জনগণের প্রত্যাশা পূরণে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই

একেএম রফিকুন্নবী
২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫৪

বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের ইতিহাস জনগণের প্রত্যাশা পূরণের অনুকূলে ছিল না। যারাই ক্ষমতায় গেছে, জনতার কথা চিন্তা না করে নিজের নিজের দলের আত্মীয়-স্বজনের দিকে বেশি নজর দিয়েছে। গড়ে তুলেছে নিজস্ব বলয়।
ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়ে একদলীয় শাসন বাকশাল করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পরিণতিও তারা ভোগ করেছে। জানাযা দেয়ার লোক পাওয়া যায়নি। ইন্না লিল্লাহ পড়তে মানুষ ভুলে গিয়েছিল। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই না।
পরপর ক্ষমতা দখল হয়েছে, কিন্তু জনতার ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। পরপর দুজন রাষ্ট্রপতির অপঘাতে মৃত্যু দেশের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। দলীয় লোকদের সাবধান হওয়া উচিত ছিল জনগণের ভাষা বোঝার জন্য। কেউই জনগণের কথা চিন্তায় আনেনি। সর্বশেষ স্বৈরাচারী হাসিনা ১৬ বছর দেশটাকে পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তার নিজের কায়দায় দেশে একদলীয় সংসদ, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগসহ সব জায়গায় দলীয় লোক বসিয়ে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশটাকে কারাগারে রূপান্তরিত করেছিল।
১৮ কোটি মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। স্বৈরাচার হাসিনার শাসনের শেষ পর্যায়ে এসে ছাত্র-জনতা এক হয়ে জুলাই-২৪ কোটা আন্দোলনের নামে এক দফা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাসিনাও তার শেষ চেষ্টা হিসেবে দেশটাকে গুলি, খুন, আয়নাঘরের সব পাপ এক জায়গায় এনেও পার পায়নি। মহান আল্লাহ হাসিনার দুষ্কৃতি আর সহ্য করেননি। ঘটে গেল ছাত্র-জনতার বিপ্লব। ৫ আগস্ট দুপুরে সব চেষ্টা বিফল হয়ে হাসিনা পালাতে বাধ্য হলো। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে রাস্তাঘাটে নেমে হাসিনার পতন মিছিল করে ছাত্র-জনতার উল্লাসে জাতি নতুন স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করে। বিপ্লবী সরকারের হয়ে শহীদ মিনারে এ সরকার শপথ নিলে দেশের ভালো হতো। ৫৩ বছরের জঞ্জাল সহজে উৎপাটিত করে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কাজে লাগত। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলো এ সরকারের, কিন্তু খুব একটা সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। হাসিনা সরকারের দোসররা সব জায়গায় বসে আছে। অতিসত্বর তাদের সরাতে হবে। কোনো আপস করা যাবে না।
আমরা উদাহরণ দিতে পারি তুরস্কের। এরদোগান সরকারকে উৎখাতের জন্য বিরোধীদের সামরিক অভ্যুত্থান আল্লাহর মেহেরবানিতে নস্যাৎ করে দিয়ে দ্রুততম সময়ে সামরিক-বেসামরিক লোকদের যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, সবাইকে চাকরিচ্যুত করে ভালো ও দেশপ্রেমিক লোকদের সাথে দেশটাকে আবার দেশের উন্নতি-অগ্রগতি সঠিকভাবে চালাতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে তুরস্ক এরদোগানের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলোর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে সিরিয়ার জনগণের বিপ্লব মাত্র ১২ দিনে স্বৈরশাসক বাশারকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেছিল তুরস্কের সহযোগিতায়।
আমরাও ১৮ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাসিনার দোসরদের উৎখাত করে বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।
ইতোমধ্যেই বৈষম্যবিরোধীরা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বৈঠক করেছেন। শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতা সমাবেশ করেছেন। ৫ আগস্ট বিপ্লবের সুফল জনগণের প্রত্যাশানুযায়ী করার ব্যাপারে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছে। আমরা জনতার পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের জোর দাবি করছি।
হঠাৎ করে বিএনপির রিজভী সাহেব জামায়াতের ওপর গোসসা করে অবাস্তব অভিযোগ করেছে। একেবারে ভ্রান্ত তার এ উক্তি। ইতোমধ্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন। ডাকাতি করে ২০১৭ সালে হাসিনার দোসর এস আলম ইসলামী ব্যাংক জবরদখল করেছিল। তিনি ব্যাংকের ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়ে গেছেন ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। টাকা উদ্ধারের সার্বিক চেষ্টার জন্য দোয়া করছি। ডা. শফিকুর রহমান সাহেব ইতোমধ্যেই বলেছেন, ব্যাংক তার জন্মদাতা মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। আমরা এ ব্যাংকের সার্বিক উন্নতি কামনা করি। মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজ্ঞানমেলায় ছাত্র-জনতার প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছাত্রশিবিরের সাবেক-বর্তমান নেতাদের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে সাধারণ ছাত্রদের মিলনমেলায় প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান দেশ ও জাতির কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে অনেক কাজে লাগবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা ১৮ কোটি মানুষের জন্য মর্যাদাশীল দেশ গড়তে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা চাই। সমর্থন চাই। ঐক্য চাই।
আপনারা জেনে খুশি হবেন। ইদানীং বিভিন্ন জনসভায় আমীরে জামায়াতের উপস্থিতিতে হিন্দু পুরোহিতরা সত্য ঘটনা উল্লেখ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। হাসিনার বানোয়াট, মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করে কথা বলছেন। জামায়াত-শিবিরের লোকেরা কোথাও হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করেনি, বরং আওয়ামী দুবর্ৃৃত্তরা হিন্দুদের বাড়ি, জমি, মেয়ে দখল করেছে- তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের এই ৫৩ বছরে যত হিন্দুদের নিয়ে কেচ্ছা-কাহিনী প্রচার করা হয়েছে, তার জন্য জাতিসংঘের অধীনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার আবেদন করেছেন। আমরা এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ এক ও অভিন্ন, কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ নই। আমরা এক জাতি। আমরা সবাই মিলে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে চাই। কোনো ভেদাভেদ নেই।
দেশে ৫৩ বছরের সবচেয়ে লজ্জাজনক এবং দুঃখ ও বেদনাদায়ক ঘটনা হলো বিডিআর হত্যার ঘটনা। ৫৭ জন চৌকস সামরিক অফিসারসহ সাধারণ জনগণের মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয়নি। যেহেতু স্বৈরাচার হাসিনা ও তার দোসর এবং প্রতিবেশী দেশের লোকেরা এতে জড়িত, তাই এর সুষ্ঠু বিচার হয়নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। বর্তমান সরকার একটি তদন্ত কমিশন করেছে মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে। আমরা আশা করব, এবার সঠিক তথ্য বের হয়ে যাবে। এটাকে বিদ্রোহ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কোনো মতেই ঠিক না। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করার জন্যই হাসিনার মদদে এ হত্যাকাণ্ড করা হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস স্থানীয় প্রশাসকদের সাথে বৈঠক করে বলেছেন, স্থানীয়ভাবে দল-মত নির্বিশেষে লোকদের নিয়ে বৈঠক করে দেশের হাটবাজার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি রোধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সবাইকে নিয়ে সংগ্রাম কমিটি করে নব্য চাঁদাবাজি, দখলবাজি রোধ করতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ চালাতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। উৎপাদক ও ভোক্তাদের মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী লোকের আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে গ্রামের হাটবাজার থেকে পণ্য কিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের দেশ ছোট হলেও আমাদের উর্বর ভূমিতে সবকিছু জন্মে। বিশেষ করে দেশি ফল খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। বিদেশি ফল আমদানি বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে দেশেই আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, কলা, মালটা, কমলা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে। শুধু আমাদের ইচ্ছার পরিবর্তন করে দেশি ফল খাওয়ার চিন্তা করতে হবে। আমি বহুদিন যাবত কোনো বিদেশি ফল কিনি না। সব সিজনেই আমাদের দেশে ফল উৎপাদন হয়ে থাকে।
কয়েকদিন পূর্বে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সাবেক সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা শহীদ কামারুজ্জামানের কারাগার থেকে দেখার বিষয়ের ওপর বই প্রকাশিত উৎসব পালিত হলো, ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে। বিশিষ্টজনরা শহীদ কামারুজ্জামানের জীবনচরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করলেন। এমন ব্যক্তির অভাব পূরণ করা সত্যিই কঠিন। আমরা তার অভাব পূরণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তার পরিবারের জন্য দোয়া করি- যাতে শোক সহ্য করার তাওফিক দান করেন। আর তার লেখা ও রেখে যাওয়া সোনার বাংলাসহ সব কাজ যাতে আমরা যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে পারি, তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।
আমরা ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে বাস করি। তাই আমাদের কৃষ্টি-কালচার সবই আমাদের বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা সবাই মিলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শান্তির সাথে বসবাস করতে চাই।
ভালো-মন্দ মিশ্রনে চলে গেল ২০২৪ সাল। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছিল এ বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৬ বছরের স্বৈরাচার হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে দেশ রাহুমুক্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ৫৪ বছরের স্বৈরাচার পালানো বড় ঘটনা। সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আমরা অতীত ভুলে আগামির ২০২৫ সালে সংস্কার শেষ করে অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে চাই।
আমরা দুনিয়ার সব দেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে চলতে চাই। কারো দাদাগিরি আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমরা আমদানি-রফতানি সবার সাথে বাণিজ্য নর্মস মেনে চালিয়ে যেতে চাই। আমাদের দেশের উৎপাদন বাড়ানোর সব ক্ষেত্রে আবাদ করতে চাই। দেশের জনশক্তি বিদেশে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে চাই। আমরা ছাত্র-জনতার ঐক্য বজায় রেখে দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে চাই। কারও সাথে বিরোধ নয়, সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে চাই। মহান আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতা চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।