নতুন করে মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যাহত হবে শিল্পোৎপাদন

হাসিনার লুটপাটে লণ্ডভণ্ড জ্বালানি খাত


১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৪২

॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ক্রমাগত ১৬ বছরের লুটপাট আর অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের চরম খেসারত দিতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার আর সাধারণ মানুষকে। তৈরি হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা। শিল্প-কারখানা ও ক্যাপটিভে গ্যাসের নতুন সংযোগের দাম দ্বিগুণ করার উদ্যোগের পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। ফলে সব মিলিয়ে জ্বালানি খাতে এক ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যাপটিভ চার্জ আর নানাবিধ নামে জ্বালানি খাতে লুটপাটে জড়িত প্রতিষ্ঠান, আমলা আর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট নেতাকর্মীদের বিচারের আওতায় না এনে হুট করে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি দেশে অপরিণামদর্শী অস্থিরতা আর নতুন বৈষম্য তৈরি করবে।
১৬ বছরে জ্বালানি খাতে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট : আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই বিদ্যুৎ খাত থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। যার সিংহভাগই গেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন কোম্পানির ভাণ্ডারে। প্রতিযোগিতা এড়িয়ে যেমন খুশি তেমন দামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিক্রির মাধ্যমে লুটপাটে হাজার হাজার কোটি টাকা। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি অনুযায়ী, শুধু ২০২২ সালেই বিদ্যুৎ খাতে লোটপাট হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে জ্বালানি খাতে লুটপাটের প্রকৃত চিত্র শ্বেতপত্রের হিসাবের চেয়ে আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শিল্প-কারখানা ও ক্যাপটিভে গ্যাসের নতুন সংযোগের দাম দ্বিগুণ করার প্রস্তাব : নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে, সেই দর অনুযায়ী নতুন শিল্প-কারখানার মালিকদের কাছ থেকে গ্যাসের দাম আদায় করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে দ্বিগুণের বেশি। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৩০ টাকার গ্যাস ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব পেট্রোবাংলার। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। ক্যাপটিভে ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর গত বছর ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে আরও ৭৫ পয়সা দাম বাড়ানো হয়। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেয়ার কথা বলেও দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। এ অবস্থায় সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে সরকারকে আবারও গ্যাসের দাম আড়াইগুণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আমলারা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবনায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত নতুন শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
আবাসিকেও গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় তিতাস
শিল্প-কারখানার পাশাপাশি আবাসিকেও ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে বিষয়টি থাকছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ। তিনি বলেন, মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস ব্যবহার করছে। এক চুলা ৫৫ ঘনমিটারের বিল ও দুই চুলা ৬০ ঘনমিটারের বিল আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ১০০ ঘনমিটার পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহারের রেকর্ড রয়েছে। যদিও চুলায় রাত-দিনের বেশিরভাগ সময়ই গ্যাস না থাকার কথার অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী ও নন-মিটার গ্রাহকের ব্যবহারের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহক অনেকটা মিতব্যয়ী হন। তাই তাদের ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে। প্রিপেইড মিটার রয়েছে অভিজাত এলাকায়। তারা অনেক সময় হোটেল-রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে চলে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলই তাকে দিতে হয়। বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। ওই আদেশের আগে গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়। বিইআরসির আদেশের ১০ মাস পর তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার, দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন দিয়েছে। আর পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দামও বেড়ে যাবে।
এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪ টাকা
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপন ও আদেশ অনুযায়ী, এলপিজির ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন করের (মুসক) হার পরিবর্তনের ফলে জানুয়ারি মাসের জন্য এলপিজির নতুন দাম ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে দাম বাড়ানোর নতুন ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা কার্যকর শুরু হয়েছে। নিদের্শনা অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৯ টাকা। তবে জানুয়ারি মাসের শুরুতে নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৪৫৫ টাকা। আর গত ডিসেম্বরেও অপরিবর্তিত ছিল এ দাম। এছাড়া বেসরকারি এলপিজির রিটেইলার পয়েন্টে ভোক্তাপর্যায়ে মূসকসহ প্রতি কেজি গ্যাসের দাম ১২১ টাকা ৫৬ পয়সা ও রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে তরল অবস্থায় সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ১১৭ টাকা ৮১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে ৪ দফা কমেছিল এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম ৭ দফা। গত বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাড়ানো হয়েছিল এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম।
শিল্প উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা
শিল্প-মালিকরা বলেছেন, গ্যাসের নতুন সংযোগে দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের চলমান শিল্পোন্নয়ন থমকে যাবে। নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এ খাতে চরম অস্থিরতা দেখা দেবে। নতুন এবং পুরনো সংযোগের পার্থক্যের কারণে এক দেশে দুই আইন কেউ মেনে নেবে না। বরং এক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগে ব্যাপক দুর্নীতির আশঙ্কা তৈরি হবে। কেউ ৩০ টাকা হারে গ্যাসের দাম দেবে আবার কেউ ৭৫ টাকা হারে গ্যাসের দাম দেবে, এটা কেউ মানবে না। এর ফলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণ সহায়তা দেবে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বাস্তবায়নকারী কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে দাম বাড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এ বাড়তি ব্যয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ হয়ে গ্রাহকের কাঁধে পড়বে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া
শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। তাই সরকারের এ সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সংগঠনটি। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিঃসন্দেহে দেশের শিল্প খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে ডিসিসিআই বলছে, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যবসার খরচ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। ডিসিসিআই মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের এমন মূল্যবৃদ্ধির প্রয়াস সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমাবে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করবে। ফলে রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলবে এবং এটি স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকে হ্রাস করবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তা দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নেয়া এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার গতিকে থমকে দেবে। ভ্যাটের বাড়তি চাপ সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। ফলে দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত। ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদে মিডিয়াকে ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। লিখিত বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক জাকির হোসেন নয়ন বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করেই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। হঠাৎ এ করারোপ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দেশের সার্বিক জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভ্যাট বাড়ার ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ স্বাভাবিকভাবে আরেক দফা বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম হায়দার বলেন, ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এখনো সচিব থেকে শুরু করে নিচের লেভেল পর্যন্ত অহরহ ঘুষের বাণিজ্য চলছে। তিনি আরও বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্প উৎপাদন কমে যাবে, দেশে বেকারত্ব বাড়বে, দুর্নীতি বাড়বে, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।