পল্টনের তিনটি জনসভা, দুই শহীদ ও আ’লীগ
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৩৯
॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন তথা একটি নিরাপদ ও স্বস্তির জনপদ গঠনের লক্ষ্যেই রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। নিরাপদ ও স্বস্তিময় দেশ গঠনের জন্য দরকার সৎ, যোগ্য, দক্ষ নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালক। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্র ও সরকারের সৎ, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব এবং দায়িত্বশীল নিয়োগের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন, নির্বাচন ও জনগণের ভোট পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য যথোপযুক্ত তথা দক্ষ, যোগ্য, প্রতিশ্রুতিশীল ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব তৈরি হয়ে থাকে। তবে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব যদি সৎ, নৈতিকতাসম্পন্ন না হয়ে অসৎ ও সন্ত্রাসী চরিত্রের হয়, তাহলে তো রাষ্ট্র ও সরকারে সৎ, দক্ষ, প্রতিশ্রুতিশীল ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্বের আশা করা যায় না। এককথায় একটি দেশের রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের নেতৃত্ব সৃষ্টি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
অপরদিকে একটি দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক কর্ম প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রকৃত চরিত্রের স্বরূপ জানা যায়। বাংলাদেশে এমন অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যাদের প্রকৃত স্বরূপ ও অবস্থা সাধারণ জনগণ তেমন একটা জানে না। আজকের নিবন্ধে ৫৪ বছর পূর্বের রাজনৈতিক কিছু কর্মকাণ্ডের ডকুমেন্টেড চিত্র তুলে ধরা হলো। এতে করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও তার নেতাদের আংশিক চরিত্র বোঝা যাবে।
১৯৬৯ সালে পুরো পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তারপর ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানকে এক চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান চিঠি পেয়ে ২৫ মার্চ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানে আবার সামরিক শাসন জারি করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইনের একটু ব্যতিক্রম ছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়নি এবং রাজনৈতিক দলের অফিসগুলো সিলগালা করা হয়নি। শুধু রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবে দলগুলো কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক করতে বাধা দেয়া হয়নি।
১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা দেন যে, ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো যাবে। প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরপরই রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয়ভাবে জনসভা ও মিছিল-সমাবেশ করার সুযোগ পায় এবং জনসভাসহ সার্বিক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে শুরু সবগুলো দলই জনসভা আয়োজন শুরু করে। একেবারে জানুয়ারি মাসের প্রথমেই আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে জনসভা করার উদ্যোগ নেয়। আওয়ামী লীগ জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় রোববার ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা করার ঘোষণা দেয়। পরের রোববার ১৮ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামী এবং ২৫ জানুয়ারি রোববার পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি জনসভার তারিখ ঘোষণা করে। তৎকালে রোববার সরকারি ছুটি ছিল, তাই এদিন পল্টন ময়দানে জনসভা করার চাহিদা ছিল বেশি। পল্টন ময়দানে জনসভা করতে হলে আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুমতি নিতে হতো। তাই এ তিন দল জানুয়ারি মাসে পরপর তিন রোববার জনসভার অনুমতি নেয়। তবে তিনটি জনসভার অনুমতি মিললেও দুটি জনসভা পণ্ড করে দেয়া হয়েছিল। এ তিনটি জনসভা নিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন বইয়ে নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। আজকের এ নিবন্ধে পল্টনের তিনটি জনসভা নিয়ে লেখার মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।
বিশিষ্ট বামপন্থি লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইতে এ তিনটি জনসভা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। মহিউদ্দিন আহমদ প্রথমা প্রকাশিত তার এ বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় লেখেন, “১১ জানুয়ারি রোববার ছিল আওয়ামী লীগের জনসভা। সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করলে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ হয়ে যাবে। সে সময়ে খুব বেশি কৃষকের এ পরিমাণ জমি ছিল না। খাজনাও ছিল সামান্য। তবু এ ঘোষণার একটা লোকপ্রিয় দিক ছিল।
পরের রোববার ১৮ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর জনসভা। আগেই ছাত্রলীগের সিরাজ গ্রুপের একটা সিদ্ধান্ত ছিল, জামায়াতকে নির্বিঘ্নে সভা করতে দেয়া হবে না। সভা শুরু হলে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে গগনবিদারী স্লোগান উঠল ‘জয় বাংলা’। জামায়াতের কর্মীরা সম্ভবত আগে থেকে আঁচ করেছিলেন, সভায় গোলমাল হতে পারে। তারা মঞ্চের নিচে অনেক লাঠিসোঁটা জমা করে রেখেছিলেন। প্রতিপক্ষও প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। এলোপাতাড়ি স্লোগান, চিৎকার ও হই-হুল্লোড়ে সভা পণ্ড হয়ে গেল।
পরের রোববার ২৫ জানুয়ারি ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) জনসভা। ছাত্রলীগের সিরাজ গ্রুপ আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নুরুল আমিনকে সভা করতে দেওয়া হবে না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে দায়ী করা হতো। এজন্য তার ওপর মানুষের প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা ছিল। নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হতে না হতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পল্টন ময়দান প্রকম্পিত হলো। কেউ কেউ শেখ মুজিবের ছবিসহ ক্যালেন্ডার নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়লেন। পুরো পরিবেশটাই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। একপর্যায়ে পিডিপির নেতারা মঞ্চ ভেঙে চলে যেতে বাধ্য হলেন।”
মহিউদ্দিন আহমদ তিনটি জনসভা নিয়ে লিখলেও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম তার রাজনৈতিক ইতিহাসসমৃদ্ধ ‘জীবনে যা দেখলাম’ বইয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর দুটি জনসভা নিয়ে লিখেছেন। জীবনে যা দেখলাম বইয়ের তৃতীয় খণ্ডের ৯৪-৯৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “১৯৭০-এর পয়লা জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা প্রকাশ্যে শুরু হওয়ার কথা। তাই জনসভা দিয়ে তা শুরু হয়। সেকালে রোববার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। তাই বড় জনসভা রোববারেই হতো। ১১ জানুয়ারি রোববার দিন সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ পরিস্থিতিতে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভার প্রধান বক্তা শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনবার জন্য সমাবেশ যেমন বিরাট হওয়া স্বাভাবিক তেমনই হলো। শেখ মুজিব বিজয়ী মহাবীরের মতো বক্তব্য রাখলেন। বিশাল জনসমুদ্র যেভাবে নেতার ডাকে সাড়া দেবার কথা সেভাবেই হাততালি ও স্লোগান দিয়ে সাড়া দিলো। ৬ দফা হাসিল করতে হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দখল করতে হবে বলে জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। পত্রিকায় এ সভার খবর যথাযথভাবেই ফলাও করা হয়।
এ সভার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর সকল রাজনৈতিক দল একেবারেই চুপসে গেলো। পল্টনে জনসভা করার হিম্মত কেউ করবে বলে মনে হলো না। শেখ মুজিবের মোকাবিলায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের চিন্তা কোনো দল করতে এগিয়ে আসবে কিনা তখনো বোঝা গেল না।”
পল্টন ময়দানে জামায়াতের জনসভা নিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম তার লিখিত বই ‘জীবনে যা দেখলাম’ তৃতীয় খণ্ডের ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
অধ্যাপক গোলাম আযম ‘পল্টন ময়দানে জামায়াতের জনসভার প্রস্তুতি’ শিরেনামে লিখেছেন, “জামায়াতে ইসলামী একটি আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক দল। কোনো একটি দলের ভয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো অবস্থায়ই জামায়াতের সাজে না। তাই ইসলামী আদর্শ ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার স্বার্থে জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পল্টনে জনসভা করার ঘোষণা দেবার পরদিনই জামায়াতে ইসলামী ১৮ জানুয়ারি জনসভা করার খবর পত্রিকায় জানিয়ে দিলো।
স্বাভাধিক কারণেই আওয়ামী লীগ এটাকে তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করলো। হয়তো তারা এটাকে দুঃসাহসিক ধৃষ্টতাই গণ্য করলো আর কোনো দল এমন ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস করেনি বলে জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষিপ্ত হবারই কথা। জনসভার প্রস্তুতি জোরেশোরেই চললো। সারা শহরে পোস্টার লাগানো হলো। রাতে পোস্টার সাঁটা হয়। দিনে বিরোধীরা তা ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো। আবার পোস্টার ছেপে রাতে লাগাতে হলো। পোস্টার লাগাতেও বাধার সম্মুখীন হতে হলো। বাধার মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়ে গভীর রাতে, কখনো শেষ রাতে, পোস্টার লাগাতে হয়। মাইকে রোড পাবলিসিটিতে বাধা দেওয়া হয়।
জামায়াতের জনসভার প্রধান বক্তা হিসেবে মাওলানা মওদূদীর নাম থাকায় বিরোধিতার মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেলো। শেখ মুজিবের নেতৃত্বের মোকাবিলায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো নেতার আগমন তাদের নিকট সহনীয় না হওয়ারই কথা।
আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলার ভয়ে প্রধান কয়েকটি পত্রিকা জনসভার বিজ্ঞাপন ছাপাতেও সাহস করেনি। এ পরিস্থিতিতে জনসভার প্রস্তুতি যথারীতি চললো। স্বেচ্ছাসেবকদের পাহারায় ১৬ জানুয়ারি থেকেই পল্টন ময়দানে বিরাট মঞ্চ তৈরি হতে লাগলো। স্বেচ্ছাসেবীরা সর্বক্ষণ পাহারায় নিযুক্ত ছিল। ঢাকা শহরের আমীর ইঞ্জিনিয়ার খুররম যাহ মুরাদ নিজে তদারকি করতে থাকলেন।
পত্রিকার সহযোগিতার কোনো আশা না থাকায় মুরাদ সাহেবের কয়েক মাসব্যাপী অক্লান্ত প্রচেষ্টায় জনসভার পূর্বদিন ১৭ জানুয়ারি থেকে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়।
মাওলানা মওদূদী ১৭ তারিখেই ঢাকায় এসে পৌঁছলেন। বিমানবন্দর থেকে বিশাল মিছিল মাওলানাকে সংবর্ধনা জানিয়ে শহরে নিয়ে এলো। এ খবর বিরাট আকারে ১৮ তারিখের দৈনিক সংগ্রামে মিছিলের ফটোসহ প্রকাশিত হওয়ায় জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেল।’
গোলাম আযম সাহেব তার বইয়ের ৯৭-৯৯ পৃষ্ঠায় ‘১৮ তারিখের জনসভা’ এ শিরোনামে লিখেছেন, ‘বিকাল ৩টা থেকেই জনসভা শুরু হয়। বায়তুল মোকাররমে আযান হলে আমরা মাঠেই আসরের নামায আদায় করলাম। মঞ্চের ঠিক পেছনেই মসজিদটি ছোট হওয়ায় কিছু লোক ঐ মসজিদে নামাযে শরিক হন। আসরের নামাযের পর বায়তুল মোকাররমের নামাযীরা ময়দানে ঢুকলে ময়দান ভরে গেলো। আসরের পর মূলতবি জনসভা আবার শুরু হলো। আমি সভাপতিত্ব করছিলাম। আধঘণ্টা পর মাওলানা মওদূদীর মঞ্চে পৌঁছার কথা। তিনি আওরঙ্গজেব রোডস্থ জনাব ফযলুদ্দীন শামসী নামক এক ব্যবসায়ী রুকনের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
আসরের পর সভা শুরু হবার সাথে সাথেই দক্ষিণ দেয়ালের বাইরে থেকে ইট-পাথরের ঢিল এসে শ্রোতাদের ওপর পড়তে থাকলো। যে জখম হয় তাকে স্বেচ্ছাসেবকরা মঞ্চের উত্তর পাশের তাঁবুতে নিয়ে সেবা করতে লাগলো। প্রবেশপথ দিয়ে লাঠিধারী সন্ত্রাসীরা ময়দানে ঢুকার চেষ্টা করছিল। স্বেচ্ছাসেবকরা খালি হাতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো। এমন পরিস্থিতিতেও ময়দানে উপস্থিত শ্রোতারা ভীত হয়ে ছোটাছুটি করেনি। বুঝতে পারলাম যে, ময়দানের ভেতরে সাধারণ পাবলিক নেই। তারা সবাই জামায়াতের কর্মী ও সমর্থক। এ সভায় গোলমাল হবে আশঙ্কায় সাধারণ শ্রোতা যারা এসেছিলেন তারা ময়দানের বাইরে রাস্তায় ছিলেন। উচ্চ মঞ্চ থেকে দেয়ালের বাইরে পশ্চিমের রাস্তায় অনেক লোক দেখা গেলো।
মঞ্চ থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে, দক্ষিণের রাস্তায় প্রচুর পুলিশ রয়েছে। অথচ লাঠি হাতে যারা সভায় আক্রমণ করতে চেষ্টা করছে তাদের সন্ত্রাস তারা নীরবে দেখছে। চল্লিশ মিনিট পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকরা তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। আমি মঞ্চ থেকে মাইকে পুলিশকে বললাম, ‘আপনারা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন? জনসভা করার গণতান্ত্রিক অধিকারে যারা বাধা দিচ্ছে তাদেরকে প্রতিহত করা কি পুলিশের দায়িত্ব নয়?’ আমি লক্ষ করলাম যে, পুলিশ ময়দানের প্রবেশপথে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। তখন আমি স্বেচ্ছাসেবকদের এখান থেকে সরে আসার পর লাঠিয়াল বাহিনীকে পুলিশ ময়দানে ঢুকবার জন্য পথ করে দিল। তারা যখন সরাসরি শ্রোতাদের ওপর আক্রমণ করলো, তখন সবাই যে সেদিকে সম্ভব পালাবার চেষ্টা করতে বাধ্য হলো। একমাত্র পূর্বদিকের দেয়াল টপকিয়ে পার হবার পথ ছিলো । দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে তো সন্ত্রসীরা দীর্ঘ সময় ধরেই ঢিল মারছিল।
মঞ্চ থেকে আমি মাইকে সভায় হামলার জন্য পুলিশকে দায়ী করে বক্তব্য রাখছিলাম। আমি মঞ্চেই শহীদ হবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আর যারা মঞ্চে ছিলেন তারা আমাকে মসজিদে চলে যাবার তাকিদ দিয়ে চলে গেলেন। সন্ত্রাসীরা ময়দানের মাঝামাঝি পৌঁছে গেলো। দুজন আমাকে জোর করে মঞ্চ থেকে টেনে নিয়ে গেলো। ছোট্ট সমজিদের বারান্দায়ও ঢুকবার মতো খালি জায়গা ছিল না। বারান্দায় তিনদিক নিচু দেয়ালে ঘেরা। পূর্বদিকের দেয়ালে লোহার সিকের নিচু গেটের বাইরে কয়েকজন আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে আমার দু’পাশে দুজন শুয়ে গেলো এবং একজন আমার ওপর উপুড় হয়ে আমাকে ঢেকে দিল। বারান্দার টিনের চালে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ছিল। একটা ঢিল আমার ডান হাতের কনুইতে এসে লাগলো। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ছেয়ে গেছে। বারান্দাসহ মসজিদ লোকে ঠাসা।
হামলাকারীরা মসজিদের কাছে আসতে পারলে বারান্দায় যারা ঠাসাঠাসি করে ছিলেন তাদেরকে দেওয়ালের বাইরে থেকে লাঠি নিয়ে আঘাত করতে পারতো। তারা একটু দূরে থেকে ইটপাটকেল মারায় মসজিদের বারান্দাও রক্তাক্ত হয়। সভা সম্পূর্ণ পণ্ড করার কাজটি পুলিশ বিনা বাধায় সমাধা করার মহান দায়িত্ব পালন করলো। তবে পুলিশ তাদেরকে মসজিদে এসে আক্রমনের সুযোগ দেয়নি। পুলিশ এসে মসজিদ ঘিরে ফেললে ঢিল পড়া থেমে যায়। ঢিল পড়া বন্ধ হলে বুঝা গেলো যে, হামলাকারীরা চলে গেছে। তখন আমাকে যারা ঢেকে রেখেছিল তারা উঠে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে তাদের একজনকে চিনলাম, যে আমাকে ওপর থেকে ঢেকে রেখেছিল। সে ছাত্রকর্মী মাসুদ আলী, যে বর্তমানে কানাডায় থাকে। বাকি দুজনও ছাত্র, যারা আমার পূর্ব পরিচিত নয়। মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারীরা বের হতে লাগলো। তাদের মধ্যে আমার ছোট ভাই ডা. গোলাম মুয়াযযামকেও দেখলাম। আশেপাশে পুলিশ দেখা গেলো। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন যে, তিনি ঢাকার ডিসি।
ডিসি সাহেব আমাকে বললেন, ‘আসুন গাড়িতে আপনাদের দু’জনকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিই।’ আমি ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মুয়াযযামকে নিয়ে যেতে পারেন। এখানে যারা আছে তাদের সবাই নিরাপদে চলে যাবার পর আমি যাবো। তবে আমি আপনার গাড়িতে যাব না। আপনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে সন্ত্রাসীদের হামলার সুযোগ করে দিলেন।’ তিনি আমার ভাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন। ভদ্রলোকটির নাম মুহাম্মদ আলী। তিনি কাদিয়ানী ছিলেন বলেই এমন জঘন্য ভূমিকা পালন করতে পারলেন।
সন্ত্রাসীরা আশপাশে কোথাও থাকতে পারে এবং মাঠে বা মাঠের বাইরে হামলা করতে পারে, এ আশঙ্কায় বাইরের খবর না নিয়ে মসজিদে যারা ছিলেন তাদের বের হয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে করলাম না। শহরের দায়িত্বশীলরা খোঁজ নিয়ে জানালো যে, সবাই চলে যেতে পারে, পথে কোনো আশঙ্কা নেই। তারাই আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলো। যেয়ে দেখি বাইরের ঘরে আহত স্বেচ্ছাসেবকদের প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। খবর এলো দুজন স্বেচ্ছাসেবক শহীদ হয়ে গেছে এবং আহত অনেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে।
যে দুজন শহীদ হয়েছিলেন তাদের নাম আবদুল মজিদ ও আবদুল আউয়াল। দুজনই ঢাকা আলীয়া মাদরাসার ছাত্র। পরের দিন যোহরের নামাযের পর চকবাজার শাহী জামে মসজিদে তাদের জানাযায় মাওলানা মুফতী দীন মুহাম্মদ (র) ইমামতি করেন। নামাযের আগে মাইকে আমি কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বললাম, ‘ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হলো, আর পাকিস্তানেই ইসলাম কায়েমের কথা বলার জন্য জনসভা করতে দেওয়া হয় না। তদুপরি সভার স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার অপরাধে ময়দানেই শহীদ হতে হয়।’ আমি লক্ষ করলাম, মুফতী সাহেবের চোখেও পানি।”
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে এমনি এক জানুয়ারি মাসে ঢাকার পল্টন ময়দানের আয়োজিত তিনটি জনসভার চিত্র থেকে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চিত্র বোঝা যায়। পাঠকরা তিনটি জনসভার চিত্র থেকেই তৎকালীন রাজনৈতিক ময়দান তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্মী-সমর্থকদের একটি গুণগত বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তরুণ প্রজন্ম বিগত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীদের চরিত্র ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু ৫৫ বছর আগের আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক চরিত্র ও নেতাদের আচরণ সম্পর্কে জানতে পারলেন ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসের তিনটি জনসভার চিত্র জেনে। পল্টন ময়দানে তিনটি জনসভা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির। গণতান্ত্রিক নিয়মে আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে জনসভা করতে পারে, করেছে এবং আওয়ামী লীগের জনসভায় কেউ হামলা করেনি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপির জনসভা দুটি আওয়ামী লীগ হামলা করে পণ্ড করে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও গণতান্ত্রিক নিয়মে এটা আওয়ামী লীগ এটা করতে পারে না। এটা দ্বারাই প্রমাণ হয় যে, আজকের আওয়ামী লীগের যে চরিত্র বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম দেখেছে ৫৫ বছর আগেও সেই একই অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসী চরিত্র ছিল দলটির। আমাদের দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক খোন্দকার আবদুল হামিদ তার এক রাজনৈতিক কলামে যথার্থই লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ তোমারই নাম ভণ্ডামী।’ কিন্তু সাধারণ জনগণ আওয়ামী লীগ ও তাদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে খুব বেশি জানে না। তার কারণ হলো বাংলা এ ভূখণ্ড তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের বাম ও নাস্তিক প্রভাবিত নষ্ট গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা সত্যকে লুকিয়ে মিথ্যাচার করার কারণেই প্রকৃত খবর সাধারণ জনগণ জানতে পারেনি। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সার্বিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা সঠিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা। কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব কেমন, কারা খারাপ ও কারা ভালো তা সংবাদপত্রে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের যে অংশটা বাম ও নাস্তিক তথা ভারতীয় লবি মেইনটেইন করে তারা উল্টোটা করেছেন। তারা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে ভিলেন বানিয়ে অসৎ সন্ত্রাসী ও ষড়যন্ত্রকারী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বানিয়েছেন দেশপ্রেমিক নেতা। গণমাধ্যমের বড় অংশের এ ধরনের অনৈতিকতা ও হলুদ সাংবাদিকদের কারণে সাধারণ মানুষ বার বার বিভ্রান্ত হয়েছে, সাধারণ জনগণ প্রকৃত সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব নির্বাচনে ভুল করেছেন। এতে দেশ, জাতি ও সাধারণ জনগণ বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।