এক বেদুঈনের গল্প


২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:০৪

ইকবাল কবীর মোহন : মহানবী (সা.) একদিন পথ চলছিলেন একা একা। বিশ্বজাহানের নবীর মনে তখন নানান স্মৃতি জেগে উঠছিল। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কত কী ঘটনা তাঁর মনে উদিত হচ্ছিল। কতদিন, কতরাত অভাবে-অনটনে উপোসে কেটেছে তাঁর জীবন। কত অবিচার-অত্যাচারের ধকল তাঁকে সইতে হয়েছে। মহান আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে কত বাধার পাহাড় তিনি অতিক্রম করেছেন। কাফের বেঈমানরা তাঁর ওপর কত অমানুষিক অত্যাচার করেছে। পাথর ছুড়ে তাঁর শরীর রক্তাক্ত করেছে। গলায় ফাঁস পরিয়ে মারার চেষ্টা করেছে। উটের গলিত নাড়ি-ভুঁড়ি মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়ে উল্লাস করেছে।
তারপরও ক্রোধ থামেনি দুশমনদের। কুরাইশরা মহানবী (সা.)-কে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বাড়িঘর ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছে। এসব অজস্র মর্মান্তিক কাহিনী মহানবী (সা.)-এর মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। এভাবে পথ চলতে চলতে একসময় তিনি এক স্থানে এসে থমকে দাঁড়ালেন। সেখানে দেখতে পেলেন এক বেদুঈন উট জবাই করে গোশত বিক্রি করছে। বহুদিন ধরে বাড়িতে গোশত নেয়া হয়নি। তাই রাসূলুলাহ (সা.) বেদুঈনকে বললেন, ‘আমি তোমাকে এক ওয়াসক শুকনো খেজুর দেব, তার বিনিময়ে যতটা গোশত হয় তা আমাকে দাও।’ বেদুঈন সেই অনুপাতে গোশত মেপে দিলো। তারপর দুজন মিলে রাসূলুলাহ (সা.)-এর বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বাড়িতে পা রেখেই বেুদইন রাসূলুলাহ (সা.)-কে বলল, চটজলদি খেজুর নিয়ে আসুন-আমার তাড়া আছে।’
মহানবী (সা.) বললেন, ‘না, না দেরি হবে কেন? এই তো আমি এলাম বলে। তুমি খানিকটা দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি আসছি।’ এ কথা বলে রাসূল (সা.) ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। তিনি খুশি মনে স্ত্রীর হাতে গোশতগুলো তুলে দিলেন। তারপর মহানবী (সা.) বললেন, ‘ঘরে যে শুকনো খেজুরগুলো আছে তা দাও, বেদুঈনকে গোশতের দাম দিতে হবে। খেজুরের বিনিময়েই গোশতগুলো এনেছি।’
মহানবী (সা.)-এর কথা শুনে স্ত্রী তো হতবাক। তিনি জবাব দিলেন, হে রাসূল (সা.)! সেই খেজুরগুলো তো এখন আর নেই। স্ত্রীর কথা শুনে মহানবী (সা.) স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বেদুঈনকে এখন কী জবাব দেবেন! এটা যে খুব লজ্জার বিষয়। অগত্যা তিনি হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেদুঈনকে সব কথা খুলে বললেন। তাকে বিনীতভাবে বললেন, ‘দেখ ভাই, এখন তো দেখছি একটু সমস্যা হয়ে গেল। যা হোক ভাই, তুমি ভেবো না, দুদিন পরই আমি তোমাকে গোশতের দাম মিটিয়ে দেব।’
মহানবী (সা.)-এর কথা শুনে বেদুঈন তো রেগেমেগে একেবারে আগুন। সে হইচই শুরু করে দিল। সুযোগ পেয়ে বেদুঈন রাসূল (সা.)-কে বহু কথা শুনিয়ে দিল। নবীজি (সা.)-এর বাড়িতে হইচই শুনে কয়েকজন সাহাবী সেখানে জড়ো হলেন। বেদুঈনের অশালীন আচরণ দেখে সবাই তো হতবাক। সাহাবীরা তাই ক্ষুব্ধ হলেন। অথচ রাসূল (সা.) আর কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি নির্বিকার, শান্ত-স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বেদুঈনকে তিনি কোনো কটু কথাও বললেন না। বরং সাহাবীদের বললেন, তোমরা ক্ষান্ত হও। ওকে যা খুশি বলতে দাও। কেননা সব কথা বলার অধিকার ওর আছে। ও তো পাওনাদার।
তারপরও থামে না বেদুঈন। সে বলতেই থাকে। অগত্যা নবীজি (সা.) একজন আনসারকে বেদুঈনের প্রাপ্য শোধ করে দিতে বললেন। তিনি এ কথাও বললেন, তাকে যেন খুব ভালো খেজুরই দেয়া হয়। কথা শোনার পর বেদুঈনের রাগ পড়ল। সে শান্ত হলো। এ সময় বেদুঈনের চোখে মুখে অনুতাপের চিহ্ন ফুটে উঠল। ততক্ষণে বেদুঈন বুঝতে পারল যে, আসলেও তো লোকটা ভালো। বেদুঈন তার ভুল বুঝতে পারল। তার বুঝতে পারল, যা ঘটেছে তা রাসূল (সা.)-এর ইচ্ছাকৃত নয়। তাই সে নিজের আচরণের জন্য খুবই লজ্জাবোধ করছিল। এরই মধ্যে আনসার সাহাবী খেজুর নিয়ে এলেন। তা নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল বেদুঈন। কিন্তু অনুশোচনা তাকে প্রচণ্ডভাবে আহত করল। তার পা যেন আর সামনের দিকে এগোতে চাচ্ছিল না। অগত্যা বেদুঈন ফিরে এলো। মসজিদে নববীর সামনে এসে দাঁড়াল সে। তখন তার মনের আকাশে ভাসছিল পুরো ঘটনা। মহানবী (সা.)-এর সাথে তার দুর্ব্যবহার যেমন তার মনকে আহত করছিল, তেমনি রাসূল (সা.)-এর উত্তম ব্যবহারও তাকে আলোড়িত করছিল। বেদুঈনের চোখের সামনে তখন নবীজি (সা.)-এর শান্ত মৌন চেহারা ভেসে উঠল। এমন একজন ভালো মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার সত্যিই অকল্পনীয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেদুঈন এসব কথা ভাবছিল আর মনে মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিল। একসময় বেদুঈনের চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে উঠল। কী ভুলই না সে করেছে! সে আর স্থির থাকতে পারল না। তাই সে মাফ চাওয়ার জন্য মহানবী (সা.)-এর খোঁজে মসজিদে ঢুকে পড়ল।
মসজিদের ভেতরে গিয়েই দেখল মহানবী (সা.) লোকজনের সাথে কথা বলছেন। ভালো ভালো সব কথা। বেদুঈন সব কথাই শুনল। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলেন তিনি! বেদুঈন এসব শুনে অবাক হলো। এসব কথা শুনে বেদুঈনের মন বিগলিত হলো। এবার সে নবীজি (সা.)-এর কাছে গিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বেদুঈন বলল, হে রাসূল (সা.)! আপনার সাথে দুর্র্ব্যবহার করে আমি ভুল করেছি, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমি ক্ষমা চাই। এবার বেদুঈনের অশ্রুর বেগ যেন আরও বেড়ে গেল। মুখের ভাষাও থেমে গেল তার। আর কিছুই বলতে পারল না সে।
মহানবী (সা.) মহৎ মনের মানুষ। তিনি রহমতের নবী। তাই বেদুঈনের অবস্থা দেখে তাঁর মনও বিগলিত হলো। তিনি বেদুঈনকে সান্ত্বনা দিলেন। তাঁর পিঠে মমতার হাত বুলালেন। তারপর গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে নিলেন তাকে। এতে বেদুঈন আরও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদতে শুরু করল। মহানবী (সা.)-এর সুন্দর আদর্শ, সুমহান ব্যক্তিত্ব আর অনুপম ব্যবহার বেদুঈনকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করল।