আল কুরআনের সাথে এক রোমাঞ্চকর জার্নি!


১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥
আল কুরআন গবেষক আহনাফ ইবনে কায়েস। আরব মরুর এক জানবাজ মুজাহিদ। শৌর্য আর সাহসে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আরবি সাহিত্যেও তিনি ছিলেন এক উঁচু মাপের জ্ঞানতাপস। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র সংস্পর্শ তাঁর সৌভাগ্যে হয়নি, কিন্তু পেয়েছেন নবী (সা.)-এর কাছের ও প্রিয় বহু সাহাবীর একান্ত সান্নিধ্য। একদিন তার সামনে এক ব্যক্তি কুরআনের এ আয়াতটি পড়লেন, “আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাজিল করেছি, যাতে তোমাদের কথা আছে, অথচ তোমরা চিন্তা গবেষণা করো না।” (সূরা আম্বিয়া : ১০)।
এ আয়াতটি তাঁকে যেন এক নতুন দিগন্তের দিকে আহ্বান জানালো। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, ‘যাতে শুধু তোমাদের কথাই আছে’ এই কথার অর্থ কী? তিনি চিন্তা করছিলেন আর অভিভূত হচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল কেউ যেন নতুন করে কিছু শোনাল। তিনি কুরআন নিয়ে বসে গেলেন। কুরআনের গ্যালারিতে একে একে বিভিন্ন দল, গ্রুপের বর্ণনা তিনি পেতে শুরু করলেন। যেমন- প্রথম একদলের পরিচয় পেলেন, “এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়, শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ মাফের জন্য মাগফিরাত কামনা করে।” (সূরা যারিয়াত : ১৭-১৮)।
দ্বিতীয় একদলের পরিচয় পেলেন এভাবে, “তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে, তারা অকাতরে আমার দেয়া রিজিক থেকে খরচ করে।” (সূরা আস সাজদা : ১৬)।
কিছু দূর এগিয়ে যেতেই আবার তৃতীয় একদলের পরিচয় পেলেন- যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সিজদা ও দণ্ডায়মান থাকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়।” (সূরা আল ফুরকান : ৬৪)।
“যারা ব্যয় করে সচ্ছল এবং অসচ্ছল অবস্থায়, যারা রাগ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং কোমল, আল্লাহ তো কল্যাণকামীদের ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৩৪)।
এরপর চতুর্থ এক দলের পরিচয় পেলেন, যারা- (দুনিয়ার প্রয়োজনের সময়) অন্যদের নিজেদেরই ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়, যদিও তাদের নিজেদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদের কার্পণ্য থেকে দূরে রাখতে পারে, তারা বড়ই সফলকাম।” (সূরা হাশর : ৯)।
এভাবে একের পর এক অধ্যয়ন চলছে, আর চিন্তার গভীরে সাগরে ডুবে যাচ্ছেন আহনাফ। এবার পেলেন ৫ম আরেক দলের পরিচয়, “এরা বড় বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয়, তখন (প্রতিপক্ষকে) মাফ করে দেয়, এরা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, এরা সালাত কায়েম করে, এরা নিজেদের মধ্যকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি, তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে।” (সূরা আশ শুরা : ৩৭-৩৮)।
হযরত আহনাফ ছিলেন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। আর কুরআনে পাওয়া মুমিনদের পরিচয়ের সাথে তিনি নিজেকে মেলাতে পারলেন না। বরং বলেই ফেললেন, হায় আল্লাহ! আমি তো এ কুরআনের কোথাও ‘আমাকে’ খুঁজে পেলাম না। আমার কথা কোথায়? আমার চরিত্র তো কোথাও নেই? অথচ এ কুরআনে তো তুমি সবার কথাই বলেছো হে প্রভু! কিন্তু থেমে পড়লেন না তিনি বরং এগিয়ে চললেন আরো নতুন উদ্যমে।
এবার এ জার্নিতে তিনি পেলেন ৬ষ্ঠ গ্রুপে আরও কতক মানুষের পরিচয়, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে বলে, আমরা কি একটি পাগল ও কবির জন্য আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করব?” (সূরা সাফফাত : ৩৫-৩৬)।
তিনি এগিয়ে চললেন, পেলেন ৭ম আরেক দলের পরিচয়, “যখন এদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদের সামনে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয়, তখন অন্তর খুশিতে ভরে যায়।” (সূরা যুমার : ৪৫)।
৮ম আরেক দলের পরিচয়ও এলো তাঁর সামনে, “তোমাদের কিসে জাহান্নামের এ আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে- আমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরিব মিসকিনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম, এভাবে একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে গেল। (সূরা মুদ্দাসসির : ৪২-৪৭)।
হযরত আহনাফ এভাবে কুরআনে আঁকা একে একে অনেক দলের লোকদের চেহারার সাথে নিজেকে মেলাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু না! মিলল না। শেষের গ্রুপের সাথেও মিলল না। শেষ গ্রুপের ব্যাপারে তো তিনি বলেই ফেললেন-
“হায় আল্লাহ! এ ধরনের লোকদের ওপর তো আমি খুবই অসন্তুষ্ট। আমি এদের ব্যাপারে তোমার আশ্রয় চাই। এ ধরনের লোকদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই”।
তিনি যেমন নিজের ঈমানের ব্যাপারে আস্থাশীল ছিলেন, তেমনি গুনাহের ব্যাপারেও ছিলেন তিনি সমান সজাগ। কুরআনের পাতায় তাই তিনি এমন একটি চেহারা খুঁজে ফিরছিলেন, যাকে তিনি একান্ত নিজের বলে মনে করতে পারেন। তিনি মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ক্ষমা ও দয়ার ব্যাপারেও ছিলেন গভীর বিশ্বাসী। তাই তিনি কুরআনের পাতায় খুঁজে ফিরছিলেন এমন এক চরিত্রের, যেখানে তিনি পাবেন ভালো-মন্দ মেশানো মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে আবার গবেষণায় লেগে গেলেন। এবার তিনি পেয়ে গেলেন ৯ম এমন একদল মানুষের বর্ণনা, যাঁদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“হ্যাঁ! এমন ধরনের কিছু লোকও আছে, যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালো-মন্দ মিশিয়ে কাজ-কর্ম করে, কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায়, মহান আল্লাহ এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা বড়ই দয়ালু-ক্ষমাশীল।” (সূরা আত তাওবা : ১০২)।
হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস এ আয়াতের সাথে নিজের অবস্থাকে ভালোভাবে বুঝতে চাইলেন, মেলাতে চাইলেন তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সাথে। যখন তিনি আল কুরআনে বর্ণিত এ চরিত্রের সাথে হুবহু মিল খুঁজে পেলেন, তখন বললেন- হ্যাঁ! এতক্ষণ পর আমি আমাকে উদ্ধার করেছি। আমি আমার গুনাহের কথা অকপটে স্বীকার করি,
আমি যা কিছু ভালো কাজ করি, তাও আমি অস্বীকার করি না। এটা যে মহান আল্লাহর একান্ত মেহেরবাণী তা-ও আমি জানি। আমি মহান আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে নিরাশ নই। কেননা এ কুরআনেরই আরেক স্থানে বলা হয়েছে-
“আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে তারাই নিরাশ হয়, যারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট।” (সূরা আল হিজর : ৫৬)।
হযরত আহনাফ কুরআনের মর্ম অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুধাবনের পর নীরবে বলে উঠলেন-
“হে মালিক- তুমি মহান,
তোমার কুরআন মহান,
সত্যিই তোমার এ কুরআনে দুনিয়ার জ্ঞানী-গুণী, পাপী-তাপী, ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন সবার কথাই আছে। তোমার কুরআন সত্যিই অনুপম, সুন্দর। [পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দীন শায়েখ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) তার এক রচনায় হযরত আহনাফ ইবনে কায়েসের এ ঐতিহাসিক গল্পটি বর্ণনা করেছেন]।
হযরত আহনাফের মতো কতজন আমরা এভাবে আত্মযাচাই ও আত্মমূল্যায়নের সাথে আল কুরআন অধ্যয়ন করি? মনে রাখতে হবে- গতানুগতিক ধারায় শুধু পাঠ করে যাবার জন্য আল কুরআন নাজিল হয়নি।
এরশাদ হয়েছে, ‘কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
কেউ যদি কুরআনের ইতিহাস অধ্যয়ন করে এবং পূর্ববর্তীদের ওপর কুরআনের প্রভাব প্রত্যক্ষ করে তবে দেখবে কুরআনের এ বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আজকের মুসলিমরা, আমরা এ অসাধারণ গ্রন্থের অধিকারী হয়েও এ থেকে হেদায়েতের নূর পাচ্ছি না। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, কুরআনকে গতানুগতিক ধারায় শুধুমাত্র তিলাওয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ও যথাযথ হৃদয়ঙ্গম করে না পড়া।
হযরত ওমর (রা)-এর সূরা বাকারা শেষ করতে ৩ বছর লাগার কারণ কী? গভীরতর চিন্তাভাবনা, জ্ঞান ও গবেষণা এবং প্রাজ্ঞতার উপলব্ধির মাধ্যমে নিজ আমলে পরিণত করা। এজন্য সেই যুগ সোনালি যুগ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ শান্তি ও উন্নতির যুগ।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, মাসুক (মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষা কেন্দ্র)।