যুগ ধরে তাদের রবের প্রশংসাগীতি মধুর সুরে ও স্বরে। সুর ও স্বর আল্লাহর সৃষ্টি, “ওয়া আল্লামাহুল বয়ান- তিনি মানুষকে কথা বলা শিখিয়েছেন।”
মানুষ তার হৃদয়ে যে ব্যথা অনুভব করছে, তার চিত্তে যে আনন্দের ঢেউ জেগেছে, ভাবের যে ঝড় উঠেছে তার কারণেই তার কণ্ঠে সুর জেগেছে, স্বরের নানা খেলা খেলছে জিহ্বা, তালু ও কণ্ঠে। রচনা করেছে নানা গান ও কবিতা। মেহেদির সবুজ পাতায় কেন লাল রং লুকিয়ে আছে- এ প্রশ্ন কেউ করেনি কোন দিন। কোকিল কেন গান গায়- এ প্রশ্নও সুধাল না কেউ কোনো জনমে। কিন্তু সুর ও কথা তথা সুর ও সাহিত্য সৃষ্টিতে ইসলামের অনুমতি কতটুকু- এ প্রশ্ন জেগেছে হালে সুরের জলসায় ও সাহিত্যাঙ্গনে।
ইসলাম সৃষ্টির ধর্ম, ধ্বংসের নয়। ইসলাম কল্যাণ ও মঙ্গলের ধর্ম। যে কথা ও কাজ মানুষের হৃদয়ের ভাবকে সৃষ্টি কর্মে সহায়তা করে, মানুষের কণ্যাণ ও মঙ্গল নিয়ে আসে, পৃথিবীতে শান্তির হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে, তাই ইসলামের সমর্থনপুষ্ট। যে কথা ও সুর মানবের পবিত্র হৃদয় অঙ্গনে অশ্লীলতার বীজ বপন করে, চরিত্রের দৃঢ়তায় ভাঙন ধরায়, মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট করে, তা যতই মিষ্টি মধুর হোক না কেন, ইসলাম তাকে সমর্থন জানায় না। সুর যদি মর্মস্পর্শী নাও হয়, কিন্তু যদি হয় সত্যস্পর্শী ও জীবন রসের উৎস, তবে তা প্রকৃতির বহুত বে-রসালো সুরের মতো ইসলাম আপন করে নেয়। ঝিঝির রব, দাদুরীর কোলাহল ও কেকা ধ্বনিতে আমরা পাই না কুহু ধ্বনির মধুরতা, কিন্তু প্রতিটিতে প্রতিবেশের ভাব সঙ্গতিপূর্ণ থাকায় ও সুরগুলো আমাদের কাছে অপ্রিয় মনে হয় না। ঠিক একইভাবে যদি সুরে থাকে সত্যের প্রতি, সুন্দরের প্রতি আহ্বান, তা মধুর হলে তো কথাই নেই, অমধুর হলেও উদ্দেশ্যে ও মহানত্ত্বের কারণে তা আমাদের কাছে প্রিয় মনে হয়।
রাসূল (সা.)-এর সুরের প্রতি আকর্ষণ ছিল। সহীহ বুখারীর রেওয়াতে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, আমরা মিনার এক গুহায় রাসূল (সা.)-এর সাথে উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে সূরা মুরসালাত অবতীর্ণ হলো। রাসূল (সা.) সূরাটি আবৃত্তি করতেন আর আমি তা শুনে মুখস্থ করতাম। সুরের মিষ্টতায় তাঁর মুখমণ্ডল সতেজ দেখাচ্ছিল।
এছাড়া সুরের মিষ্টতার প্রতি রাসূলের আকর্ষণের প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে অত্যন্ত সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন হজরত আবু মুসা আশয়ারী। এক দিন তিনি যখন কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন, তখন রাসূল (সা.) সেখান দিয়ে গমন করছিলেন, তিনি তাঁর তেলাওয়াত শোনার জন্য থেমে পড়েন এবং নিবিষ্ট মনে শুনতে থাকেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দাউদ (আ.)-এর সুমধুর কণ্ঠস্বর দিয়েছেন।’ আবু মুসা যখন জানতে পারলেন যে, রাসূল (সা.) তাঁর তেলাওয়াত শুনছেন, তখন আরজ করলেন, আপনি শুনেছেন এ কথা জানা থাকলে আমি আরও সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতাম। (ইবনে কাসীর)।
হজরত রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্যে কাব ইবনে যুহায়র (রা.) রচনা করলেন, ‘বানাত সুয়াদ’ নামের বিখ্যাত কবিতা। এ কবিতা রাসূল (সা.)-এর সামনে পাঠ করা হলে তিনি শুনে খুব খুশি হন এবং তাঁকে নিজের চাদর উপহার দেন।
রাসূলের বিরুদ্ধে কুৎসাপূর্ণ কবিতা রচনা করে কিছু কুরাইশ কবি। তার জওয়াব দিতে এগিয়ে এলেন হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.)। তাঁর জন্য মসজিদে মিম্বার স্থাপন করা হয়েছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়তেন। রাসূল (সা.) তাঁর কবিতা শুনে বলতেন, ‘আমার পক্ষ থেকে জবাব দাও। হে আল্লাহ! রুহুল কুদুসকে দিয়ে তাঁর সাহায্য কর।’ তিনি ‘শায়রুর রাসূল’ নামেই পরিচিত হয়েছিলেন রাসূলের জীবদ্দশাতেই।
কবি হ্সাসান তাঁর কাব্য শক্তিকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। ইসলামী পরিভাষার প্রাচুর্য রয়েছে তাঁর কবিতায়।
যেমন-
‘লাকাল হামদু আন্নায়্মাউ ওয়াল আমরু কুল্লুহু,
ইয়্যাকা নাসতাহ্দী ওয়া ইয়্যাকা নায়বুদু।’
রাসূল (সা.) সাহিত্য সাধনায় প্রচুর উৎসাহ জুগিয়েছেন সাহাবাদের। তিনি কবিতা প্রসঙ্গে বলেছেন- “আশ্ শায়েরু বি মানঝিলাতিল কালাম হুসনুহু কা হুসনিল কালাম ওয়া কাব্বিহু কা কাব্বিহিল কালাম” – কবিতা কথার মতোই, ভাল কথা যেমন সুন্দর ভালো কবিতাও তেমনি সুন্দর এবং মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতোই মন্দ। রাসূলের এ কাব্য প্রেরণা সাহাবাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। সে বিষয়ে বহুত কথা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসে ও হাদিসে।
একদিন শরীদ সকফী (রা.) নবী করীম (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। নবী (সা.) তার নিকট উমাইয়্যার কবিতা শুনতে চাইলেন। হজরত শরীদ রাসূল (সা.)কে একশতটি বচন শুনালেন।
সাহাবাদের মধ্যে হজরত আবু বকর (রা.) কবি ছিলেন না বটে তবে দুই একািট কবিতা তিনি রচনা করেছেন বলে জানা যায়। হজরত ওমর (রা.) কবিতা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতেন এবং নিজেও কিছু কবিতা রচনা করেছেন। হজরত ওসমান (রা.) কবিতা পছন্দ করতেন এবং কিছু কবিতা রচনা করেন। হজরত আলী (রা.) ছিলেন পণ্ডিত ও সাহিত্যক। তাঁর কবিতা সংকলন ‘দেওয়ানে আলী’ নামে খ্যাত হয়ে সাহিত্য জগতে আজও বেঁচে আছে। এ ভাবে আমরা দেখতে পাই হজরত হাসান (রা.), হজরত হামযা (রা.). হজরত আব্বাস(রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), জাফর ইবনে আবু তালিব(রা.) সকলেই কাব্যানুরাগী ছিলেন এবং কবিতা রচনা করেছেন। এছাড়া আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস, ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.)ছিলেন মক্কার বিশিষ্ট কবি। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) কবিতা চর্চায় প্রচুর উৎসাহ প্রদান করেছেন।
রাসূল (সা.)-এর শিল্প সাধনার উৎসাহ উদ্দেশ্যবিহীন শিল্প সাধনাই মাত্র ছিল না। সাহিত্য সাধনা মানুষের অশান্তি দূর করতে ব্যাবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কবি ইবনে মালিক (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কবিতা সম্পর্কে আপনার মত কি? জওয়াবে হুজুর (সা.) বললেন, ‘ইন্নাল মুমিনু ইউ জাহেদু বি সাইফিহি ওয়া লিসানিহী- আল্লাহকে বিশ্বাসী বান্দা তরবারি দ্বারাও যুদ্ধ করে, জিহ্বার কথা দ্বারাও যুদ্ধ করে।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখেছি কবিতার চর্চা। সাহাবীগণ ক্লান্তি দূর করার জন্য খন্দক যুদ্ধের সময় খন্দক খুঁড়ছিলেন আর গাইছিলেনÑ মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট আমরা বয়াত অর্থাৎ নিজেদের বিক্রি করেছি। সুতরাং জিহাদ আমাদের গোটা জীবনের সঙ্গী। তাদের উৎসাহ জোগাতে স্বয়ং রাসূল (সা.) গাইলেন- “হে অল্লাহ! পরলোকের জীবন ছাড়া পার্থিব জীবনের কামনা আমাদের নেই। সুতরাং আনসার ও মুহাজিরদের সকলের ত্রুটি ক্ষমা করে দিও।”
রাসূলের জীবনের কাব্যানুরাগ মুসলমানদের যুগ যুগ রুচিশীল ও মানবতার কল্যাণময় কাব্য সৃষ্টির প্রেরণা জোগাচ্ছে। কাব্য মাত্রই পরিত্যাজ্য এ ভাব ইসলাম স্বীকার করে না। কাব্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘এবং কবিদের সম্বন্ধে বলা যায়, বিভ্রান্ত লোকেরাই তাদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখতে পাও না তারা উপত্যকায় উপকত্যকায় উ™£ান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়ায়, তদুপরি তারা যা মুখে বলে, কাজে তা করে না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে অতিমাত্রায় তৎপর রয়েছে এবং অত্যাচারিত হলে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়েছে তাদের সম্বন্ধে এ কথা প্রযোজ্য নয়। জুলুমবাজরা শিগগিরই জানতে পাবে তাদের কি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।’
যে কবিতার মধ্যে থাকে ঈমানের সৌরভ, যার মধ্যে পাওয়া যায় উন্নত জীবনের ইঙ্গিত সে সব কবিতা পরিত্যাজ্য নয়, বরং এ ধরনের কবিতাই প্রশংসার যোগ্য। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কবিতা সুসামঞ্জস্য কথামালা, যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতাই সুন্দর। আর যে কবিতায় সত্যের অপ্রলাপ রয়েছে, সে কবিতায় মঙ্গল নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো কোনো কবিতায় রয়েছে প্রকৃত জ্ঞানের কথা। রাসূল (সা.)-এর এসব বাণী সাহাবাদের উৎসাহ জুগিয়েছে উন্নত মানের কাব্য সৃষ্টিতে।’
তাবারী প্রধান প্রধান সাহাবী ও তাবেয়ী সম্পর্কে বলেন যে, ধর্মীয় ব্যাপারে অনুসৃত প্রধান সাহাবীগণের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি কবিতা রচনা করেনি কিংবা শোনেননি ও পছন্দ করেননি। এ উৎসাহের ধারা বয়ে যুগে যুগে উন্নত মানের কাব্য সৃষ্টি হয়েছে সমাজ জীবনের কল্যাণময় দিকগুলো নিয়ে। সবসময় উন্নত চরিত্রের কবিদের লেখাকে যুগের শীর্ষে তুলে ধরেছে।
কবিতা কাব্যে যেভাবে রাসূল (সা.) উৎসাহ জুগিয়েছেন, তেমনি জুগিয়েছেন উন্নত সংস্কৃতির বাহন ছন্দ ও সুরের ব্যাপারে। নবী না ছিলেন কবি না ছিলেন সুরকার। এসব বৈশিষ্ট্যও নবীর জন্য বেমানান। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তাঁকে কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং এ কাজ তার জন্য শোভনীয় নয়।’ কিন্তু তাই বলে নবী এ দিকটিকে উপেক্ষা করেননি। নবী শুনতে পেয়েছিলেন বিশ্বচরাচরে সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সদা এক সঙ্গীত ও সুর, যা মানবমনে যুগ যুগ ধরে ভাবের দোলা জাগিয়ে চলছে। একজন কবি গেয়েছেন সে সঙ্গীতের সুরকে কথামালায়-
‘অরণ্যের পর্বতের; সমুদ্রের গান
ঝটিকার বজ্রগীত স্বর
দিবসের, প্রদোষের, রজনীর গীত,
চেতনার, নিদ্রার মর্মর,
বসন্তের বরষার শরতের গান
জীবনের মরণের সুর
আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে
ব্যাপ্ত করি বিশ্ব চরাচর,
পৃথিবীর, চন্দ্রিমার গ্রহ তপনের
কোটি কোটি তারার সংগীত
তোর কাছে জগতের কোন মাঝ খানে
না জানিয়ে হতেছে মিলিত।’
পৃথিবীর এ সংগীত সুরের সাথে সংগতি রেখে যে সুর অন্তর থেকে উৎসারিত হয়, যে সুর পরম প্রিয়তমকে নিয়ে বেজে ওঠে, তা তার কাছে অতি প্রিয়, জগতের কাছেও প্রিয়। ব্রাউনিং-এর ঞযব নড়ু ধহফ ঃযব অহমবষ কবিতায় দেখেছি কাঠুরে ছেলে বনে কাঠ কাটতে কাটতে আল্লাহর নামে গান করছে। সে গীত তাঁর আরশ তলে গিয়ে বেজে উঠত, তাকে পুলকিত করত। তিনি ফেরেশতাদের বলতেন, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-তারা যা দিবানিশি আমার বন্দনা গান করছে সে গানের সুর বহু পুরাতন, তা অনাদিকাল থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু ঐ যে ছেলে আমাকে ডাকছে ও ডাক আমার বুকে লেগেছে- ও ডাকের মতো মিষ্টি ডাক আর শুনিনি।
ও সুরে খোদার নাম বড় কথা নয় বরং আন্তরের দরদ বড় ছিল। বড় ছিল ঐঁসধহ ঠড়রপব, যা অন্তর থেকে উৎসারিত হচ্ছিল ভালোবাসার টানে। ভক্তি ও ভালোবাসার টানে যের সুর অন্তরে বেজে ওঠে, তা দূষণীয় হতে পারে না, নিষিদ্ধ হতে পারে না। যখন কানে ভেসে আসে ‘তোরা দেখে যা অমেনা মায়ের কোলে’, ‘ইয়া রব! দিলে মুসলিমকো জিন্দা তামান্না দে’. ‘উঠো মেরী দুনিয়া কি গরিবোকো জাগা দে’, ‘আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্ নাউম’ এ সবের মধু মাখা সুর, তখন আমরা তা তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি। ও সুর শুনে মনে আসে প্রফুল্লতা, মস্তিষ্কে জাগে পবিত্রতা। আমরা প্রত্যহ গেয়ে চলি মুসলেহ উদ্দীন সাদীর সুপরিচিত কবিতা-
‘বালাগাল উলা বিকামালিহী
কাশাফাদ্ দুজা বিজামালিহী’।
বাংলার ঘরে ঘরে মিলাদের অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়ে থাকে। ‘তালায়াল বাদরু আলাই না,
মিন সানী ইয়াতিল বিদায়ী’।
এ সংগীত সুর করে গেয়েছিল মদীনার শিশু মহিলারা প্রিয়নবীকে অভ্যর্থনা জানাতে। তাই বলা চলে সুর মাত্রই নিষিদ্ধ নয় ইসলামে। বরং যাকে আশ্রয় করে সুর বেজে ওঠে, তার পবিত্রতা ও অপবত্রিতা ও পরিবেশনার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে সুর সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ হওয়ার নীতি।
সুরের কথা আলোচনা করতেই মনে ভেসে ওঠে ওস্তাদ আলাউদ্দীন, বিটোফেন ও মোজার্টের কথা। তারা ছিলেন সুরশিল্পী ও সংগীতশিল্পী। তাদের সুরে আছে আত্মার ও অন্তরের আকাক্সক্ষা বাত্যার রোমান্টিক ঐশ্বর্য। এদের আগে বহু আগে এসেছিলেন আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)। তাঁর কণ্ঠে ছিল মর্তমানবতার হৃদয়জুড়ানো স্বর্গীয় সুর। তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সুর মিলিয়ে তসবিহ করছে আকাশের উড়ন্ত পাখি, জমিনের স্থির পর্বত মালা, ও বৃক্ষরাজি। এরশাদ হচ্ছে- ‘ওয়া সাখ্খারনা মায়া দাউদাল জিবালা ইউ সাব্বেলী ওয়াত্তাইরা ওয়া কুন্না ফায়েলীন- আমি পর্বত ও পাখিসমূহকে দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম। তারা আমার মহিমা ঘোষণা করতো। এ তসবিহ পাঠ বিশ্ব চরাচরের সাধারণ তসবিহ পাঠের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তা ছিল দাউদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সুউচ্চ স্বরের সংগীত।’
সুর সম্পর্কে কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সুরের আঘাতেও মনের পানি উথলায়। খারাপ মনের পাত্রে পানি রাখলে সে পানি দূষিত হয়, কিন্তু পানিকে দোষ দেয়া যায় না। পানি মানুষের তৃষ্ণা মেটায়, জীবন বাচায়, আবার বন্যা হয়ে মানুষের জন্য ধ্বংসও আনয়ন করে। তাই বলে পানিকে আমরা খারাপ বলতে পারি না। সুরের সঙ্গে ফুলের তুলনা করা যেতে পারে। ফুল দিয়ে কোথাও পূজা হয়, সেই ফুল নব বিলাসিনীদের কণ্ঠেও শোভা পায়। তাই বলে ফুল খারাপ ও পরিত্যাজ্য এ কথা বলা যায় কি? শরিয়তে হয়তো গানের খারাপ ভাবে পরিবেশনা ও দিকটাকেই খারাপ বলতে পারে। কিন্তু সুর কখনো খারাপ নয়।’
সুরের সাধনা মানুষের চিত্তে তোলে স্বর্গীয় ভাবের দ্যোতনা। বেহেশতি আবেশ বয়ে নিয়ে আসে যে সুর তার সাধনা করার উৎসাহ দেয় ইসলাম। কুরআন পাঠের জন্য বলা হয়েছে, ‘ওয়ারাত্তিলিল কুরআনা তারতিলা’। কুরআন আবৃত্তি করুন সুস্পষ্ট ও সুন্দররূপে। ‘তারতিল’ বলতে যথাযথ সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াতকে বোঝায়। হজরত আলকামা (রা.) এক ব্যক্তিকে সুমধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত করতে দেখে বলেন যে, সে কুরআন তারতিল করছে। আমার পিতা-মাতা তার জন্য কুরবান হোন।
স্বয়ং রাসূল (সা.) সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, নবী সশব্দে সুললিত স্বরে তেলাওয়াত করেন, তাঁর কেরাতের মতো অন্য কারও তেলাওয়াত আল্লাহ তায়ালা শুনেন না।
রাসূলের কথার গভীরতা ও সুরের মধুরতায় জি¦ন জাতি অভিভূত হয়েছে। রাসূল (সা.) নাখলায় রাতের শেষে ফজরের নামাযে পড়ে যাচ্ছিলেন পবিত্র কুরআন থেকে। উড়ন্ত একটি জিনের দল শুনছিল সে মধুর বাণী। থেমে গিয়েছিল তাদের যাত্রা। রাসূলের কণ্ঠে উচ্চারিত সুর ও স্বরের অভিভূত হয়ে তারা বলেছিল, ‘ইন্না সামেয়্না কুরআনান্ আজাবা- আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনছি।’ শুধু তাই নয়, রাসূলের চরম শত্রু আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস কে দেখা যায় রাতের আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে রাসূল (সা.) মুখনিসৃত কুরআন তেলাওয়াত শুনতে। তারা এ স্বর্গীয় সুমহান বাণীর অপূর্ব মাধুর্য ও সুর লহরিতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে তেলাওয়াত শুনে চলতো চুপি চুপি। পবিত্র বাণীর কথা ও সুর ওদেরকে করে তুলতো অচেতন, উদাসীন ও সম্বিত হারা।
নবীর কণ্ঠের এ সুমধুর সুরে ধরণীর পরতে পরতে যে স্বর বেজে চলছে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাই আমরা সুরের চর্চা করব বিশ্বসংগীতের সুরকে মানুষের অন্তরে নতুনভাবে বাজিয়ে তোলার জন্য। এই পবিত্র সুরে সুরে আমাদের আত্মা ধূলির ধরণী ছেড়ে ধাপে ধাপে ছুটে চলবে ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে জান্নাতের সিঁড়ি বেয়ে।
সুর নিষিদ্ধ নয়, পরিত্যাজ্য নয়। কিন্তু মুমিনের জন্য বাদ্য যন্ত্রে সুরের লহরি তোলা বর্জনীয়। রাসূল (সা.) বাদ্যযন্ত্রের সুরকে নিষিদ্ধ করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতে রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহ মদ, জুয়া, তবলা ও সারেঙ্গী হারাম করেছেন।” আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করার পক্ষে কোনো যুক্তি উত্থাপন ঈমানের পরিপন্থী কাজ। সুর-সংগীত পবিত্র কণ্ঠে পবিত্র বিষয় ঘিরে উচ্চারিত হলে মানুষের হৃদয়ে তা অপূর্ব ভাবের সৃষ্টি করে। আর সে ভাবের দোলায় মানুষ পৌঁছে যায় স্রষ্টার কাছা কাছি। কিন্তু সুরের সাথে বাদ্য যন্ত্রের সংযোগ যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে, তা ইসলাম পছন্দ করে না। যে কণ্ঠের সুর অশ্লীলতার উন্মেষ ঘটায় সে কণ্ঠে সুরের সাধনা ইসলাম সমর্থন করে না। সুরের উৎস যদি থাকে হৃদয়তলে তা ধ্বনিত হয় যদি শ্লীল কণ্ঠে, চালিত করে যদি মানুষকে কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে তাহলে এ সুর নিন্দনীয় নয়।
সুর ও ছন্দ ব্যবহৃত হতে হবে নির্যাতিতের মর্মবেদনা দূরীভূত করতে আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের অন্তরে প্রচণ্ড আবেগ সৃষ্টির নিমিত্তে, স্রষ্টার প্রশংসা গীতি উচ্চারণের জন্য। যে সুর ও স্বর এ সব কাজে উৎসারিত হয়, তা রাসূলের দৃষ্টিতে মানুষের শ্রেষ্ঠ দান। রাসূল (সা.) বলেন, ‘নির্যাতিতের মর্মাঘাত লাঘব করার জন্য যে সান্ত্বনার বাণী হৃদয় থেকে নির্গত হয়ে উচ্চারিত হয়, তা শ্রেষ্ঠ দান।’ রাসূলের এ ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক কথার ফলে পরবর্তী যুগে উৎসাহ পেয়েছে নির্দোষ সুর সাধনা ও ইসলামী সংগীত সৃষ্টির ধারা।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবন শুধুমাত্র বিশ্বাস ও আমলের পরিশুদ্ধির শিক্ষা প্রদান করে না। রাসূলের জীবনের কাব্য ও সংগীতচর্চার ইতিহাস আমাদের পৃথিবীর কল্যাণের জন্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ প্রদান করে। আমাদের কণ্ঠ তালুতে যেমন খেলবে কুরআনের সুরলহরি, তেমনি হৃদয়ে বাজবে শ্লীল কল্যাণকর ও পবিত্র সুরের মূর্ছনা। যার তরঙ্গাঘাতে শত শতাব্দীর পুঞ্জীভূত জড়তা নিশ্চিহ্ন হয়ে জাতির চিত্তের গভীরে জাগ্রত হবে তাওহিদী শতদল। আজ মুসলিম সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে ইসলামী চেতনা ও নীতিবিরোধী সাহিত্য-সংস্কৃতি জুড়ে বসেছে। অধুনা মুসলিম সাহিত্যসেবীগণ ইসলামী জীবনবোধ ও সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায় এ কথা যেন ভুলতে বসেছেন। মুসলিম যুবসমাজ অপসংস্কৃতি হলাহল গিলে চলছে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কিন্তু যদি আজ মুসলমান সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীগণ রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের জীবনচরিতের দিকে লক্ষ রেখে এ জগতে নেমে পড়েন, তবে তাঁদের পক্ষে সম্ভব বিশ্বকে জীবন প্রদায়ক সাহিত-সংস্কৃতি সুধা বিলানো।