লাইভ সাক্ষাৎকারে মেজর ডালিম

মুজিব একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক বাকশাল কায়েম করেছিল


১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

সোনার বাংলা রিপোর্ট : ১৯৭৫ সালে বিপ্লবের অন্যতম নায়ক মেজর ডালিম বলেন, ‘মুজিব তো মারা যায়নি, মুজিব একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। সেনা অভ্যুত্থান তো আর খালি হাতে মার্বেল খেলা না। ওখানে দুই পক্ষ থেকেই গোলাগুলি হয় এবং হতাহত হয় দুই পক্ষেই। যেমন মুজিবের পক্ষের কিছু লোক মারা গেল, সেভাবে সেনা অভ্যুত্থানকারী বিপ্লবীদের পক্ষ থেকেও কিছু লোক প্রাণ হারায়। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু বিপ্লবীরা বিজয়ী হয়ে গেল, তারা ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিল।’
তিনি বলেন, ‘মুজিবের মৃত্যু ও বাকশাল পতনের খবর জানার পর শহর, বন্দর ও গ্রামের লাখ লাখ মানুষ আনন্দ মিছিল বের করলো। যেসব রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল, তারাও জনসমর্থন নিয়ে রাস্তায় চলে আসে। এভাবেই জনস্বীকৃতি পেয়েছিল ১৫ আগস্টের বৈপ্লবিক সামরিক অভ্যুত্থান।’
গত ৫ জানুয়ারি রোববার দিবাগত রাতে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ টকশোতে এসব কথা বলেছেন দীর্ঘদিন আড়ালে থাকা মেজর শরিফুল হক ডালিম। ‘বিশেষ লাইভে যুক্ত আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিম (বীরবিক্রম)’ শিরোনামে লাইভে যুক্ত হন সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা।
শরিফুল হক ডালিম। যিনি মেজর ডালিম নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
টকশোতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নেপথ্যের ইতিহাস তুলে ধরেন বিদেশে নির্বাসিত আলোচিত এ সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
শুরুতে মেজর ডালিম বলেন, ‘দেশবাসীকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতাকে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা আংশিক বিজয় অর্জন করেছেন, তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। সঙ্গে লাল সালাম। বিপ্লব সমাজ বা যেকোনো রাষ্ট্রে একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেই অর্থে তাদের বিজয় এখনো পুরোপুরিভাবে অর্জিত হয়নি। তার জন্য আরও সময় প্রয়োজন।’
২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক ছাত্র-জনতাকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি অর্জন করার পর তাদের এমন একটি অবস্থানে থাকতে হবে, যেখান থেকে তারা নীতিনির্ধারণ করতে পারবে। তাদের ইচ্ছা, চাহিদা ও প্রত্যাশার সঙ্গে জনগণের চাহিদার মিল রয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কিন্তু তাদের।’
মেজর ডালিম বলেন, ‘সম্প্রসারণবাদী-হিন্দুত্ববাদী ভারত যার কব্জায় আমরা প্রায় চলে গেছি। সেই অবস্থান থেকে ৭১’-এর মতো আরেকটা স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের আগে শেখ মুজিবের চরিত্র ছিল এক। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। পাকিস্তান আর্মি যখন ২৫ ও ২৬ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। যাতে লক্ষ লক্ষ, হাজার হাজার শিশু-নারী-পুরুষ প্রাণ হারালো কোনো কারণ ছাড়া। তারপর সেই অবস্থায় তথাকথিত নেতাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা তখন তাদের নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে যার যার মতো জায়গায় চলে গেলেন। মুজিব স্বয়ং পাকিস্তান আর্মির কাছে ধরা দিলেন। তাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে পরিবারের ভরণপোষণ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে গেলেন।’
ডালিম বলেন, ‘তখন দিকহারা-দিশেহারা মানুষ বুঝতে পারছিলো না, তারা কী করবে। কোথায় যাবে, কীভাবে প্রাণ বাঁচাবে। সেই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ভেসে এলো মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ডাক। আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে। সেই ডাকে দেশের মানুষ একটা আলোর রশ্মি দেখলো। আমাদের এভাবে মরণের হাত থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুললো। আমরা আর বসে থাকলাম না। যাদের সাহস ছিল, দেশ প্রেম ছিল তারা সেই সংগ্রামে যোগ দিল।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে বিস্তারিত তুলে ধরেন মেজর ডালিম। তিনি বলেন, ‘খুবই স্পর্শকাতর প্রশ্ন। নিজের বাদ্য নিজে বাজানো যায় না। প্রথম কথা, ১৫ আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এটার সূত্রপাত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা কাদের ইন্টারেস্টে হচ্ছে? এটা কি আমাদের ইন্টারেস্টের জন্য হচ্ছে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবো? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।’
এই বীরবিক্রম বলেন, ‘যখন সাত দফায় চুক্তি করে নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীনকে পারমিশন দেয়া হলো একটা প্রভিশনাল গভমেন্ট গঠন করার। সাতটা ক্লজ পড়ে সাইন করার পর নজরুল ইসলাম ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। এটা যে একটা দাসখত আমরা ক্রমান্বয়ে ভারতের একটা করদরাজ্য-অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবো।’
মেজর ডালিম বলেন, ‘শেখ মুজিবকে যখন ছাড়া হলো, তখন তো তিনি কিছুই জানতেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নাকি মুক্তিফৌজ বলে কিছু ছিল। হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছে, প্রাণ হারিয়েছে সেসব কিছুই জানতেন না। তাকে যখন ছেড়ে দেয়া হলো ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করে মুজিব বললেন, আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। তখন গান্ধী বললেন, আপনি না ফোন করলে আমিই আপনাকে ফোন করতাম। আপনি নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় যাবেন। মুজিব সেটাই করলেন, লন্ডন হয়ে নয়াদিল্লি গেলেন।’
দেশে ফিরলেন মুজিব। তার ক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুজিবকে দিয়ে রক্ষীবাহিনী তৈরি করলো ভারত। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে নামেমাত্র সেনাবাহিনী রাখবে। মুজিব কায়েম করলেন একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বাকশাল। তিনি চিন্তা করলেন নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেবেন। এ বাকশালের সদস্য সবাই। সেই বাকশাল করার পর মুজিবের শক্তি বেড়ে গেল। তার নিষ্ঠুরতা এমন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল যে মানুষ একদিন মুজিবের জন্য দোয়া করেছিল- এই মুজিব আমাদের চোখের মণি। আমাদের বাঁচাবে সেই মুজিবের জন্য মানুষ আল্লাহর কাছে দোয়া চাচ্ছিলো আমাদের মুজিবের হাত থেকে বাঁচাও, আমরা মরে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘মুজিবের মৃত্যু ও বাকশাল পতনের খবর জানার পর শহর, বন্দর ও গ্রামের লাখ লাখ মানুষ আনন্দ মিছিল বের করলো। যে সব রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল তারাও জনসমর্থন নিয়ে রাস্তায় চলে আসে। এভাবেই জনস্বীকৃতি পেয়েছিল ১৫ আগস্টের বৈপ্লবিক সামরিক অভ্যুত্থান।’
জাতীয় সঙ্গীত ইস্যুতে মেজর ডালিম বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বা অন্যান্য স্বনামধন্য দেশীয় কবিদের গান হতে পারত’। ভিনদেশি একজন কবির গানকে জাতীয় সঙ্গীত বানানোকে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ মুজিবের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মেজর ডালিম বলেন, ‘আমার বইতে পরিষ্কার লেখা আছে মুজিব পরিবারের সাথে আমার কী সম্পর্ক ছিল। সেটা ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে। আমরা কিন্তু তার সঙ্গে বিট্রে করিনি। আমাদের যখন চাকরি থেকে বের করে দিলেন, আমরা মেনে নিলাম। তিনি নিজে রাখলেন আমাকে আর নুরকে।
শেখ মুজিবকে জাতির পিতা প্রসঙ্গে মেজর ডালিম বলেন, ‘আমি একজন মুসলমান হিসেবে কাউকে জাতির পিতা, জাতির মাতা, জাতির ভাতিজা এগুলো আমি মানি না। এগুলো সঠিক বয়ান নয়।’
এ সময় মেজর ডালিমের স্ত্রীর অপহরণ প্রসঙ্গে ইলিয়াসের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একটা মজার ঘটনা। আমার বইতে লেখা আছে যদিও। আমার এক খালাতো বোন। তার নাম তাহমিনা পারভিন। তার বিয়ে ঠিক করেছিলাম আমি আর নিম্নি কর্নেল রেজার সঙ্গে। যে আমাদের চেয়ে জুনিয়র। বিয়ে ও অনুষ্ঠান হবে লেডিস ক্লাবে। দু’পক্ষই আমাদের পরিচিত। তখন আমরা কী করলাম, সব এরেঞ্জমেন্টের দায়িত্ব আমাদের ওপর এলো। এত মানুষের সঙ্গে যে পরিচিত, তো কাকে রাখি আর কাকে বাদ দিই। দুই তরফে দুই থেকে তিন হাজারের মতো লোক ইনভাইট করা হলো। চলছে বিয়ের আসর। তখন আমার একমাত্র শালা যার নাম বাপ্পি। সে ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ছুটিতে আসছে দেশে। হি ওয়াজ অলসো প্রেজেন্ট ইন দি সিরিমনি। আমি আর নিম্নি তো দুই পক্ষের হোস্ট বলা যায়। সবার দেখাশোনা করছি। বাপ্পি বসে আছে ছেলেদের যেখানে বসার জায়গা সেখানে। তখন লম্বা চুলের একটা ফ্যাশন ছিল আরকি। সে অন্য গেস্টদের সঙ্গে বসে ছিল। তার পেছনের রো-তে গাজী গোলাম মোস্তফা, হিজ ওয়াইফ ওয়াজ অলসো ইনভাইটেড ইন দ্য ফাংশন ফ্রম দি আদার সাইড। নট ফ্রম আওয়ার সাইড। মানে ছেলে পক্ষের। গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেরা ও সাঙ্গ-পাঙ্গরা পেছনের সিটে বসা। তাদের মধ্যে একটা ছেলে বাপ্পির চুল টান দিল পেছন দিক থেকে। বাপ্পি ভদ্র মানুষ, বিদেশে থাকে, বিদেশে বড় হয়েছে, সে কিছু বলে নাই। আবার ওরা চুল টান দিল। দ্বিতীয়বার টান দেয়ার পরে বাপ্পি পেছনে তাকিয়ে দেখলো যে একটা ছেলে। তারপর সে বলল, তুমি চুল টান দিয়েছে? বলল হ্যাঁ, বলল, কেন? বলল আমরা দেখছিলাম এত সুন্দর চুল। এটা কি পরচুলা না আসল? আচ্ছা চিন্তা করো যে, সে তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, আর এ পুঁচকে ছেলে তখন যে স্কুলেও পড়ে না বা স্কুলে সিক্স-সেভেনে পড়ে মনে হয়। তখন বাপ্পি বলে, বেয়াদব ছেলে। তুমি আর এখানে বসবে না। অন্য কোথাও গিয়ে বস। ওরা বেরিয়ে চলে গেল। আমরা কিছুই জানি না। আমি আর নিম্নি এতই ব্যস্ত, দুই পক্ষের দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ দেখলাম রেডক্রসের দুটি মাইক্রোবাস। আর একটা সবুজ রঙের গাড়ি। গাড়ি আগে ও পেছনে দুই মাইক্রোবাস এলো, থামলো। দুইটা মাইক্রোবাস থেকে প্রায় ৮ জন সাদা পোশাক পরা লোক নামলো। আর প্রথম গাড়ি থেকে নামলো গাজী গোলাম মোস্তফা। তার স্ত্রী কিন্তু উপস্থিত মেয়ে মহলে। উনি গাড়ি থেকে নেমেই চিৎকার করতে শুরু করলেন মেজর ডালিম কোথায়? মেজর ডালিম কোথায়? বহুত বাড় বাড়ছে। আর সহ্য করা যায় না। আমি অবাক হয়ে গেলাম এরকম চিৎকার করছে কে? একজন ছেলে আসলো। এসে বলল, আপনাকে খোঁজ করছে গাজী গোলাম মোস্তফা, চিৎকার করছে। তার সাথে আট দশজন স্টেনগানধারী লোক আছে। মাইন্ড ইউ, তখন কিন্তু আর্মি ওয়াজ ডেপ্লোয়েড ইন দ্য হোল কান্ট্রি টু রিকোভার ইলিগ্যাল আর্মস। আর ঢাকা হেডকোয়ার্টার্স ছিল রেসকর্স। আমরাও সেই অপারেশনে যুক্ত ছিলাম। যাই হোক, আমি বাইরে এলাম। আমি গোলাম মোস্তফার সামনা-সামনি বারান্দাতে। বললাম, আমিই মেজর ডালিম। আপনি আসুন, বেগম সাহেবাতো আছেন ভেতরে, আপনি আসুন। বর-বধূকে দোয়া করে যান।
তিনি বললেন, হারামজাদা বাড় বাড়ছে আর্মির, আজকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। আমি দেখলাম আমার চারদিকে স্টেইনগান ঠেকালো প্রায় চার-পাঁচজন মানুষ। আর চার-পাঁচজন দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, এটা কি? আমি একজন…(অস্পষ্ট) মানুষ। আমার স্কট আছে ওখানে প্রায় চার পাঁচজন। ওয়্যারলেস আছে। আই ক্যান কল এনিওয়ান এনিটাইম… একি অবস্থা। এরকম বিয়ের মধ্যে হুলস্থূল কাণ্ড। বললাম, দেখেন কিছুই হয়নি। ব্যাপার কি? আপনি এতটা উত্তেজিত কেন। বললেন, ওঠ! এই ওঠা মাইক্রোতে। আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে মাইক্রোতে। বললাম, ব্যাপার কী? এটাতো একটা বিয়ে বাড়ি। একটা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আর আপনি আমাকে বলছেন- ওঠ। আমার কাপড়-চোপড় ধরে টেনে চার-পাঁচজন মিলে আমাকে উঠালো। খবর চলে গেল অন্দরমহলে। নিম্নি আর আমার শাশুড়ি, আমার খালা শাশুড়ি মানে কন্যার মা। উনি বেরিয়ে এলেন। বললেন, কী ব্যাপার! তারা দেখেন যে, আমাকে এরকম ঠেলাঠেলি করে উঠানো হচ্ছে মাইক্রোবাসে। আমি মাইক্রোবাসে উঠালাম। উঠে দেখি চুল্লু আর আলম নামে দুইজন… ওদেরও মারতে মারতে রক্ত বের করে ফেলেছে। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আহত অবস্থায় তারাও মাইক্রোবাসে। তখন আমার খালাম্মা গাজীকে বললেন, গাজী সাহেব আপনি কী করছেন! আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। তারা বরপক্ষেরও আবার কন্যা পক্ষেরও। হয়েছে কী? ওরাতো ব্যস্ত। বলে কী আমি ওদেরকে উচিত শিক্ষা দেব। তখন আমার স্ত্রী বলল যে, তাকে (আমাকে) একা নিয়ে যেতে পারবেন না। আপনি আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। ঠিক আছে চল। ওরেও ধাক্কা দিয়ে উঠায় দিল মাইক্রোবাসে। তখন আমার খালা বললেন, গাজী সাহেব আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। যেখানে আপনি নিয়ে যেতে চান আমিও যাব সঙ্গে।
গাজী তখন ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর ডালিম বলেন, ‘তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি নয়, হি ওয়াজ অলসো দি চেয়ারম্যান অব দ্য রেডক্রস।’
মেজর ডালিম বলেন, ‘তখন ঢাকা শহরে গাজী হলো মুজিবের সবচেয়ে বড় লাঠিয়াল সরদার। অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ সাধারণত রেডক্রসের চেয়ারম্যান হয় না। কিন্তু ওকে বানানো হয়, যাতে লুট ও রিলিফের মাল চুরি করতে সুবিধা হয়। যাইহোক, সেটা অন্য ব্যাপার। তারপর আমাদেরকে নিয়ে উনি গাড়ি ঘুরিয়ে চললেন প্রথম ফার্মগেটে দিকে। ফার্মগেট দিয়ে ভেতরে ঢুকার পরে আমি দেখলাম যে, আরে সর্বনাশ কোথায় যাচ্ছে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে নাকি! তখন চিন্তা করছি কী করি। এর মধ্যে আমার খালা আর নিম্নি নিজেদের শাড়ি ছিঁড়ে চুল্লু আর আলমকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, যেখানে যেখানে ক্ষত। আমি হঠাৎ বললাম, গাড়ি থামাও ড্রাইভার। ইন দি মিইনটাইম স্বপন ও বাপ্পি ওরা কিছু গেস্টকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য বোধ হয় নিয়ে গিয়েছিল গাড়িতে করে বা গাড়ি আসছিল, না হয় দেরি হয়েছিল এমন কিছু। তো আমি বললাম গাড়ি থামা। ড্রাইভার গাড়ি থামায় দিল। আমার গাড়িতে প্রায় চারজন স্টেইনগানধারী লোক। তাদের একজনকে বললাম যে, গাড়িতে যিনি বসে আছে গোলাম মোস্তফা গাজী, নেমে এখানে আসতে। তারপর সেই লোকটা স্টেইনগান নিচে নামালো এবং গাজীর কাছে গেলো। গাজীও তখন থেমে গেলো। তখন মনে হলো ওরা তাকে বলছে, আপনাকে ডাকছে। তারপর গাজী আমাদের মাইক্রোবাসে আসলো। তখন আমি গাজীকে বললাম, গাজী সাহেব আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানি না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি আমাদের রেডক্রসের মাইক্রোবাসে নিয়ে আসলেন হাজার হাজার মানুষ যারা উপস্থিত ছিলো, তারা দেখলো। আমাদের সঙ্গে যাই করেন, আপনি কিন্তু পার পাবেন না। এটা শোনার পর গাজী ঘাবড়ে গেলো।
আমি বললাম, গাজী সাহেব আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিই।… আপনি আগে পারমিশন নেন, না হলে বাঁচতে পারবেন না। এর মধ্যে আমার ছোট ভাই স্বপন (বীরবিক্রম) লেডিস ক্লাবে ফেরত আসছে। ওরা ঘটনা শুনেই ওখান থেকে স্বপন সোজা চলে গেল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে বলল, বিয়ে বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করেছে। এ বিয়েতে কিন্তু জিয়াউর রহমান, শফিউর ও খালেদ মোশারফসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। এই খবর পাওয়ার পর সিইও অব দ্য এমপি ইউনিট সবখানে জানিয়ে দিলো। এরপর অফিসাররা যে যেভাবে সবাই ঢাকা শহরে বের হয়ে আসলো। তারা খুঁজতে লাগলো আমাদের অ্যাবডাকডেটড অফিসারের ওয়াইফ কোথায়। একদল অফিসারকে গাজীর বাড়িতে পাঠানো হলো। সেখানে যারা ছিলো তাদের সবাইকে বন্দি করা হলো।
মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেজর ডালিম বলেন, ‘এই ৩০ লাখ কথাটা জন্ম নিলো কীভাবে সেটার ইতিহাস আমার বইয়ের মধ্যে লেখা আছে। মুজিব যখন লন্ডন ও ইন্ডিয়া হয়ে বাংলাদেশে আসবেন, তখন লন্ডনে উনি কয়েক ঘণ্টা যাত্রা বিরতি করেছিলেন। এগুলো অর্গানাইজড করেছিল পাকিস্তান সরকার। তখন তার সঙ্গে দেখা করতে যায় বিবিসির বাংলা বিভাগের হেড সিরাজ ভাই। আর বাংলাদেশের মিশনের ইনচার্জ রেজাউল করিম। তিনি ফরেন মিনিস্ট্রি অফিসার যার সাথে আমিও চাকরি করছি কিছুদিন। জানাশোনা আছে। এই দুজন মুজিবুর রহমানের কাছে যায়। তখন মুজিব তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন। এটা সিরাজ ভাই আমাকে নিজেই বলেছেন। সিরাজ ভাইয়ের আমার একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল আগে থেকেই। যখন আমি ছাত্রজীবনে ছিলাম। তখন উনি বাংলা বিভাগের ইনচার্জ। ডেভিড ফ্রস্ট আসছেন মুজিবের ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। মুজিব তখন সিরাজ ভাই আর রেজাউল করিম সাহেবকে আলাদা ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, সত্যিই কি বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে? নাকি আমাকে কোথাও নিয়ে মেরে ফেলার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে? তখন সিরাজ ভাই বললেন, মুজিব ভাই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি যাচ্ছেন এজ আ প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ। কিন্তু আপনি ইন্ডিয়া হয়ে যাচ্ছেন কেন? সেটা আমরা বলতে পারবো না। এটা আপনার সিদ্ধান্ত। তখন জিজ্ঞাসা করলো (ইন্টার্ভিউ নেবে) ক্ষয়ক্ষতি কত? বলে যে, সবকিছু মিলে তিন লাখের মতো। তিন লক্ষ। তখন তিন লক্ষরে .. সিরাজ ভাই পরে আমাকে বলছেন, আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনাই যে মুজিব ভাই ইংরেজিতে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে কথা বলবেন। জানি তা বাংলায়ই বলবেন। যখন ইন্টারভিউটা নিতে আসলো, ডেভিড ফ্রস্ট আস্ক দিস কোশ্চেন হোয়াট ডু ইউ থিংক দ্য লস্ট অব লাইভস ইন দিস সো কল্ড ফ্রিডম? মুজিব বললেন থ্রি মিলিয়ন। তিন লাখকে বানিয়ে ফেললেন থ্রি মিলিয়ন। ওইখান থেকে যে রেকর্ড বাজা শুরু হইলো তা চলতেই আছে চলতেই আছে।